খুড়োর বচন



ক্রাইসিস, তা সে যে ধরণেরই হোক না কেন, লক্ষ লক্ষ লোকের রুজিরুটি যেমন কাড়ে, তেমন লক্ষলক্ষ লোকের রুজিরুটির জোগানও দেয়। একএকটা ক্রাইসিস ঘিরে শতশত সেমিনার বসে, হাজারহাজার পেপার লেখা হয়, লাখলাখ ইন্টারভিউ দেওয়া-নেওয়া হয়। অবশ্য ক্রাইসিসই যে হতে হবে তা নয়, যে কোনও স্ট্রাকচারাল পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াতেই এ জিনিস ঘটে। যেমন ধরা যাক উনিশশো একানব্বইয়ের ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার। এখন ব্যাপারটা জলভাত হয়ে গেছে বলে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে আর কাগজে কাগজে সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে না, কিন্তু আজ থেকে বছর দশেক আগেও ইকনমিক লিব্যারালাইজেশনের সুফলকুফল নিয়ে ইউনিভার্সিটির ধাবায় ধাবায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গলাবাজি চলত। রংবেরঙের বিলিতি গাড়ি চড়তে পারার বেনিফিট, আর সস্তা আমদানির মুখে পড়ে দেশী ব্যবসাদারের নাভিশ্বাসের কস্টের অ্যানালিসিস। লাভক্ষতির মাপজোক নিয়ে প্রায় হাতাহাতি। নীলগিরি ধাবায় এক স্বর্গীয় বিকেলে এমনই এক বন্ধুত্বপূর্ণ হাতাহাতির আড্ডায় বসে শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে তীর্থদা বলেছিল, “ভালোমন্দ কী হয়েছে জানি না বস্‌, কিছু ইকনমিস্টের সারাজীবনের খাওয়াপরার চিন্তা ঘুচেছে।”

এর থেকে বেশি সত্যি কথা আমি জীবনে কমই শুনেছি।

এখানে পায়ের তলায় সর্ষে বেঁধে এই যে সেমিনার শুনে বেড়াচ্ছি, তাদের সবারই মূল কথা ক্রাইসিস। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ক্লাইম্যাটিক। গায়ের চামড়া নেহাৎ গণ্ডারের থেকেও মোটা, তাই সে সব সেমিনার শোনার পরেও রোজ রাতে বাড়ি ফিরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারি। ভয়াবহ সব স্ট্যাটিসটিকস, বীভৎস সব ধ্বংসের ছবি দেওয়ালজোড়া স্ক্রিন থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। রিফিউজি বাড়ছে, রেনফরেস্ট কমছে, মাইনে চড়ছে, গ্রোথ ফোরকাস্ট পড়ছে। দেখতে দেখতে একএকজনের একএকরকম প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ ফেসবুক স্ট্যাটাস চেক করে, কেউ ভয়ে সিঁটোয়, কেউ রুমাল বার করে চোখের জল মোছে। ওয়াটার ক্রাইসিস এবং সে ক্রাইসিস নিয়ে বিশ্বজোড়া পলিটিক্‌স্‌ নিয়ে দিনভর চর্চার পর আমার এক অতিসংবেদনশীল বন্ধু সেদিন বলেই ফেলল, “মে বি ইট্‌স্‌ নট রাইট টু ব্রিং আ চাইল্ড ইন দিস মেস্‌।”

এই সর্বগ্রাসী প্যানিকের আবহাওয়ায় তাই যখন এঁদের দেখা পাই, সেটা জ্বোরো কপালে জলপট্টির মতো কাজ দেয়। এঁরা সকলেই আমাদের ক্লাসে বক্তৃতা দিয়েছেন, সে ছাড়া এঁদের আর কোনও ক্যাটেগরিভুক্ত করার উপায় নেই। যদি না ধরা হয় যে এঁদের সকলেরই বয়স আশির ওপর, এঁরা কেউই বক্তৃতা দেওয়ার সময় পাওয়ার পয়েন্ট (বা লেটেক, বা প্রেজি) ব্যবহার করেন না, এঁরা সকলেই পলিসির থেকে মানুষের ওপর বেশি আস্থা রাখেন, আর এঁরা সকলেই ক্রাইসিসের কথা উঠলে মুচকি মুচকি হাসেন।

“হোয়েন ইউ রিচ মাই এজ, ইউ লার্ন টু লিভ উইথ ক্রাইসিস।”

বলেছিলেন যিনি, তাঁর চেহারাটা সান্টাক্লজের গোঁফদাড়িছাঁটা যমজ ভাইয়ের মতো। হাসিখুশি লাল আপেলের মতো মুখ, দশাসই শরীর কোটপেন্টেলুনটাই দিয়ে ঢাকা। মিটিং বুঝে আমাদের ড্রেসকোড বদলায়---এঁরা লোকসমক্ষে ফর্ম্যাল ছাড়া আর কিছু পরেননি কখনও, বেঁচে থাকতে পরার কল্পনাও করেন না। স্মার্ট ক্যাজুয়াল বস্তুটা যে কী এঁরা তা জানেনই না। (আমরাও জানি না স্মার্ট ক্যাজুয়াল খায় না মাথায় দেয়, তবু পরি।)

নিজের বয়সের গাছপাথরের হিসেব দিতে গিয়ে খুড়ো বললেন, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। তাঁর বাবামা দু’খানা বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, তাঁর ঠাকুরদাঠাকুমা দু’খানা বিশ্বযুদ্ধ + বাল্‌কান যুদ্ধ + তুর্ক-ইতালি যুদ্ধ সঅঅব দেখেছেন। কাজেই ক্রাইসিস কাকে বলে সে তাঁর বিলক্ষণ জানা আছে। আরও জানা আছে, ক্রাইসিস থাকা মানেই তার সমাধানও থাকা। অনেক ক্ষতি হবে, অনেক প্রাণ যাবে, আমিআপনি মরে ভূত হয়ে যাব---কিন্তু ক্রাইসিসও থাকবে না।

এক জীবনে অনেক দেখেছেন খুড়ো। যা দেখেছেন, আমার মতে তার কাছে একটা বিশ্বযুদ্ধ কিছুই না। জন্মেছিলেন ফ্রান্স-জার্মানির সীমান্তে একটা ছোট্ট গ্রামে। পড়তে গিয়েছিলেন সীমান্ত ডিঙিয়ে ফ্রান্সে। এখন ই.উ. বলতে লোকে যা বোঝে, ব্যাগ থেকে একটিবারও পাসপোর্ট না বার করে যত অনায়াসে টপকে যায় একের পর এক ঘুমন্ত বর্ডার চেকপোস্ট, তখন সে রকমটা ছিল না। যুদ্ধের স্মৃতি তখনও অসুবিধেজনক রকম দগদগে। খুড়োর ক্লাসের অনেক ছেলেই তখন ফ্রান্সের এমন সব গ্রাম থেকে এসেছিল যেখানে কয়েক বছর আগে জার্মান সেনারা গ্রামশুদ্ধু লোককে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে।

খুড়োর গলায় এই এত বছর পরেও অপরাধবোধ স্পষ্ট ধরা পড়ে। তখন যদি কেউ তাঁকে বলত, আর মোটে ষাট বছরের মধ্যে ফ্রান্স-জার্মানি একই পার্লামেন্টে এগ্রিকালচারাল সাবসিডি নিয়ে গলা ফাটাবে, একই বিদেশনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে, দু’দেশের লোক একই টাকা নিয়ে ক্রিসমাসের বাজার করতে যাবে---আর এই সমস্ত কাণ্ডকারখানা সত্যি হওয়ানোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হবেন...তিনি...

“ইট ওয়াজ আ ড্রিম।”

হেসে ওঠেন খুড়ো। একমুহূর্তের জন্য মুখের ওপর থেকে ধুরন্ধর কূটনীতিজ্ঞের মুখোশটা সরে গিয়ে কৈশোর-পেরোনো মুখচোরা ছাত্রটা বেরিয়ে পড়ে। বিদেশবিভূঁইয়ে পূর্বপুরুষের পাপের ভার মাথায় করে মুখ লুকিয়ে ঘুরছে। টেবিলের অন্যপ্রান্ত থেকেও বেশ বোঝা যায়, সেই মুহূর্তে নিজের জীবন রিওয়াইন্ডে চালিয়ে নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছে তাঁর। যা ঘটেছে, তা সত্যিই কি ঘটেছে?

এইখানেই বাকিদের থেকে খুড়োদের অ্যাডভান্টেজ। মানতেই হবে অ্যাডভান্টেজটা নিতান্তই সময়জনিত এবং খুড়োর তাতে কোনওই কেরামতি নেই, কিন্তু তাই বলে তো সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। খুড়ো ক্রাইসিস দেখেছেন, মানুষের অমানুষিকতার নিকৃষ্টতম উদাহরণ দেখেছেন, স্বপ্ন সত্যি হতে দেখেছেন। উপন্যাসের পাতায় নয়, নিজের জীবনে। ফ্রেঞ্চের গরিমা ভুলে ইংরিজি শিখেছেন, সোয়াজিল্যান্ডের রাজার সঙ্গে ক্যারাওকে গেয়েছেন, অভিজ্ঞতা দিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন হাজার পুরুষকার আর লক্ষ উদ্যমের পরেও শেষ চাল চেলে যেতে পারে অদৃষ্ট।

“ইয়োর কেরিয়ার মেনলি ডিপেন্ডস্‌ অন নট বিয়িং অ্যাট দ্য রং প্লেস অ্যাট দ্য রং টাইম।” বক্তৃতার শেষদিকে একগাল হেসে বলেছিলেন খুড়ো। যাঁর কেরিয়ারের ছিটেফোঁটার স্বাদ পেলে ঘরের বাকি লোকেরা আনন্দে পাগল হয়ে যাবে, অন্তত আমি তো যাব।

দুঃখের বিষয় সেমিনার দেওয়ার মতো খুড়ো পাওয়াই মুশকিল। প্রতি পঞ্চাশটা সেমিনারে মেরেকেটে এক কি দু’জন খুড়ো জোগাড় করা যায়। বাকি সব লাইন দিয়ে স্ট্যাটস্‌, চার্ট, হিস্টোগ্র্যাম, বুলেটস্‌, অ্যানিমেশন, প্যানিক। এত খেটেখুটে সবাই পিপিটি বানায় (বা লেটেক, বা প্রেজি), সেমিনাররুমের দরজা ঠেলে বেরোনোর তিনমিনিটের মধ্যে মাথা থেকে সব হাওয়া। ম্যাজিকের মতো।

শুধু খুড়োদের বলা গল্পগুলো মনে থেকে যায়। ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজের খুঁটিনাটি---গল্পের পুরিয়ার মধ্যে করে সোজা চালান হয়ে যায় মগজের ভেতর। আর গিয়ে সারাজীবনের মতো সেখানেই আরাম করে গ্যাঁট হয়ে বসে। সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং, গ্রুপ ডিসকাশন আর ফিডব্যাক সেশনের কোলাহলের সমুদ্রে শুধু একটিই কাজের কথা ভেলার মতো ভেসে থাকে, “ইউ হ্যাভ টু লার্ন টু লিভ উইথ ক্রাইসিস।”

কিন্তু শেখাবে কে? মোস্ট প্রব্যাবলি সময়। সাধে কি আমার বুড়ো হতে তর সয় না?
      

Comments

  1. Onek bochor age ekta kotha shunechilam....crisis makes you more productive....tomar lekha pore mone pore gelo.....ar mone porlo thakuma,ma shoshur moshai e mukhe shona desh bhager shei shob golpo ja shunle mone hoy je amra eto kichu pay oar poro Oder moton keno hote parina..darun laglo....tomar lekha porle mone hoy ke jeno amar moner kotha gulo shajiye likhe diyeche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ রণিতা। আমি তোমার সঙ্গে একেবারে একমত। সবকিছু একেবারে না চাইতেই নাকের ডগায় এসে পড়েছে বলে এত "গেলাম গেলাম" ভাব আমাদের। What does not kill us makes us stronger--- এতে আমি সেন্ট পারসেন্ট বিশ্বাস করি।

      Delete
  2. ki bhalo lagle pore .erakam aro chai

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ তিন্নি। খুড়োকে যদি দেখাতে পারতাম রে, দু'হাজার বছরের পুরোনো ক্যাথিড্র্যালের থেকে কোনও অংশে কম দর্শনীয় নন।

      Delete
  3. kemon "ernest hemingway" gondho ashchey :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি বলার পর মনে হচ্ছে শম্পা, একটু-আধটু মেকআপ দিলে খুড়োকে হেমিংওয়ে বলে চালানো শক্ত হবে না।

      Delete
    2. by EH i meant both khuro and your post :)

      Delete
    3. সর্বনাশ করেছে।

      Delete
  4. crisis to sorbotro..jodi dekhen amader life is also a combination of different stages of crisis...so get busy living or get busy dying (google na kore cinemar nam bolte parle barti hattali :) )

    ReplyDelete
    Replies
    1. নাঃ, হাততালি পাওয়া গেল না এ যাত্রা।

      Delete
    2. yeh tow shashank karagaar laag raha hay :)

      Delete
    3. এই যাহ্‌। এত কমন উত্তর কে জানত।

      Delete
  5. খুড়োর কিছু অ্যাট্রিবিউট- বৃদ্ধ, সৌম্যদর্শন, অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ, ভালো শিক্ষক। মানে একেবারে অ্যালবাস ডাম্বলডোর।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক ঠিক, এই তুলনাটার কথা আমার মাথায় আসেনি দেবাশিস। ডাম্বলডোরের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে অবশ্য আমাদের খুড়োকে একটু লম্বা আর অনেকখানি রোগা হতে হবে। কিন্তু বহিরঙ্গের এই সব খুচখাচ অমিল বাদ দিলে অন্তরঙ্গের মিল দুজনের প্রচুর, ঠিকই ধরেছেন আপনি। এই মুহূর্তে আমার যে মিলটার কথা মনে পড়ছে, সেটা হচ্ছে রসবোধ। অনেক ঘাটের জল খেয়ে তীরে উঠে, সন্তরণরত বাকি সবার বালখিল্যপনা দেখলে যে রসবোধটা আপনি জন্মায়, দুজনেরই সেটা প্রভূত পরিমাণে আছে।

      Delete
  6. ei ta paka kotha..eirakam khuro pele mon die lecture shunteo mosti lage...kintu pai oi ppt habijabi...seminar sesh hotei matha theke sob hawa..

    ReplyDelete

Post a Comment