জেনেভা
রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় বাসে চেপেছিলাম---বন থেকে বেরিয়ে, প্রায় গোটা জার্মানি পেরিয়ে, দক্ষিণপশ্চিমের সীমান্ত টপকে টুক করে ফ্রান্সে ঢুকে আরও খানিকটা নিচের দিকে নেমে, ফ্রান্স আর সুইৎজারল্যান্ড সীমারেখা পেরিয়ে জেনেভা পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের বেজে গেল সন্ধ্যে প্রায় সাতটা। শহরে যখন ঢুকছি, তখন দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে। গোধূলির আলোয় জেনেভাকে প্রথম যেটুকু দেখার আশা ছিল, আক্ষরিক অর্থেই তাতে জল ঢেলে দিল ঝেঁপে আসা বৃষ্টি।
শহরটাকে ভালো করে প্রথম দেখার সুযোগ পেলাম সোমবার
সকালে বাসের জানালা থেকে। দেখে প্রথমেই মনে পড়ল কলকাতার কথা। অফ কোর্স, জেনেভা
কলকাতার থেকে অনেক সুন্দর, অনেক পরিচ্ছন্ন, অনেক নিরিবিলি, কিন্তু ব্লুপ্রিন্টটা
একই। সরু সরু রাস্তা, রাস্তার ঘাড়ের ওপর লম্বা লম্বা বাড়ি, রাস্তার এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্তে কাটাকুটি খেলা ইলেকট্রিক তার। এই যেমন ধরুন এই নিচের রাস্তাটা। জেনেভায়
থাকে মোটে দু’লাখ লোক। খুঁজেপেতে আরও আটচল্লিশ লাখ লোককে ধরে এনে এই রাস্তায় ছেড়ে
দিলে জেনেভা আর কলকাতার মধ্যে কোনও তফাৎ থাকবে বলে আপনার বিশ্বাস?
জেনেভাতে সকলেরই যেখানে কাজ থাকে, আমাদেরও সেখানেই
কাজ ছিল। ইউ এন ডিস্ট্রিক্ট। ইউ দিয়ে শুরু হওয়া নামের যতরকম অফিস রয়েছে পৃথিবীতে,
তাদের নব্বই শতাংশের ঠিকানা হচ্ছে এই ডিস্ট্রিক্ট। বাস থেকে নামতে নামতেই স্লোগান কানে
এসেছিল। নেমে দেখি গোটা তিরিশ লোক ইউ এন অফিসের গেটের দিকে মুখ করে রংচঙে সিংহআঁকা
পতাকা নাড়িয়ে, ‘ফ্রি টিবেট’ লেখা ব্যানার দুলিয়ে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে “স্টপ দ্য
কিলিং, স্টপ দ্য কিলিং”, “চায়না লাইস্, চায়না লাইস্” এই সব বলছে। প্রতিবাদকারীর সংখ্যা কম,
কিন্তু তা বলে আবেগ কম নয়।
শুনলাম ওই চত্বরটা
প্রতিবাদ চত্বর হিসেবে বিখ্যাত। সকালে, বিকেলে, দুপুরে একটা না একটা প্রতিবাদের
প্রোগ্রাম থাকেই। সারাবছর ধরেই ফুটপাথে তাঁবু ফেলে অনশন, অবরোধ। প্রতিবাদের বিষয়
তিব্বতে চাইনিজ স্বেচ্ছাচার থেকে শুরু করে ব্রাজিলের এল জি বি টি কমিউনিটির প্রতি
বঞ্চনা থেকে শুরু করে তামিল শ্রীলংকানদের দুরবস্থা।।
এই ইউ এন ডিস্ট্রিক্টের ঠিক মধ্যিখানে, সারি সারি ফোয়ারার
মনোরম দৃশ্যকে ম্লান করে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা পায়াভাঙা চেয়ার। ফোটোজেনিক নয়
একটুও, কিন্তু স্ট্যাটিসটিক্স্ বলে লেক, প্রাসাদ, মিউজিয়াম, ফোয়ারা সবাইকে পেছনে
ফেলে, এ রূপসী শহরে সবথেকে বেশি ছবি উঠেছে এই চেয়ারের। সাড়ে পাঁচ টন কাঠ দিয়ে, ঊনচল্লিশ ফুট উঁচু এই
চেয়ারটা বানানো হয়েছিল উনিশশো সাতানব্বই সালে। হ্যান্ডিক্যাপ
ইন্টারন্যাশনাল’ চেয়ারটা প্যালেস অফ নেশনস্ বিল্ডিং-এর সামনে (যাকে এক কথায়
ইউ এন বিল্ডিং বলে সবাই) বসিয়ে দেয় অগস্ট মাসে। তিন মাস বাদে অটোয়া ট্রিটি সই
হওয়ার কথা ছিল। ট্রিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ল্যান্ডমাইন আর ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার
নিষিদ্ধ করা। চল্লিশটি দেশের সই নিয়ে অটোয়া ট্রিটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছিল
উনিশশো নিরানব্বই-এ। ক্লাস্টার বোমা নিষেধের আইন চালু হতে সময় লেগেছিল আরও এগারো
বছর। কনভেনশন অফ ক্লাস্টার মিউনিশন বসেছিল দু’হাজার আট সালের আয়ারল্যান্ডে, আর
সইসাবুদ সারার পর সেটা আইনের চেহারা নিয়েছিল দু’হাজার দশে।
আইন কথাটা বলা একটু গোলমেলে কারণ এই আইন শুধু সেই সব
দেশের জন্যই প্রযোজ্য যারা ট্রিটি সই করেছে। যারা সই করল না, তাদের অপরাধবোধে
দগ্ধে মারার জন্য চেয়ারটা প্যালেস অফ নেশনসের সামনে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল। বাই
দ্য ওয়ে, আমরা দুটো ট্রিটির কোনওটাতেই সই করিনি।।
মাঝের বাড়িটা হচ্ছে ISO (International Organization for Standardization)-এর হেডঅফিস।
আর এইটা হচ্ছে রেডক্রসের।
প্যালেস অফ নেশন্সের দেওয়ালে ষাট মিটার দৈর্ঘ্যের ফ্রেসকো। এ ফ্রেসকো যখন জনসাধারণের দৃষ্টির
জন্য উন্মোচন করা হয় তখন শিল্পী Hans Erni-র বয়স ছিল মোটে একশো।
আর এই হচ্ছে প্যালেস অফ নেশনস্।
আমার এবং পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের কাছে জেনেভার মুখ। উনিশশো ঊনত্রিশ থেকে উনিশশো
ছত্রিশ, সাত বছর ধরে প্রাসাদ বানানো হয়েছিল। ইউ এনের অফিস হওয়ার আগে লিগ অফ
নেশনসের অফিসও ছিল এই বাড়িতেই। চৌত্রিশখানা কনফারেন্স রুমওয়ালা আর ছ’শো মিটার
লম্বা এই বাড়ি আয়তনের দিক থেকে ইউরোপে ভার্সাই প্যালেসের ঠিক পরেই। বছরে ন’হাজার
মিটিং বসে আর সারা পৃথিবী থেকে প্রায় তিরিশ হাজার প্রতিনিধি সে সব মিটিং অ্যাটেন্ড
করতে আসেন।
জেনেভা লেকের ধারে, রোদঝলমলে দিয়ে মঁ ব্লা-র চুড়োর
দিকে তাকিয়ে থাকা প্যালেস অফ দ্য নেশন্সের বাইরেটা যতই চমকপ্রদ হোক না কেন, আমার
মতে ভেতরটার তুলনায় সেটা কিছুই না। গিজগিজ করছে করিডর, হল, বারান্দা। কিন্তু ভিড়ের থেকেও বেশি মজার হল
ভিড়ের চরিত্র। পৃথিবীতে যত রকম চেহারার, সাজপোশাকের মানুষ আছে, সব পাওয়া যাবে
এই বাড়িটার ভেতর। গত তিনমাসে যতজনকে দেখেছি, তার
থেকে বেশি ভারতীয় দেখে ফেলেছিলাম প্যালেসের ভেতরের তিনঘণ্টায়। ফাইল বুকে জাপটে ধরে
করিডর দিয়ে ছুটন্ত সালোয়ার কামিজ (থামিয়ে জিজ্ঞাসা করিনি, কিন্তু আমি হান্ড্রেড
পার্সেন্ট নিশ্চিত জামাটা ফ্যাবইন্ডিয়া থেকে কেনা) দেখেছি, একগাদা কালো কোটের
জটলার ফাঁক দিয়ে সিল্কশাড়ির অঞ্চলপ্রান্ত দেখেছি, ক্যাফেটেরিয়ার ভেজিটারিয়ান
খাবারের লাইনে অপেক্ষা করা শান্ত সৌম্য মাঝবয়সী মুখ দেখেছি। যত গ্লোবালাইজড্
পৃথিবীতেই বাস করুক না কেন, চোখের ট্রেনিং-ই আলাদা, হাজার বৈচিত্র্যের মধ্যেও সে
ঠিক চেনা মুখ খুঁজে বার করে নিতে পারে।
জেনেভা দামি শহর। এতটাই দামি যে দুহাজার এগারো সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে বিশ্বের আর মোটে চারটে শহরে থাকাখাওয়ার খরচ জেনেভার
তুলনায় বেশি। যে কোনও সুপারমার্কেটে ঢুকলেই সেটা টের পাওয়া যায়। প্রতিটি জিনিসের
দাম বনের তুলনায় অন্তত দেড়গুণ চড়া। সান্ত্বনা একটাই, থাকার খরচ যেমন
বেশি, জেনেভার লোকের গড় মাইনেও বাকি ইউরোপিয়ান শহরের লোকদের তুলনায় বেশ বেশি।
পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে রাজারাণী রাজপুত্ররাজকন্যারা জেনেভায়
শপিং করতে আসেন অহরহ। মানচিত্রের কোণাঘুপচিতে লুকিয়ে থাকা, হতদরিদ্র সব দেশ। দেশের
লোকের টাকা যত কম, দেশের রাজার টাকা তত বেশি। কেউ সপ্তাহান্তে আসেন, কেউ মাসে মাসে
আসেন, কেউ ন’মাসে ছ’মাসে। জেনেভা লেকের নীল টলটলে জলে নিজস্ব পালতোলা নৌকো ভিড়িয়ে তাঁরা
জেনেভার Rue du Rhone-এ ঘুরে ঘুরে মিলিয়ন ডলারের ঘড়ি কেনেন, সোনার গুঁড়ো মাখানো
চকোলেট চেখে দেখেন।
ট্র্যাফিক জ্যামের সাম্যবাদ। ফেরারি আর ট্যুরিস্ট বাস, কাছাকাছি, পাশাপাশি।
জেনেভার আরেকটা মুখ্য আকর্ষণ হল
লেক জেনেভা। ফ্রান্স আর সুইৎজারল্যান্ড জুড়ে শুয়ে আছে পশ্চিম ইউরোপের সবথেকে বড় এই
লেক। জেনেভার মতোই জেনেভার লেকও চিরদিন বড়লোকদের টেনেছে। লেকের তীর ধরে উঠে যাওয়া
পাহাড়ের ঢালে কত বিখ্যাত বড়লোক যে বাড়ি বানিয়েছেন বা ছুটি কাটিয়েছেন তার ইয়ত্তা
নেই। ভ্লাদিমির লেনিন, চার্লি চ্যাপলিন, মাইকেল শুমাখার। কিন্তু এঁদের সবাইকে
ছাপিয়ে যে সেলিব্রিটির ভ্রমণবৃত্তান্ত লেক জেনেভাকে অমর করে রেখেছে তিনি হলেন লর্ড
বায়রন।
আঠেরোশো সালের মে মাসে, আঠাশ বছরের লর্ড বায়রন লেক জেনেভার তীরে এসে তরী
বাঁধলেন। উদ্দেশ্য, লেক এবং আল্পসের যুগ্ম শোভা উপভোগ এবং কাব্যচর্চা। তখন সদ্য
লর্ড বায়রনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। সে ধকল কাটিয়ে ওঠাটাও লেকভ্রমণের আরেক কারণ হতে
পারে। লর্ড বায়রনের নৌকায় ছিলেন তাঁর চাকরবাকর, ডাক্তার, সৎবোন অগস্টা, (এঁর সঙ্গে
লর্ড বায়রনের সম্পর্ক আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে ছিল “কমপ্লিকেটেড”।) একটি ময়ূর, একটি
বাঁদর ও একটি কুকুর। লেক জেনেভায় এসে বায়রনের দেখা হয়ে গেল আরেক উঠতি কবির সঙ্গে।
এঁর নাম শেলি। ‘ফ্রি লাভ’-এ বিশ্বাস করেন এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। শেলির সঙ্গে
ছিলেন তাঁর প্রতিভাধর গার্লফ্রেন্ড মেরি (আর এক বছর বাদেই তাঁরা বরবউ হয়ে যান) এবং
মেরির অতি সুন্দরী সৎবোন ক্লেয়ার। এই ক্লেয়ার আবার দুই খেপে, বায়রন এবং শেলি
দুজনেরই গার্লফ্রেন্ড ছিলেন। লর্ড বায়রন এবং ক্লেয়ারের অ্যালেগ্রা বলে একটি
কন্যাসন্তানও ছিল।
আড্ডা
জমে উঠল। পাশাপাশি দুটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুই কবি কাব্যচর্চায় বসে গেলেন। মাঝে মাঝে
লেক জেনেভায় নৌকোভ্রমণ কিংবা আল্পসের আনাচেকানাচে ঘোড়ায় চেপে ঘোরাঘুরি করে টাইমপাস
করা হত। ছুটিতে সকলেই অনেক কিছু লিখেছিলেন, কিন্তু সবার থেকে ভালো লেখাটা
লিখেছিলেন মেরি---ফ্র্যাংকেনস্টাইন।
জেনেভা লেকের ওপর Jet d'Eau. আঠেরোশো ছিয়াশি সালে হাইড্রলিক পাওয়ার নেটওয়ার্কের
সেফটি ভালভ হিসেবে যা চালু হয়েছিল, এখন তা
জেনেভার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক। প্রতি সেকেন্ডে পাঁচশো লিটার জল, একশো চল্লিশ মিটার উচ্চতায়
ওঠে।
Bourg-de-Four, পুরোনো জেনেভার হৃদয়। সেই
নবম শতাব্দী থেকে এই বাজারে বসে লোকজন কফি খাচ্ছে, বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে আড্ডা
দিচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতেও জেনেভার সবথেকে হিপ অ্যান্ড হ্যাপেনিং জায়গা হল এই Bourg-de-Four. শহরের
যত বলার মতো লোক, তাঁরা নিয়মিত এই চত্বরে ঘোরাফেরা করেন। আমরা যখন ঘুরছিলাম তখন
নাকি জেনেভার মেয়র রাস্তার ধারের টেবিলে বসে ডিনার করছিলেন। গাইড তখন বলেননি, কারণ
টুরিস্টদের বিশ্বাস নেই, হয়ত লাফিয়ে পড়ে খচাৎ খচাৎ ছবি তুলতে লেগে যাব, ওয়েটারের
হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ন্যাপকিন এগিয়ে দিয়ে বলব, “অটোগ্রাফ প্লিজ।” জেনেভার লোকদের
সেলিব্রিটি দেখে দেখে অভ্যেস আছে। গাইডের মুখে শুনলাম, মাঝে মাঝেই নাকি বাজারে
সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে যায়।
এই রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চে দস্তয়েভস্কির মেয়ের
ব্যাপটিজম হয়েছিল।
লাল সাদাটা সুইৎজারল্যান্ডের আর লাল হলুদ সবুজটা জেনেভার
পতাকা। সুইৎজারল্যান্ডের পতাকাই পৃথিবীর একমাত্র চৌকো পতাকা, বাকি সব আয়তাকার।
এই বাড়িটায় থাকতেন জেনেভার আর এক সেলিব্রিটি সন্তান। Jean Henry Dunant. রেড ক্রসের
প্রতিষ্ঠাতা। ভদ্রলোক আদতে ছিলেন ব্যবসাদার। ব্যবসার সূত্রে জমি নিয়ে কী একটা
গোলযোগ হওয়ায় তিনি সোজা ফ্রেঞ্চ সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নকে (এই নেপোলিয়ন সেই
নেপোলিয়ন নন, ইনি হচ্ছেন তাঁর ভাইপো) চিঠি লিখে সুবিচার চান। তখন আঠেরোশো ঊনষাট
সাল, ভাইপো নেপোলিয়ন লম্বার্ডির যুদ্ধে ব্যস্ত। অস্ট্রিয়া এসে ইতালির অর্ধেক দখল
করে নিয়েছে, আর অমনি হা রে রে রে করে ফ্রান্স গেছে ঠেকাতে। ভাইপো নেপোলিয়নের
যুদ্ধক্ষেত্রের হেডকোয়ার্টারস ছিল ছোট্ট শহর সল্ফেরিনো। সুবিচার পাওয়ার আশায় Dunant খুব প্রশস্তি-টশস্তি
করে রাজাকে চিঠি লিখলেন, বললেন যে তিনি রাজার সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চান, আর তারপর
ডাক পেয়ে রওনা দিলেন সলফেরিনোর উদ্দেশ্যে।
সলফেরিনোয় গিয়ে Dunant-এর মাথা থেকে ব্যবসা, জমি, রাজাগজা---সব উবে গেল। দিনের মতো যুদ্ধ শেষ করে
রাজামশাই শিবিরে ফিরে গেছেন, তেইশ হাজার আহত সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর অপেক্ষায়
পড়ে আছে, সেবাশুশ্রূষার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। রাজদর্শন মাথায় উঠল, আশেপাশের গ্রাম
থেকে লোক ডেকে এনে Dunant নেমে পড়লেন কাজে। ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করলেন, অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করলেন।
সাধ্যসাধনা করে ফ্রেঞ্চদের হাতে বন্দী হওয়া অস্ট্রিয়ান ডাক্তারদের ছাড়িয়ে এনে
সেনাদের চিকিৎসার কাজে লাগালেন।
বাড়ি ফিরে এসে, এই দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা বই লিখলেন Dunant। আ মেমরি অফ সলফেরিনো।
আঠেরোশো বাষট্টিতে নিজের পয়সায় বই ছাপালেন তিনি। যা দেখেছিলেন, বইয়ে সব লিখলেন।
যুদ্ধের আসল কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস করে দেখালেন। আর বললেন, দরকার আছে এমন এক
নিরপেক্ষ সংগঠনের, যারা আহত সেনাদের চিকিৎসার ভার নেবে।
বই হইহই করে বিক্রি হল। Dunant দেশে দেশে ঘুরে নিজের আইডিয়া প্রচার করতে লাগলেন। আঠেরোশো তেষট্টিতে, জেনেভার
আর চারজন অভিজাত লোকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন “কমিটি অফ দ্য ফাইভ”। এই কমিটি Dunant-এর আদর্শ প্রচারের
জন্য আন্তর্জাতিক কনফারেন্স, মিটিং ইত্যাদির আয়োজন করতে লাগল। ক্রমে লোকবল জড়ো হল,
আর সৃষ্টি হল ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রিলিফ টু দ্য উন্ডেড’।
Dunant-এর ব্যবসার কী হল? যা হওয়া স্বাভাবিক। ব্যবসা লাটে উঠল, Dunant দেউলে ঘোষিত হলেন। চার
অভিজাতর একজনের সঙ্গে মনোমালিন্য বাধল, Dunant বিতাড়িত হলেন তাঁরই
আদর্শে, তাঁর নিজের হাতে গড়া সংস্থা থেকে। জুয়াচুরির অপরাধে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
জারি হল। Dunant জেনেভা ছাড়লেন, আর কোনওদিন ফিরলেন না। এদিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রিলিফ
টু দ্য উন্ডেড’-এর শাখা দেশে দেশে বিস্তৃত হল। আঠেরোশো ছিয়াত্তরে কমিটির নাম বদলে
রাখা হল ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস’।
গল্পটা
একেবারে দুঃখের না, একটু সান্ত্বনাও আছে। উনিশশো এক সালে ফ্রান্সের শান্তিবাদী Passy-র
সঙ্গে ভাগাভাগি করে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল Dunant-কে।
এই বাড়িটার নিচে এসে আমাদের গাইড ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, “See? He was not a
f@#$ing French. He was a f@#$ing Genevese.”
একশো ছাব্বিশ মিটার (অর্থাৎ কি না চারশো তেরো ফুট)
লম্বা কাঠের বেঞ্চি। জেনেভার লোকেরা বলে এইটাই পৃথিবীর সবথেকে লম্বা বসার বেঞ্চি।
ঘোরা প্রায় শেষ। কিন্তু ক্যাথিড্র্যাল কোথায় গেল? ইউরোপিয়ান
শহর ঘুরব অথচ ক্যাথিড্র্যাল দেখব না, এ কী হতে পারে? গাইড আশ্বস্ত করলেন।
ক্যাথিড্র্যাল আছে ক্যাথিড্র্যালের জায়গাতেই। ক্যাথিড্র্যালের ইতিহাসভূগোল নিয়ে
অনেক কথা শুনলাম, প্রেসবিটারিয়ান, ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট---মাথার ভেতর গিয়ে সব
ঘোঁট পাকিয়ে গেল। কিচ্ছু মনে নেই, শুধু ক্যালভিনের কথা মনে আছে।
এই ক্যালভিনের বয়স ছয় নয়, আর এর পোষা ডোরাকাটা বাঘও নেই। এই ক্যালভিনের আসল
নাম জন ক্যালভিন, ইনি একজন ভীষণ থুত্থুড়ে (১৫০৯-১৫৬৪), ভীষণ কড়া থিওলজিস্ট এবং
খ্রিষ্টধর্মসংস্কারক। এঁর প্রবর্তিত খ্রিস্টান থিওলজি পরে ক্যালভিনিজম নামে জগতে
বিখ্যাত হয়েছিল। জেনেভার সেন্ট পিয়েরের ক্যাথিড্র্যালকে কেন্দ্র করে প্রবল সংস্কার
অভিযান চালিয়েছিলেন ক্যালভিন। খুব কড়া ছিলেন শুনেছি। গানবাজনা রঙ্গরসিকতা
বিলাসব্যসন মোটে সইতে পারতেন না।
কেবল একটা জিনিসের প্রতি সামান্য পক্ষপাত ছিল ক্যালভিনের। ঘড়ি।
সুইৎজারল্যান্ডের ঘড়ি বানানেওয়ালাদের কিছু বলতেন না ক্যালভিন। তিনি মনে করতেন ঘড়ি
কাজের জিনিস। ভবলীলা সাঙ্গ করে আমরা সবাই যখন স্বর্গের পার্লি গেটে গিয়ে লাইন দেব,
তখন গেট আটকে দাঁড়িয়ে থাকা গড আমাদের সবার কবজি উলটে ঘড়ি দেখে কড়ায়গণ্ডায় হিসেব
নেবেন, পৃথিবীতে যাপন করা প্রতিটি মুহূর্ত আমরা কে কেমন করে খরচ করেছি।
কী
সাংঘাতিক। ভাবলেই বুকের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে যায় না? আমার ঘড়িও বলছে, এইবার না উঠলে
বাস মিস, অফিস মিস, স্বর্গের গেটে লাইন দেওয়া মিস। কাজেই আমি চললাম, যাওয়ার আগে
রূপসী জেনেভার আরও কতগুলো ছবি আপনাদের দেখানোর লোভ সামলাতে পারলাম না।
khub bhalo kore 'জেনেভা' beralam ar darun galpo shunlam.chhobi gulo to nijerai galpo bole :-).
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা। আমিও খুব ভালো বেড়িয়েছি।
Deletedarun laglo chabi dekhe o pore :-)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
DeleteBah. Tomar through diye kirom Europe er oi part ta ghora hoye jachche. Chaliye jao, boss! :)
ReplyDeleteগুড গুড। থ্যাংক ইউ বিম্ববতী।
Deleteদারুন লেখা, দারুন ছবি। ১৯৮৮ সালে আমার বাবা-মা যখন জেনেভা ঘুরে এসেছিল, তখনকার ছবির মধ্যে আমার কাছে একটা জিনিসই স্মরণীয় ছিল। আপনার লেখাটা শুরু করেই সেই জিনিসটার ছবি খুঁজছিলাম। সেটা ওই একশো চল্লিশ মিটার উঁচু ফোয়ারা। আপনার চোখ দিয়ে সেটাও আরেকবার দেখা হয়ে গেল।
ReplyDeleteহ্যাঁ, ফোয়ারাটা একটা দেখার মতো ব্যাপার বটে। কাকুকাকিমার জেনেভা কেমন লেগেছিল?
Delete১৯৮৮ সাল তো, ইন্টারনেট বা একশোটা টিভি চ্যানেল কিছুই ছিলনা। তাই ওরা যাই দেখেছিল ভীষণ ভালো লেগেছিল। আর এত অজস্র ছবিও তুলে আনতে পারেনি - ফিল্মেরও তো দাম আছে। কাজেই আমার অনেকটাই কানে শোনা কথা। জেনেভার ছবি যে কত এই মুহুর্তে মনে পড়ছে - ওই লেকের ধারে রেলিংটা চিনতে পারলাম (আপনার রোলেক্সের ওপরের ছবিটা), আর একটা টয় ট্রেনের ছবি ছিল, সেটাও লেকের ধারে। আর একটা বাগানে একটা মাটিতে শোয়ানো বিশাল ঘড়ি, যার ডায়ালটা আসলে ফুলগাছ দিয়ে তৈরী, যন্ত্রপাতি মাটির নিচে। সেগুলো আপনি দেখেছেন?
Deleteদেখেছি সুগত। ফুলের ঘড়িটা একটা বিগ ডিল শুনলাম। কিন্তু ওইরকম ঘড়ি এখন সুইৎজারল্যান্ড ছাড়াও আরও নানা জায়গায় দেখা যাচ্ছে বলে আর সেটার ছবি তুলিনি।
Deleteসেদিন ফিল্ম আর মেমোরি কার্ডে ছবি তোলার পার্থক্য নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং আলোচনা হচ্ছিল বাসে একজনের সঙ্গে। এত যে ছবি তুলি, দেখে কে? নিজেই নিজের অর্ধেক ছবি মন দিয়ে দেখি না। আর আপনার দেখুন, অত ছোটবেলায় দেখা ছবি, এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।
পাঁচ বছর প্রায় হয়ে গেল এখনও রূপসী জেনেভাকে ভুলতে পারিনি ,কুন্তলা । খুব ভাল ছিলাম । gare cornavin ওই রেল স্টেশনের কাছেই থাকতাম ।স্মৃতি সব হুড়মুড়িয়ে চলে এল তোমার লেখা পড়ে । সুন্দর লেখা ।
ReplyDeleteমিঠু
ও মা, তোমার পাড়া থেকেই ঘুরে এলাম তো তার মানে মিঠু। খুব সুন্দর পাড়ায় থাকতে কিন্তু তোমরা।
Deleteপ্রিয় কুন্তলাদেবী,
ReplyDeleteবারকুড়ি জেনেভা গিয়ে, অজস্র বার অসাধারণ গথিক এবং আধুনিক (শি ফর শিব্রাম) স্টাকচারগুলো দেখেও, যে লেখাটা লিখতে পারি নি সেটা অবশেষে পড়লাম।
আপনি ভাল থাকবেন এবং ভাল লিখবেন।
আর হ্যাঁ, আমার এক বহু পুরনো বন্ধু বলছিল, আপনার এই সুন্দর বড়ো বড়ো ছবিগুলো দেখতে তার খুব কষ্ট হয়েছে। আপনাকে একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করলাম।
ইতি,
অবান্তরের মনযোগী পাঠক
পুনঃশ্চ - আমার বন্ধুর নাম বি এস এন এল
আরে আমি কী করব অনির্বাণ, আমি নিজে চারচোখ দিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে আসল জিনিসগুলো দেখেছিলাম, তাই অবান্তরে দেখানোর সময় প্রাণে ধরে ছবিগুলো বেশি ছোট করতে পারছিলাম না। তাছাড়াও আরেকটা কারণ আছে, যেটাকে আমার ঠাকুমা বলেন "আদ্যাখলায় দ্যাখসে, পুঁটিমাছে ল্যাখসে।" পুঁটিমাছের হাতে পেন আর কুন্তলার হাতে ক্যামেরা, একই রকমের বিপজ্জনক। ল্যাম্পপোস্ট দেখলেই মনে হয় আর্ট। এরপর থেকে পোস্টে কম ছবি দেব, প্রমিস। অন গড ফাদার মাদার।
Delete