মেজমামি
প্রত্যেক মানুষের
নিজস্ব সিগনেচার ইমোশন থাকে। কাউকে দেখলেই বিষণ্ণতার কথা মনে পড়ে, কারও সঙ্গে পাঁচ
মিনিটের বেশি না হেসে কাটানো যায় না। আমার মেজমামির ছিল আনন্দ।
ছিল বলছি কারণ গত
সপ্তাহে মেজমামি মারা গেছেন। খুচখাচ অসুখ ছিল, ষাটের আশপাশে ঘোরাঘুরি করা বাঙালি
ভদ্রমহিলাদের যা যা থাকে। হাঁটুব্যথা, সুগার, রাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম। বুধবার বেলা
এগারোটা নাগাদ বাথরুমে ঢুকেছিলেন, সোয়া এগারোটা নাগাদ বাথরুমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে
দোলন আবিষ্কার করল বাথরুমের দরজা খোলা, মেঝের ওপর মামি অচেতন। চিৎকার চেঁচামেচি,
একতলা থেকে ছোটমামা-ছোটমামির ছুটে আসা, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন, হাসপাতাল যাওয়া, ইনটেনসিভ
কেয়ার ইউনিট, আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ, ডাক্তারের মাথা নাড়া, কয়েকঘণ্টা পরে
মৃত্যু ঘোষণা।
নির্ঝঞ্ঝাট,
ঝটপট। নির্ভুল মেজমামি স্টাইল। রেলগাড়ির স্পিডে কথা বলতেন মামি। অনেক কথা বলার ছিল
তাঁর, এদিকে একটা দিনে সময় মোটে চব্বিশ ঘণ্টা। অগত্যা স্পিড না বাড়িয়ে উপায় নেই।
কসবার ডাইনিং টেবিল ঘিরে কনফারেন্স বসত। আমার দাদুদিদিমার নয় ছেলেমেয়ে, বারো
নাতিনাতনি আর সেই নাতিনাতনিদের গোটা চারেক ছানাপোনা। সকলেই বেশি কথা বলে, সকলেই
চেঁচিয়ে কথা বলে। কথা বলার কম্পিটিশনে সবাইকে হারিয়ে প্রত্যেকবার জিততেন মেজমামি।
কথা ছাড়াও লোকের
মুখ বন্ধ করানোর আরেকটা ব্রহ্মাস্ত্র ছিল মামির। রান্না। সব পরিবারেই একএকজন
সেলিব্রিটি রাঁধিয়ে থাকে, আমাদের ছিলেন মেজমামি। সানন্দা পড়ে শেখা টোফু-পাতুরি মার্কা
রান্না নয়, রিয়েল রান্না। আমাদের বাড়ির কত বাচ্চার খাওয়ার প্যাকনা যে সারিয়েছেন মামি
তার ইয়ত্তা নেই। বেগুন খায় না? পথ্য মেজমামির হিং-বেগুন। পটল দেখলে ওয়াক তোলে? নেক্সট
বার মামাবাড়ির নেমন্তন্নের মেনুতে মেজমামির চিংড়ি পটলের দোরমা মাস্ট।
বিয়ে, অন্নপ্রাশন,
জন্মদিন---যে কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে দরজা দিয়ে মামিকে ঢুকতে দেখলে হইহই রব উঠত। সবাই
জানতে চাইত, এত দেরি কীসের? আমাদের কত মজা মিস্ হয়ে গেল। মামি কপট দুঃখের ভান করে
বলতেন, ইস্ এতগুলো টাকা মিছিমিছি গচ্চা দিলাম, দেখে বুঝতে পারছিস না, দেরি কেন
হল?
বিউটি পার্লার! মামি
তুমি পার্লারে গিয়েছিলে? সকলে চেঁচিয়ে উঠত। বড়মামা মাথা নাড়তেন। এমনিতেই তো কত সুন্দর
দেখতে লাগে তোমাকে পূরবী। ওই লোকঠকানো বিজনেসে মিছিমিছি টাকা ঢালছ। সেজমাসি বলতেন,
আহা দাদা, কী যে বল। ছেলেমানুষরাই তো যাবে পার্লারে, আমি তুমি যাব নাকি। পঞ্চাশ
পেরোনো ছেলেমানুষ মামি পার্লারের গল্পের ঝুলি খুলে বসতেন। পার্লারে কে কেমন
সাজছিল, ফেসপ্যাক মেখে কাকে কেমন ভূতের মতো দেখাচ্ছিল, কে কার শাশুড়ির নিন্দে
করছিল। মামি হাতপামুখচোখ নেড়ে সব ব্যাখ্যান করে বলতেন, আর মামির চারপাশে ভিড় করে
বসে সবাই সে গল্পের প্রতিটি শব্দ হাঁ করে গিলত। বড়মামা থেকে শুরু করে ওয়াটারবটল
গলায় ঝুলিয়ে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া ছোটনদি’র ছেলে।
তিনপ্রজন্ম জুড়ে
নিজের জনপ্রিয়তা মেন্টেন করা সোজা নয়। মামি সে কাজটা অনায়াসে করতেন। আর পাঁচটা
কাজের মতোই। ওই অনায়াসতাটাই ছিল মামির ব্যক্তিত্বের মূল সুর।
মায়ের ফোন পাওয়ার
পর অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম। গত তিরিশবছরের স্মৃতি, চিরুনি চালিয়ে তন্নতন্ন করে
খুঁজলাম। একমুহূর্তের জন্যও মামির হাসিহীন মুখ মনে করতে পারলাম না। সারপ্রাইজ দেব
বলে না বলে বেলা তিনটের সময় গিয়ে বেল টিপেছি, মেজমামি দরজা খুলছেন। মামির চোখ
কাঁচাঘুমে তখনও প্রায় বন্ধ, মুখে হাসি। কী পাজি মেয়ে! আমরা ফ্রিজ খালি করে সব খেয়ে
ফেলেছি, কিচ্ছু খেতে পাবে না এখন, বেশ হবে। ভেতরের ঘর থেকে মামা বেরিয়ে আসছেন।
মামা ঘুমোন না, মামার হাতে ধরা শরদিন্দুর মোটা রচনাবলী। সোনা তুমি এই গল্পটা পড়েছ?
মামা পাতা উল্টে গল্প খুঁজছেন। মামি মাথা চাপড়ানোর ভঙ্গি করে মামার হাত থেকে আমাকে
উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে দিচ্ছেন। চুপ করে বস। আমি
আসছি। মামি পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকছেন। এক হাতে গ্লাসে টলটলে ঠাণ্ডা জল, আরেক হাতে
ধরা প্লেটের ওপর আমার দেখা বিশ্বের বৃহত্তম পাটিসাপটা। মুখে কেল্লা ফতে হাসি। আমি হাঁ।
তোমার ফ্রিজে র্যান্ডম বুধবার দুপুরে পাটিসাপটা রাখা থাকে মামি? মামি আমার হাতে
প্লেট চালান করে খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসছেন, না তা থাকে না। কিন্তু আমি জানতাম আজ
তুই আসবি। সিরিয়াসলি, তুমি কি ম্যাজিক জানো? মামি উঠে গিয়ে জানালার পর্দা
সরাচ্ছেন। পড়ন্ত দুপুরের আলো গ্রিলের ফাঁক
দিয়ে ঢুকে ঘর ছেয়ে ফেলছে। মামি বলছেন, হুঁ হুঁ বাবা, এ হচ্ছে মেজমামির ম্যাজিক।
ম্যাজিকের মতো
মামি চলে গেছেন। শোকের সময় যদিও, তবু শোক বিশেষ টের পাচ্ছি না। অকুস্থল থেকে দূরে
আছি বলে নয়, কলকাতায় যারা আছে, যারা হাসপাতালের দরজার ওপাশ থেকে অসংখ্য নল গোঁজা মেজমামির নিশ্চল
অবয়বের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, “বডি” নিয়ে কসবায় ফিরেছে, কেওড়াতলায় গেছে---তারাও খুব
যে শোক করেছে তা নয়। বরং শকের ভাগটাই বেশি। এ’রকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে সেটা
মেনে নেওয়ার ধাক্কাটা, এই মুহূর্তে মামির চলে যাওয়ার কষ্টের থেকে অনেকগুণ বেশি।
কিন্তু এই
মুহূর্তটা কেটে যাবে। আবার কারও একটা বিয়ে হবে, কিংবা কারও বাচ্চার অন্নপ্রাশন।
আবার সকলে এধারওধার থেকে এসে জুটবে। আবার টেবিল ঘিরে আড্ডা বসবে, খবর দেওয়ানেওয়া
হবে। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সকলেরই মনে পড়বে, আরও যেন কার আসার কথা ছিল। কার যেন এসে
টেবিলের মধ্যমণি হয়ে বসার কথা ছিল, গল্পের ঝুলি উজাড় করে ঢালার ছিল।
সেই সব না শোনা
গল্পের দুঃখে তখন আমরা সবাই মিলে কাঁদব তোমার জন্য মামি। এখন নয়।
Hug. :(
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ বিম্ববতী।
Deleteজানি না কী লিখব
ReplyDeleteমিঠু
কিছু বলার দরকার নেই মিঠু। ভেবেছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে এখানে লিখব না, তারপর ভাবলাম সবই যখন লিখি তখন এটাই বা বাদ থাকে কেন। তাই লিখেই ফেললাম।
Deletemon kharap hoye gelo lekhata pore
ReplyDeleteসেই। আমার মেজমামির সঙ্গে আলাপ হলে ভালো লাগত দেখতিস।
Deleteসঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এখনকার নয়, আশির দশকের।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ। আশির দশক ব্যাপারটা মেনশন করার জন্য আরও বেশি করে।
DeleteTomar didimar sei kore angul bhanga thakurer paa rao to abhibhabakheen hoye porlo.
ReplyDeleteধন্য তোমার স্মৃতিশক্তি রুচিরা। একেবারে ঠিক বলেছ।
DeleteSottii janina ki bolbo.
ReplyDeleteকিছু বলার দরকার নেই ইচ্ছাডানা। শোকের খবরের প্রত্যুত্তরে কিছু বলা সত্যি শক্ত।
Deletepost ta pore khub kharap lagchey. mejo-mamir deya mukhtor kaaner dul jora ta haater kachey thakle seta pore theko, aarki.
ReplyDeleteওরে বাবা, আমি এটা বলেওছি, আর তুমি মনেও রেখেছ শম্পা? আমারও ওই দুলটার কথা খবরটা পাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনে পড়েছিল জানো। কেন আনলাম না ভেবে মন খারাপ করছিল।
Deletemone achey karon amar mejo mami o amake ekta mukhtor kaner dhul diyechen. tai tumi jedin seta likhechile sedin arekta mil mil e tick diye rekhechilam :)
Deleteদেখেছ, মিলের পরিমাণ কি সাংঘাতিক রকম বেশি?
Deleteসবার মতন আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর কি বলব জানিনা। বাড়ি থেকে এত দূরে, আপনার খুব খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি।
ReplyDeleteসিরিয়াসলি। আর ক'দিন পরেই বিজয়ার ফোন করব সবাইকে। তখনকার কথা ভেবে আরও জঘন্য লাগছে।
DeleteJemon bhabe aponjon der kotha bolo...mone hoy sobike chini. ki ar bolbo..bhalo theko.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ পৌষালি।
DeleteKuntala Banerjee-er arekti signature post.. :) chalia jan! kajer chap e eti pora hoyni..ekhun porlam..
ReplyDeleteধন্যবাদ সৌমেশ।
Deleteআমারও ১পিস মেজমামী আছে। হাঃ হাঃ করে হাসেন, টুকরো টাকরা খোজ নেন; আর আমি বাড়ি এলেই আলু দিয়ে মাছের ট্যালট্যালে ঝোল আর পেঁপে'র ঘন্ট খাওয়ান। কি জানি? সব 'মেজমামী'রা বোধ হয় এমনটাই হন; প্রাণখোলা, দিলদরিয়া!
ReplyDeleteসেটাই হবে স্মৃতিলেখা।
Delete