আমার বন, আমার বাড়ি
সারাসপ্তাহ
স্টাডি ট্রিপের পর জনগণের মধ্যে বাড়ি ফেরার উৎসাহ দেখার মতো থাকে। বাড়ি ফেরা মানে
বনে ফেরা। আসল বাড়ি তো সকলেরই লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে, এক কিংবা তারও বেশি সময়রেখা
পেরিয়ে।
তাই
বনই সই। যদিও বনের বাড়িকে নিজের ভাবার কোনও কারণই নেই। দেওয়ালের আর্ট ইচ্ছেমতো
বদলানোর উপায় নেই, রাস্তার ধারে অচেনা জানালায় লালনীল ফুলের টব দেখে হিংসেয়
জ্বলেপুড়ে মরা ছাড়া গতি নেই। খালি মনে মনে দিল্লির বারান্দায় ফুলের ছবি সুপারইমপোজ
করে খুশি হওয়া। অবশ্য এখানেও বারান্দাতে দু-একটা টব এনে বসালে ফ্রাউ বার্শ তেড়ে
আসবেন না, কিন্তু মন চায় না। কী হবে সাজিয়ে, এই তো ফেরার সময় হয়েই এল।
তবু
বনে ফেরার জন্যই সবাই মুখিয়ে থাকে। ট্রিপের শেষদিনের শেষ লেকচারে টেবিলের তলায়
লুকিয়ে লুকিয়ে ঘড়ি দেখে। সারারাস্তা ধরে বাসে গলা ছেড়ে গান গায়, মাথার ওপর দিয়ে
হুশ্হুশ্ করে উড়ে যাওয়া সাদাসবুজ বোর্ডে লেখা নম্বর দেখে প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
“গাআআআআইজ্, বন ইজ ওনলি টু হান্ড্রেড কিলোমিটারস অ্যাওয়েএএএএএ...” অমনি বাসের
ভেতর কোরাসকণ্ঠে উল্লাস, চটাপট হাততালি।
আমি
হাবেভাবে প্রকাশ করি না, নির্মোহ যোগী টাইপের মুখ করে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি,
কিন্তু মনে মনে আমারও বনে ফেরার তর সয় না। (যোগীর কথাই উঠল যখন এই সুযোগে চট করে
একটা অপ্রাসঙ্গিক গল্প বলে নিই---আমি ইন্ডিয়ার লোক এবং যোগব্যায়ামের ক্লাসে
বাকিদের থেকে বেশিক্ষণ পদ্মাসনে পা মুড়ে বসে থাকতে পারি দেখে একজন একবার খুব
সিরিয়াস মুখ করে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কুন্তলা, আর ইউ আ ইয়োগি?” ভীষণ দুঃখ পেয়ে
মাথা নেড়ে না বলতে হয়েছিল। ইয়োগি হতে পারলে তো হয়েই যেত, কিন্তু দিনে দু’ঘণ্টা
ইউটিউব না দেখলে যার স্যান্ডউইচ হজম হয় না তার ও দিকে অ্যাম্বিশন না থাকাই ভালো।)
বেশিরভাগ
ট্রিপ থেকে ফিরতে ফিরতেই রাত হয়ে যায়। সারাদিন সেমিনার, শেষ সেমিনার থেকে বেরিয়ে
বাসে চেপে বন্। একটা চব্বিশঘণ্টার দিনকে নিংড়ে কীভাবে সোয়া চব্বিশঘণ্টা আদায় করে
নেওয়া যায়, সেটা এদের থেকে ভালো কেউ জানে না। সিরিয়াসলি, জার্মানদের থেকে যদি একটা
জিনিস শেখার থাকে তাহলে সেটা অরগ্যানাইজেশন। জার্মান অরগ্যানাইজেশনের ব্যাপারই
আলাদা। আমি কমবেশি ছ’মাসের হিসেব করে এসেছিলাম, এসে দেখলাম ওটা আসলে ছ’মাস নয়, ওটা
আসলে টোয়েন্টি এইট উইক্স্। আর এই টোয়েন্টি এইট উইকসের প্রতিটি উইকে কী করা হবে, কোন
লেকচার শোনা হবে, কোথায় যাওয়া হবে, কোন কোন রেস্টোর্যান্টে ডিনার করা হবে, এমন কি
সে সব ডিনারে কতগুলো এবং কী কী ভেজিটারিয়ান ডিশ থাকবে, সে সব পর্যন্ত বানান করে
ফোল্ডারে লেখা আছে।
ফোল্ডারে
লেখা ছিল রাত ন’টায় বনে ফেরা হবে, বাস এসে যখন আমার বাড়ির স্টপে দাঁড়াল তখন
বেজেছে ন’টা বেজে ছয়। আমিও জার্মানদের দেখাদেখি প্ল্যানিং করে রেখেছিলাম, বাস থেকে
নেমে মোড়ের সুপারমার্কেট থেকে ডিনারের স্যান্ডউইচ কিনে বাড়ি ঢুকব।
সুপারমার্কেটে
ঢুকে দেখি দোকান তখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, কর্মচারীরা বড় বড় ট্রলি ঠেলেঠুলে
মালপত্র গোছাচ্ছেন। টাটকা মাংস ইত্যাদির কাউন্টার অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে, ক্যাশ
কাউন্টারের অল্পবয়সী মেয়েটা বসে বসে ঘড়ি দেখছেন আর হাই তুলছে। খালি দোকানের
এককোণের ব্রেড সেকশনে তখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। আগামীকালের জন্য নতুন স্টক এসে
গেছে---শেলফে সারিসারি লম্বাচওড়া ব্যাগেট, পেটমোটা রাই ব্রেড, নিকষকালো
পাম্পারনিকেল। আমার জড়োকরা দু’হাতের পাঞ্জার থেকেও বড়, নুনের গুঁড়ো মাখানো গিঁটপড়া
হৃদয়ের মতো দেখতে প্রেটজেল, বাল্বের উষ্ণ হলুদ আলোর নিচে ঝুড়ির ভেতর গা ঘেঁষাঘেঁষি
করে শুয়ে আছে।
পিঠে
দশমণি ব্যাকপ্যাক, এককাঁধে হাতব্যাগ, আরেককাঁধে ক্যামেরা আর হাতে স্যান্ডউইচের প্যাকেট
নিয়ে পাহাড় ঠেঙিয়ে শেষমেশ বাড়ি ফিরলাম। মাঝপথে একবার বাড়ির দরজা চাবি দিয়ে খোলার
ব্যাপার ছিল। এতদিনের অব্যবহারে চাবি ঢুকে গিয়েছিল ব্যাকপ্যাকের একেবারে তলায়, কাজেই
স্যান্ডউইচের প্যাকেট, ক্যামেরা, হাতব্যাগ, ব্যাকপ্যাক সব রাস্তায় নামিয়ে, হাঁটু
মুড়ে বসে ব্যাকপ্যাক হাঁটকে চাবি বার করতে হল। অরগ্যানাইজেশন ব্যাপারটা যে এখনও
রপ্ত হয়নি সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। আমার জায়গায় কোনও জার্মান হলে বাসে বসে, কিংবা খুব
সম্ভব হোটেলে থাকতেই বাড়ির চাবি বার করে সুবিধেজনক জায়গায় রেখে দিত। আবার সব ঘাড়ে
নিলাম, চাবি দিয়ে দরজা খুললাম, সিঁড়ি ভাঙলাম, তারপর মৃদু আলোজ্বলা কাঠের করিডর পা টিপে
টিপে পেরিয়ে অবশেষে নিজের ঘরে পৌঁছলাম।
দরজা
খুলে আবার সেই বোরিং সিংগল খাট, দেওয়ালে দুর্বোধ্য আর্ট, ডেস্কের ড্রয়ারে সেই একগাদা
জঞ্জাল। মোটে তিনমাসে এত আবোলতাবোল কাগজ জমায় কী করে মানুষ? জার্মান ক্লাসের
হ্যান্ডআউট, রেস্টোর্যান্টের মেনুকার্ড, এখানসেখান থেকে ফ্রি পাওয়া পেন আর স্টিকি
নোটস্, আপাদমস্তক জার্মানে লেখা প্যামফ্লেট---যার একটি শব্দও আমি তখন বুঝতে
পারিনি, এখনও পারি না। রাস্তায় দাঁড়ানো একটা প্রতিবাদী মেয়ে দিয়েছিল, ভদ্রতা করে ব্যাগে পুরে বাড়ি নিয়ে এসে, ব্যাগ থেকে বার করে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলার বদলে ড্রয়ারের
ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছি।
এতদিন
ভাবতাম নিজের স্বভাবের দোষ। জিনের গোলমাল। বাবা জমান, তাই আমিও জমাই। কাল মনে হল
এই স্টিকি নোটসের বান্ডিল ছাড়া আর কী ভাবেই বা বুঝতাম যে এটা আমারই ঘর? আমারই
ডেস্ক? অন্য কারও ঘর ভুল করে চাবি দিয়ে খুলে ঢুকে পড়িনি?
হোটেলের
ফটফটে পরিষ্কার, দাগহীন ঘরগুলোর কথা মনে পড়ে শিউরে উঠলাম। প্রতিদিন বিকেলে
ঘরে ফিরে দেখতাম ঘর আবার নতুনের মতো পরিষ্কার, বিছানার চাদর আবার ভাঁজহীন, টানটান। বাথরুমে মেলে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে তোয়ালে ম্যাজিকের মতো আবার খটখটে
শুকনো, পরিপাটি ভাঁজ করে রাখা। আমি যে কাল রাতে এই ঘরটাতে বাস করেছিলাম, এ ঘরের
জিনিসপত্র ব্যবহার করেছিলাম, এই ডেস্কে বসেই স্কাইপে গল্প করতে করতে চা খেয়েছিলাম,
তার সমস্ত চিহ্ন প্রতিশোধের মতো মুছে নিয়ে চলে গেছে কেউ।
আপাতত
ক’দিনের জন্য এই অস্থায়ী ঘরটায় আবার আরাম করে থাকা যাবে। দেওয়ালের বিতিকিচ্ছিরি ছবিটা
বদলানো যাবে না ঠিকই, কিন্তু কাবার্ড খুলে যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা
প্লাস্টিকব্যাগের তাড়া দেখলেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে এটা আসলে আমারই
ঘর।
লেখাটা পড়ে এত কথা মাথায় এলো, যে এখানে না লিখে ভাবছি একটা পোস্টই বের করে ফেলবো... :)
ReplyDeleteগুড গুড। পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
Deletebesh akta filmer moto puro chabita fute uthlo :) durbodhya art er chabi dekhte chai :) :)
ReplyDeleteতোর কমেন্টটা পড়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আর্টটা আসলে একেবারেই দুর্বোধ্য নয়। দিব্যি একখানা ঘটের ছবি। লেখার আনন্দে লিখেছি আরকি।
Deleteওই ব্যাগের নিচে চাবি ঢুকে যাওয়াটা আমারও হয়, তখন সিঁড়ির ওপর দুনিয়ার জিনিস আনপ্যাক করে সেটা বের করতে হয়। আর আপনার লেখাটা পড়ে এই ভিডিওটার কথা মনে পড়ে গেল:
ReplyDeletehttp://www.youtube.com/watch?v=4x_QkGPCL18
দুর্দান্ত ক্লিপ। থ্যাংক ইউ।
Delete:)
ReplyDeleteআপনি খুবই কম কথার মানুষ বোঝা যাচ্ছে, প্রোজ্জ্বল।
Deletepretzel bostuta ami atyanto kharap basi ..ar chabir ei somosyar jonno ami pocket e rakhi ajkal.
ReplyDeleteএমা, এটা মিলল না প্রদীপ্তা। আমার প্রেটজেল দুর্দান্ত লাগে।
Delete