চার



গত ক’সপ্তাহ ধরে অবান্তর আর আগের মতো দৌড়ে চলছে না। গড়াচ্ছেও না, বেশ খোঁড়াচ্ছেই বলা চলে। অফিস আগের মতোই আছে, নাওয়াখাওয়া আগের মতোই আছে, বলার মতো বদল ঘটেছে শুধু যাওয়াআসায়। এখানে হেলতেদুলতে ফাঁকা ট্রামে জানালার পাশে বসে অফিস যাই, আগেরদিন ডিনারে বেশি খাওয়া হয়ে গেলে পরদিন সকালে মাঝে মাঝে হেঁটেও যাই। ইন ফ্যাক্ট, হেঁটে গেলে অফিস পৌঁছতে কম সময় লাগে। খাঁ খাঁ রাস্তা, ফুরফুরে বাতাস, মাঝে মাঝে দিবাস্বপ্নভঙ্গকারী সাইকেলের টুং টাং বেয়াড়া বেল।   

দিল্লির ঘেমো, গিজগিজে রাস্তায় অটো চেপে দু’বেলা ছোটাছুটি যে ব্লগের স্বাস্থ্যের পক্ষে এত ভালো কে জানত।

জানলাম তারপর ভাবলাম উপায় কী করা যায়। উপায় যে কিছু করতেই হবে তা নয়, কিন্তু পোস্টহীন দিন, বড় বাজে কাটে। মূলত অপরাধবোধ, তাছাড়া চোরাগোপ্তা ভয়। আর যদি কেউ না পড়ে? যদি মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়, আর ফিরে না আসে? জানি এ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কিউট কিছু নেই, নিজের জন্য লেখাতেই আসল মাস্তানি। কিন্তু আমাকে একজন একবার বলেছিল, মাস্তানি কেবল একরকমের হয় না। ভিতু দোকানদারকে ছুরির আগায় চমকে তোলাবাজি একরকমের মাস্তানি, আবার সমস্ত মুখোশ খুলে ফেলে, নিজের সমস্ত ভয়, দুর্বলতা, ক্ষুদ্রতা নিয়ে আয়না এবং পৃথিবীর চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানো, সেও আরেক রকমের মাস্তানি।

এই আমি আমার হাতের সব তাস তোমাকে দেখালাম, এর পর যা হয় হবে, আমি প্রস্তুত।

মাথার মধ্যে গোটাকতক ঝগড়ুটে গলাকে পুরে নিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করি। একজন বলে সবটাই আমার দোষ। ছোটবেলায় স্কুলে নোটখাতা নিয়ে যেতে ভুল হয়ে গেলে সেজদিদিভাই যেমন করে বকতেন, এর ভঙ্গিটাও অবিকল তেমন। “সকালে খেতে ভুলে গিয়েছিলে? স্নান করতে ভুলে গিয়েছিলে? টিফিন আনতে ভুলে গেছ কি? যাওনি তো? তবে? শুধু লেখাপড়ার ব্যাপারেই শুধু ভুল আর ভুল আর ভুল?”  

সারাদিনের শেষে যখন হাল ছেড়ে বিছানায় ঢুকি তখন মাথার ভেতর এই গলাটা সবথেকে জোরে চেঁচায়। স্নান করেছ? খেয়েছ? ইন্টারনেট ঘাঁটার সময় হয়েছে? সে তো হবেই। কেবল লেখারই সময় হয় না।

অন্য গলাটার মায়ামমতা বেশি, কথা শুনে মনে হয় আমাকে সে পছন্দই করে। পাশে বসে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে, খুব চাপ পড়েছে?

“নাঃ, সবই তো হচ্ছে, চাপ আর কোথায়।”

মিনিট খানেক আগের বকুনিটা তখনও মাথায় ঘুরছে। ভালো গলা আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। বলে, অত চাপ নিয়ো না, দরকার হলে মাসকয়েকের জন্য তুলে রাখো।

আমার মাথায় ঢোকে না। কী তুলে রাখব? কোথায় তুলে রাখব?

অবান্তর। মাসছয়েক না হয় বন্ধই থাক। কিছুই তো পালিয়ে যাচ্ছে না। হাতের কাজগুলো একটু গুছিয়ে নাও, তারপর আবার না হয় লিখো।

আমি চুপ করে শুনি। এই গলাটাও আগে শোনা আমার। কোথায়...কোথায়...ধাঁ করে মনে পড়ে যায়। মেজমামার গম্ভীর গলা স্পষ্ট কানে আসে, “খেলার সময় সারাজীবন থাকবে, পড়ার সময় একবার ফুরিয়ে গেলে কেঁদে কূল পাবে না।”

পাশ ফিরে শুই। চোখ বুজে ঘুমের ভান করে দুটো গলাকেই তাড়াবার চেষ্টা করি। মনে মনে দু’হাজার নয়ের সেপ্টেম্বর মাসের কথা ভাবি। একটা লিভিং রুম, একটা ফুটন, ফুটনের একপাশে আমি। ফিরে এসে দু’হাজার তেরোর সেপ্টেম্বর মাসের আমার জীবনটার ওপর চোখ বোলাই। ছোটবেলায় টেলিগ্রাফ কাগজের রবিবারের ম্যাগাজিনে দুটো ছবির মধ্যে ছ’টা মিল খুঁজে বার করার একটা খেলা খুব প্রিয় ছিল আমার, দুটো সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেই মিল খোঁজার খেলাটা খেলি।

নেই। মানে, দুটো সেপ্টেম্বরের দুটো জীবনের মালিকই আমি, কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই মিলটুকু ছাড়া আর কোনও মিলের চিহ্ন নেই কোথাও। পরিবেশ, পরিস্থিতি, বন্ধুবান্ধব, চেহারা, মন---সব বদলে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুটো ছবিই মাথা থেকে মুছে ফেলতে যাব, এমন সময়ে আরেকটা জিনিসের দিকে নজর পড়ে।

অবান্তর। তখনও নামগোত্রআকারহীন একটা সদ্যোজাত ব্লগস্পট অ্যাকাউন্ট, ফ্রি-তে খোলা যায় বলে খোলা। ব্যাপারটা খাব না মাথায় দেব, সে নিয়ে ধারণা নেই একবিন্দু। আর এখন, চার বছর পর? অবান্তর আমার খাটের ওপর ধাঁই ধাঁই করে লাফাচ্ছে, ফ্রিজ খুলে যখনতখন ঠাণ্ডা জলের বোতল গলায় উপুড় করছে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সব প্রতিবেশীর কলিং বেল বাজিয়ে দিয়ে পালাচ্ছে, ঘরের সদ্য মোছা মেঝের ওপর দিয়ে স্পষ্ট ছোট ছোট পায়ের ছাপ ফেলে দৌড়চ্ছে।  

যারা বলে অবান্তরকে ক’দিনের জন্য ছেড়ে দাও, তারা আসল ব্যাপারটা জানে না বলেই বলে। দুটো লোকের সম্পর্কের মধ্যে সবথেকে খারাপ ব্যাপার যেটা ঘটা সম্ভব, সেটা ঘটে গেছে আমার আর অবান্তরের ভেতর। আমার হাতের সব তাস অবান্তর দেখে ফেলেছে। ও জানে আমি আর ওকে ছাড়ার জায়গায় নেই। ছাড়াছাড়ি হবে, যেদিন অবান্তর আমাকে ছাড়বে।  

হ্যাপি বার্থডে, অবান্তর। উইশ ইউ মেনি, মেনি, মেনি হ্যাপি রিটার্নস্‌ অফ দ্য ডে।


Comments

  1. Happy birthday Abantor! :) aaj ker din-e comment kartei hoy! Anek anek shubhechha roilo :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ কোয়েল।

      Delete
  2. বস্‌, ছাড়া যায় না। তবে অবান্তর দিব্যি দৌড়চ্ছে। তোর সঙ্গে ওর একটু খিটিরপিটির হচ্ছে নাহয়, কিন্তু আমরা তোদের নিয়ে বেশ খুশি আছি।

    ও বড় হচ্ছে তো। চারবছর হল। তুই একটু ব্যস্ত থাকলে বোঝার বয়স ওর হয়ে গেছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হার্টিলি এগ্রি করলাম অভিষেক-এর সঙ্গে (যেটা সাধারণতঃ বেশ রেয়ার টাইপের ঘটনা)। সব ব্লগ-এরই এরকম একটু গ্রোথ প্যাংস আসে, ওটা কিছুনা। এই তো অবান্তর পড়ার জন্য প্রতিদিন কত পাঠক-পাঠিকা মুখিয়ে থাকে, কুন্তলা, সেটা কি কিছু কম নাকি?

      লং লিভ অবান্তর।

      Delete
    2. অভিষেক, কৌশিক, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. ওমা, অবান্তরও আমার মত Virgo!
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার জন্মদিনও কাছাকাছি তাহলে মিঠু? হ্যাপি বার্থডে।

      Delete
  4. char bachar ! ki darun byaper :-) aj ektu bhalo kawa dawa hok tahole.ar akta darun post !

    ReplyDelete
    Replies
    1. খাওয়াদাওয়া ভালোই হয়েছে, পোস্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সরি।

      Delete
  5. lekha ta pore khub bhalo o laglo abar mon o kharap holo (sandeho hoi nije marattok faki marchhi bole hoito)... ami tomar Abantor ke bes choto theke dekhchhi... jokhon engraji horofe likhte, saptahiki, shonirobi, quiz, emonki 'chenen naki' o chhilo na tokhon theke..
    khub bhalo bondhu hoye gechho.. ekhon r chhere jaoar upai nei.

    by the way, kemon lagchhe boloto saint zita society? library theke enechhi... kintu ekhon mathar upor onek kota deadline... pora shuru o korte pari ni..

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই, অনেকদিন হল গোবেচারা।

      সেন্ট জিটা সোসাইটি ভালোই লাগছে। রুথ রেন্ডেলের লেখা আমার ভালো লাগে। তবে "দেড় ঘণ্টা লাগবে জট পাকাতে, দেড় ঘণ্টা ছাড়াতে" গোছের গল্প মনে হয়। এতক্ষণে একটা খুন হয়েছে।

      Delete
  6. :)) JoNmOdInEr OnEk OnEk ShUbHeCcHa :))

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ পরমা।

      Delete
  7. goto porshu Sunil Ganguly-r jonmodin gelo.Onar ekta interview er onsho kono channel e dekchilam..sekhane onake bolte sunlam 'sob kichu ki r lekha jay...kichu jinish dekhi...seta nia onek bhabna chinata chole...seta lekhar joggo kina bhabte hoy...tarpor onek bibechona kore seta nia lekha suru hoy'. amar besh mone dhorechilo kothagulo. Apnar ai blog prosonge boli...apni o chinta korben na...roj pate dewar moto ranna na o hote pare...tobe solpo biroti-r pore suswadu r upadeyo ranna sobai pochondo kore...tai apnar lekhar jara bhokto...tara thik e Abantor ghure dekhe jabe...tobe,lekhar jonno na likhe nijer bhalolagar jonno likhun...dekhben Abantor ro fule fepe utheche bhokte..
    R Abantor-er o jonmodin September mas e...besh mil pelam kichute..bha!!good good!!subho jonmodin..

    ReplyDelete
  8. বাব্বা! চার হয়ে গেল? বলেন কি? এই তো সেদিন মাথার পাশেরদিকে "Bored grad student" লেখা টিপ পরা অবান্তরকে এইটুকুনি দেখতে গেলাম, আমেরিকায় জন্মে তখনও সে পুরোপুরি বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি। আর এর মধ্যেই চার! জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল অবান্তরের জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ সুগত। ঠিকই বলেছেন, ঘড়ি তো নয়, ঘোড়া।

      Delete
  9. happy happy happy birthday Abantor!

    ReplyDelete
  10. এই যা দেরি হয়ে গেলো... :(
    Happy Birthday 'ABANTOR'.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দেরি কীসের সংহিতা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  11. Happy birthday Abantor!Deri hoye galo :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ মনস্বিতা।

      Delete
  12. aarey baah! dekhtey dekhtey 4 bochhor! shubhechha roilo. aaro onek gulo blog birthday celebrate kortey chaai. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ সুজয়িতা।

      Delete
  13. Arre darao. Age college jak tarpor na tumi empty nester hobe. Onek shubhechha roilo.

    ReplyDelete
  14. sob pori kintu sobgulote likhe uthte parina..ki bhalo lekha porar jayga..aro erokom onek sundor lekha asuk..Suvo jonmodin ektu derite holeo onek suvechaa roilo

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সুমনা।

      Delete
  15. Oneeeek Subhechha !!!!!

    kintu songe ektu monkharapo, kije hoechhe, okaj korte okaron byasto hoe pore thik thak kaj gulo somoimoton korai hochhena, noito 9th september e Abantor miss kore gelam. :-( ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ইচ্ছাডানা, মিস করেছেন তো কী হয়েছে, দেখছেন তো আমি নিজেই আজকার অর্ধেক দিন অবান্তর মিস করে যাচ্ছি। একদম মনখারাপ করবেন না। আপনার শুভেচ্ছার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  16. Abantar Shubho Jonmodin.....onek din bade fire Elam.....majhe jibon juddhe ektu joriye porechilam.....Kintu mone Porto shob shomoy ....ekshathe shob Kota na pora post pore fellam....abantar tumi na thakle amar withdrawal symptom hobe....ebar tumi bojho....

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা রণিতা, না না, উইথড্রয়াল সিম্পটম অতি ভয়ানক বস্তু, সে হয়ে কাজ নেই। শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  17. Obantor er jonmodin e onek onek valolaga, aar onek onek suvechcha...deri kore fellam...Obantor dine dine aro swashthyoban hok. valo thakuk. :)
    Obantorer swatta bahee keo onek onek valobasa.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সাহানা।

      Delete
  18. গুরু তুমি চাপ নিও না। অবান্তর আছে, থাকবে।আমরাও আছি, থাকব। কদিনের ব্যস্ততায় এপাড়ায় আসিনি, কমেন্টও করা হয়নি। আজকে সময় নিয়ে বসে সবকটা পোস্ট পড়ব ভাবছিলাম। প্রথমেই এটা পড়ে ভাললাগামেশানোমনখারাপ হল। এর বেশি বোঝাতে পারব না।

    ভাল থেকো। অবান্তর যুগ যুগ জিও।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ প্রিয়াংকা। খুব ভালো লাগল তোমার কমেন্ট পড়ে।

      Delete
  19. শুভ জন্মদিন! 'Oatmeal' এর তৈরি করা 'Blerch' এর গল্প জানো তো? সেই বস্তুটি মাঝে মধ্যে চেপে বসে বলেই অমন এক্টু ল্যাদ খাচ্ছো এই আর কি... আবার গাড়ি রাজধানী হবে, চাপ নিও না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Blerch-এর গল্প আগে জানতাম না, এখন জানলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  20. Ei jah miss hoye galo...Belated Happy Birthday.

    ReplyDelete

Post a Comment