ভগবতীর মা
ভগবতীর মা’কে যখন
কাজে রাখা হয় তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমাদের বাড়িতে সাধারণত কাজের লোকের
টার্নওভার রেট খুবই লো, কেউই চোদ্দ বছরের কম টেঁকেন না। তাই একদিন সকালে একমাইল
লম্বা রিং বাজার পর যখন ফোন তুলে মা হাঁপধরা গলায় বললেন, বাসন মাজছিলেন বলে আসতে
দেরি হল, তখন অন্য কোনও সম্ভাবনার কথা আমার মাথাতেই আসেনি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
“কেন চ-মাসি আসেনি বুঝি?”
“এসেছিল, চলে
গেছে।”
“সে কী, শরীর
খারাপ নাকি?”
“মেজাজ খারাপ।
দোষের মধ্যে শুধু জিজ্ঞাসা করেছি কাল বিকেলে আসনি কেন। তাতেই জ্বলে উঠে ‘আসিনি বেশ
করেছি, আর কোনওদিনও আসব না’ বলে হাতের ঝাঁটা ছুঁড়ে ফেলে, চটি পায়ে গলিয়ে ফটফটিয়ে
চলে গেল।”
তারপর শুরু হল
গরুখোঁজা। আমাদের ওদিকে তখনও কাজের লোকের এজেন্সির রমরমা শুরু হয়নি, মুখের কথাই
ছিল সম্বল। ভোরবেলা ফুল তুলতে গিয়ে পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে মা মনের দুঃখ জেঠিকে
বললেন, জেঠির বাড়িতে কাজ করতে এসে মিনতিদি খবর পেল, মিনতিদির মুখ থেকে খবর
এপাড়াওপাড়াঅলিগলি ঘুরে ভগবতীর মায়ের কানে গিয়ে পৌঁছল।
ভগবতীর মা তখন
সবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, চোরাপথে বাংলাদেশ থেকে আমাদের পাশের পাড়ায় এসে উপস্থিত
হয়েছে। ভগবতীর মা, ভগবতীর মা’র চিররুগ্ন স্বামী, আর ভগবতী। ভগবতীর আরও দুই বোনের
খবর পরে পেয়েছিলাম, কিন্তু তাদেরও নাম জানা হয়নি কখনও, তারা ভগবতীর মা’র বড় মেয়ে
আর ছোট মেয়ে হিসেবেই পরিচিত থেকে গেছে।
ভগবতীর মা’ও তখন
হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিল, একদিন সকালে মা’র সঙ্গে দেখা করতে এল। চেহারা দেখলে বোঝা
যায় পরের বাড়ি বাসন মেজে খাওয়ার পেশাটা নতুন। গায়ের রং কালো, কিন্তু চকচকে।
কুচকুচে কালো পর্যাপ্ত চুল টেনে খোঁপা করে বাঁধা, ছোট কপালের ওপরে সে কালো চুলের
রাশিকে জ্যামিতিক সূক্ষ্মতায় দ্বিখণ্ডিত করে লাল সিঁদুরের রেখা চলে গেছে।
“কী ভালো লোক রে
সোনা, যেমন পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, তেমন ভালো স্বভাব। আমি তো দুবেলা মনে মনে বলছি, যেন
টিঁকে যায় ঠাকুর।”
ভগবতীর মা টিঁকে
গিয়েছিল। পরের এগারো বছর শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত ধরে ভগবতীর মা দিনে তিনবেলা
আমাদের বাড়ির লোকের খেয়াল রেখেছে। যৎসামান্য মাইনের বিনিময়ে আমাদের থালাগেলাসবাটি
ঝকঝকে করে মেজেছে, খাটের তলা থেকে ঝাঁট দিয়ে আমার হারিয়ে যাওয়া আর্টিকেলের পাতা উদ্ধার
করেছে, রোজ সকালে ঠাকুমার ঘরের মেঝেতে বসে চা-রুটি খেতে খেতে নিজের চারপাশের
পৃথিবী সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত, গভীর মতামত প্রকাশ করেছে।
ভগবতীর মা’কে আমি
জ্ঞানত কারও নিন্দে করতে শুনিনি। আড়াপাড়ার লোকের তো নয়ই, যে গোটা সাতেক বাড়িতে কাজ
করতে যেত ভগবতীর মা, সে সব বাড়ির লোকদেরও না। ইন ফ্যাক্ট, আমরা জানতামই না ভগবতীর
মা আর কাদের বাড়িতে কাজ করতে যায়। মফস্বল পাড়ায় এ ধরণের তথ্যের অভাব কল্পনা করা
যায় না। ভগবতীর মায়ের যত গল্প ছিল নিজের তিন মেয়ে, মেয়েদের লেখাপড়া চাকরিবাকরি
বিয়েথাওয়া নিয়ে। মেয়েদের গল্প শেষ হয়ে সময় থাকলে তারপর নিজের ‘সুমতি’র গল্প।
‘সুমতি’
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বেশ পরের দিকে। বুধবার বিকেলে ভগবতীর মা এক্সট্রা দৌড়ে কাজ
করে, পারতপক্ষে কথা বলে না, চা বিস্কুট খাওয়ার কথা শুনলে জিভ কেটে বলে, “টাইম নাই
দিদি, সুমতিতে যাইতে হইব।” এক বৃহস্পতিবার সকালে কৌতূহল আর না চাপতে পেরে মা
জিজ্ঞাসা করে ফেললেন সুমতি ব্যাপারটা কী।
ঠাকুমার ঘরের
মেঝেতে উবু হয়ে বসে রুটি গোল করে পাকিয়ে চায়ে ডুবিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে
ভগবতীর মা ‘সুমতি’র রহস্য উন্মোচন করল। শ্রীরামপুরের কয়েকজন পরোপকারী দিদি মিলে
ঠিকে ঝিদের সমিতি খুলেছে, আশেপাশের তিনচারখানা স্টেশনের অন্তত শ’পাঁচেক কাজের
মহিলাকে ধরে সে সমিতিতে নাম লিখিয়েছে। বুধবার বুধবার সমিতির মিটিং বসে, সেখানে ঠিকে
ঝি এমপাওয়ারমেন্ট সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
রুটিতে আরেক কামড়
বসিয়ে ভগবতীর মা তার নব্যলব্ধ শিক্ষার নমুনা শোনাল মা’কে।
“তোমাগো বাড়িতে
আমার দশ বছর হইসে। আরও দশ বছর কাজ করুম, তারপর পেনশন নিমু।”
একবছরও কাটল না,
ভগবতীর মায়ের শরীরে রোগ বাসা বাঁধল। গরিবের ঘরে ও রোগ হওয়ার কোনও মানে হয় না।
গঙ্গার জলের মতো টাকা খরচ হয় এবং পরিণতি তাতে বদলায় না। রোগ ধরা পড়ার পরের একমাস
পর্যন্ত ভগবতীর মা মুখশুকনো করে কাজে এসেছিল। তারপর একদিন সকালে এসে সজলচোখে মায়ের
হাত ধরে বলল, “আর আসতে পারুম না দিদি। তোমাগো খুব অসুবিধা হইব জানি, কিন্তু শরীরে
আর দেয় না।”
নিজের ন্যায্য
পেনশনটা না নিয়েই যখন ভগবতীর মা শেষবারের মতো আমাদের বাড়ির সামনের বাঁধানো
রাস্তাটুকু হেঁটে পেরিয়ে গ্রিল গেট খুলে চলে গিয়েছিল, তখনও আমি বাড়ি ছিলাম না।
অসুখের খবর পেয়েছিলাম, কিন্তু সে খবর আরও পাঁচটা খবরের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল।
নিজের জীবন নিয়ে মত্ত হয়ে আছি, এমন সময় মা একদিন ফোন করে খবরটা দিলেন।
বেশি কষ্ট পায়নি
ভগবতীর মা, মাসপাঁচেক ভুগেছে। যাওয়ার আগে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের চারপাশের
মানুষের জীবন পরিপাটি গুছিয়ে দিয়ে গেছে। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা প্রত্যেকেই
শিক্ষিত, নিজের জীবন নিজে চালানোর যোগ্যতা তাদের আছে। ভগবতীর মায়ের বরের স্বাস্থ্যও
আগের থেকে অনেক ভালো। মা গিয়েছিলেন কাজে। বললেন, বাড়িটা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।
শান্ত, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, গভীর।
ভগবতীর মা ঠিক
যেমন ছিল।
চোখে জল এল । বাড়ির বিশেষণগুলো মনে রাখব শান্ত, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, গভীর।
ReplyDeleteমিঠু
ভগবতীর মা এক্স্যাক্টলি এই শব্দগুলোর কম্বিনেশন ছিল মিঠু। এত ভালো লোক আর জীবনে দেখব কি না কে জানে।
Deleteখুব সুন্দর লেখা, তবে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ReplyDeleteআমারও খুব মন খারাপ হয়েছে খবরটা শুনে।
Delete:(
ReplyDeleteSokkal sokkal eita pore golar kachh ta dhore elo. Dhur.
সরি বিম্ববতী। কিন্তু খবরটা এতই বিচ্ছিরি লেগেছে আমার যে না লিখে পারলাম না।
Deleteমন খারাপ হয়ে গেল দি। এইরকম কত কত ভগবতীর মা যে আমাদের জীবনটাকে কিরকম অজান্তে গুছিয়ে দিয়ে যায়, কি বলব। উনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
ReplyDeleteঠিকই বলেছ আবির। আমারও একই প্রার্থনা।
Deletekhub mon kharap hoye galo
ReplyDeleteআমারও খবরটা শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল মনস্বিতা।
DeleteMon kharap kora lekha. Tobe 'ভগবতীর মা' er kotha jananor jonyeo tomake Thanks.
ReplyDeleteভগবতীর মা ভীষণ ভালো আর ইন্টারেস্টিং মানুষ ছিলেন ইচ্ছাডানা।
Deleteissh emon koto bhagobatir maa, bon, bhai je amader rojkar jibon e samanya takar bodole service dichhey....nijeder niye byastotar madhe seta amader kheyal thakena. tobe tar e madhe emon didi-mashima rao achen jnara samiti banachhen/chalachen.....seta bhabte bhalo lage.
ReplyDeleteঠিক বলেছ শম্পা। আমি কিছুই করছি না, কিন্তু কেউ কেউ করছে, এটাই সান্ত্বনা।
Delete“তোমাগো বাড়িতে আমার দশ বছর হইসে। আরও দশ বছর কাজ করুম, তারপর পেনশন নিমু।” --- amader Kalpana di ke kotha ta shikhiye debo. jate sob bari te giye bole...
ReplyDeleteশেখানোর মতই কথা কিন্তু সুনন্দ।
Deleteei lekhata pore sari sari anekgulo mukh bheshe elo,bakuldi,sundari,bou ,behula,alhadi ,mayar ma ...era sabai bibhinno samay amader barite kajer mashi hoye esechen...choto theke baro hawar anek smritir madhye tukro tukro angsho enadero ache
ReplyDeleteঠিকই বলেছিস তিন্নি। আমাদের বড় হওয়ার এঁরা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
Deleteখুব ভালো হয়েছে লেখাটা, পড়তে পড়তে মনটা খারাপ হয়ে গেলো...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ সংহিতা।
DeleteShuru te i mone hoyechilo, shesh e giye koshto hobe. Predictable bolchi na...just that erom bhalo manush der golpo er shesh ta konodin i khub ekta bhalo hote dekhini. Ki jani, ei je Bhogoboi-r Maa beshi koshto pelo na, setai hoyto tar bhalo!
ReplyDeleteসুমনা, আমিও সেভাবেই ভেবেছি। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অন্যরকম কিছু হলে কষ্ট বাড়ত বই কমত না।
Deleteযাওয়ার আগে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের চারপাশের মানুষের জীবন পরিপাটি গুছিয়ে দিয়ে গেছে। -- eta khub joruri. Apnar erom lekha amar borabor-e bhalo lage.purota porlam.r janan dia gelam.
ReplyDeleteaaj 5th Sep..sikhhok dibosh gelo.ekta sundor lekha pele mondo hoto na.amar abar September masta onek karone boro bhalo lage..akhhorik orthe 'sweet September' rki..
ধন্যবাদ সৌমেশ। সেপ্টেম্বর আমারও বেশ ভালো লাগে। গরমের অত্যাচার কমে এসেছে, চারদিকে পুজো পুজো ভাব।
Deletemon chNuye gelo :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ পৌষালি।
Deleteআমাদের বাড়িতেও ১টা বান্টু মাসি ছিল। বেঁটে-খাটো চেহারা, মোটামুটি ফর্সা রং আর নাক-টা ঠিক 'উইনি দ্য পু'-এর মত! খাঁদা-কে খাঁদা, বোঁচা-কে বোঁচা বলতে নেই; তাই 'বান্টু মাসি'! মুখে ১টাও কথা নেই, ১টি দিনও কামাই নেই; আর কোন জিনিস ভুলভাল জায়গায় রাখার উপায় নেই। আমার ভাই ছিল খুব অগোছালো; জামা-জুতা কোথায় যে রাখত তার কোন ঠিক নেই। হয়তো স্কুলে যেতে হবে, এদিকে স্কুলের জামা মাটিতে গড়াচ্ছে; বান্টু মাসি'র চোখে পড়লেই চিত্তির! সঙ্গে সঙ্গে সেটা কাচা হয়ে যাবে! তারপরে কাদো-কাটো; কিন্তু ভিজে জামা পরে স্কুলে যাও। সেই মাসি হঠাতই ১দিন আসা বন্ধ করল; তারপর ১ বছরের মাথায় খোঁজ পাওয়া গেল যে মাসি রাজরোগে (ক্যান্সার) মারা গ্যাছে। ১টা অদ্ভুত দলা-পাকানো অনুভূতি হয়েছিল।
ReplyDeleteএঁরা যে কতখানি আপনার লোক হয়ে ওঠেন সেটা হয়তো আমরা নিজেরাই টের পাই না। চলে গেলে মনে পড়ে।
DeleteKuntala tomar lekhata pore bhalo o laglo r mon kharap o holo
ReplyDeletebhalo laglo karon tumi aemon onek manusher kotha mone koriye dile jader niye onek omulyo sriti achhe
mondo lagar karon ta nahoy ...
ami onek din agey amader barir amon e ekjoner kotha likhechilam, baba bohudin por kagojta khuje peyeche
tomar onumoti chai, onar ebong r o kichu aemon loker kotha abar likhte chai, tobe lekhar kothata ei lekhata porei mathay eshechhe, tai amay janiyo
কী সাংঘাতিক, আমার আবার অনুমতি কীসের রাই? অবশ্য লিখবেন, এই আমি পড়ব বলে হাঁ করে বসে রইলাম।
Delete