সিনিয়র সিটিজেন
'কাকুকে কী হ্যান্ডসাম
দেখতে রে!'
পনেরো মিনিট ধরে প্রণাম,
আশীর্বাদ, টা টা বাই বাই, ভালো হয়ে থেকো, বেশি করে খেয়ো, ঠাণ্ডা লাগিয়ো না, মন
দিয়ে পড়াশোনা কোরো ইত্যাদি চলার পর অ-ব-শে-ষে-এ-এ যখন বাবামা’র অটো হোস্টেলের গেট
ছেড়ে ভটভটিয়ে এগিয়ে গেল তখন লোপাদির কথা শুনে আমার হাঁ হওয়ার জোগাড়।
কে হ্যান্ডসাম? আমার বাবা?
'হ্যাঁ তো। কি দারুণ হাইট।
কিছু মনে করিস না, তুই কিন্তু একেবারেই বাবার মতো হোসনি। কাকিমার মতোও হোসনি।
কাকিমাও খুব সুইট।'
ইঙ্গিতটা অগ্রাহ্য করে আমি
হাঁ হয়ে থাকি। বাবাকে যে দেখতে হ্যান্ডসাম হতে পারে, এই অদ্ভুতুড়ে তথ্যটা হজম
করতেই আমার ব্রেনের সবটুকু পাওয়ার খরচ হয়ে যায়। বাবাকে যে বাবার মতো
দেখতে ছাড়া আর কোনও রকম দেখতে হওয়া সম্ভব, সে সত্যিটা মেনে নিতে আমার মগজ হাবুডুবু
খায়।
বাবাকে নিয়ে এ সমস্যাটা
চিরদিনের। আমার বাবা আমার কাছে যতখানি হরেদরে, অন্যদের কাছে ততখানিই বিস্ময়ের
ব্যাপার। কাকু একা একা বেড়াতে যান মানে কী? একটা বয়সের পর লোকের একা একা কিছু করা
অ্যালাউড নাকি? সবাই করুণা ভরে আমার দিকে তাকায়।
আমি ফাইট দিতে ছাড়ি না। আমরা যাই তো সবাই
মিলে বেড়াতে। বছরে দু’বার। কিন্তু বাবা তিনমাসের বেশি একটানা বাড়িতে থাকতে পারে
না, তাই বাকি দু’বার বাবাকে একা একাই বেড়াতে যেতে হয়। বড়দের অফিসে দিতে পারে,
ছোটদের স্কুলে অত ঘনঘন ছুটি দেয় নাকি? আর আমি না গেলে আমাকে ফেলে আমার মা যাবে কী
করে?
লোকের চোখে করুণা আরও গাঢ়
হয়ে আসে।
আমি ফাইটে ক্ষান্ত দিয়ে
গোমড়া মুখে বসে থাকি। বড় হয়ে আমি যখন বাবার মতো একা একা বেড়াতে যাব তখন এরা
সেটাকেও বেআইনি ঘোষণা করবে নির্ঘাত, সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহই থাকে না আর।
আমার বাবার একটা সাইকেল
আছে, সাইকেলটার বয়স আমার থেকেও দশ বছর বেশি। সে সাইকেলটায় করে আমার বাবা সারা
বিহার চষে বেরিয়েছে। হাজারিবাগ, রাঁচি, নেতার হাট। গল্প নয়, হলদে হওয়া আসা
সাদা-কালো ছবিতে প্রমাণ দেখেছি আমি। ঝর্ণার পাশে পাথুরে পাহাড়ে দাঁড় করানো সাইকেল,
সাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার লম্বা বাবা, চোখে অ্যাংরি ইয়ং ম্যান কালো
ফ্রেমের চশমা, গালে অ্যাংরি ইয়ং ম্যান চাপদাড়ি, পরনে অ্যাংরি ইয়ং ম্যান বেলবটম
প্যান্ট। কেয়ার-ফ্রি সেই ভ্রমণের দিনগুলোসংক্রান্ত একটাই দাবি বাবা করেছে, যেটা
আমার বিশ্বাস হয়নি। বাবা বলেছে বাবা নাকি সে সময় দারুণ রান্না করতে পারত। মাছ,
মাংস, টিণ্ডা, ঠেকুয়া---সব নাকি নিজে হাতে বানিয়ে খেত বাবা।
হাঃ।
আমার বাবা যাই করেন,
নাওয়াখাওয়া ভুলে করেন। বাবা একসময় নাওয়াখাওয়া ভুলে গান গাইতেন (অফিসের ছাদে জটলায়
বসে বাবার গাওয়া ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ শুনেই আমার মা পপাত চ হয়েছিলেন),
নাওয়াখাওয়া ভুলে তাস খেলতেন। তারপর এল নাওয়াখাওয়া শিকেয় তোলা থিয়েটার, তারপর এল টেবিল
টেনিস, তারপর নাওয়াখাওয়া ভোলা টইটই। চেনা জায়গা, অচেনা জায়গা, তারকেশ্বর,
গোবিন্দপুর---কিছু একটা হলেই হল। সঙ্গী জুটলে ভালো, না জুটলে আরও ভালো। বাবার
স্ট্যান্ডার্ড জীবনদর্শন।
আজ আমার বাবার বাষট্টি
বছরের জন্মদিন। বাবা যে হ্যান্ডসাম, বাবা যে অন্য বাবাদের থেকে অন্যরকম এসব কথা
যদিও বা বিশ্বাস করা সম্ভব, বাবা যে সিনিয়র সিটিজেন হয়েছেন সেইটা বিশ্বাস করা আমার
পক্ষে সবথেকে কষ্টকর। বাবা নিজে অবশ্য দারুণ খুশি, কারণ ট্রেনের টিকিটের দাম ফরটি
পার সেন্ট কমে গেছে। বাবার বেড়াতে যাওয়া আরও কণ্টকহীন। আমার বাবা সাধারণত কোনও
সেলিব্রিটির নিরবচ্ছিন্ন প্রশংসা করেন না (এক, ভীমসেন যোশী আর দুই, রাজকুমার
ছাড়া। রাজকুমার কে? আরে সেই হিন্দি সিনেমার নায়ক রাজকুমার। আমার বাবার ফেভারিট
হিরো। বলেছিলাম, বাবা অন্যরকম।) কিন্তু বাবাও মুক্তকণ্ঠে বলেন, সিনিয়র সিটিজেনদের
টিকিটের দাম কমানোটা মমতার মাস্টারস্ট্রোক।
বাবাকে সকালবেলা ফোন করে
হ্যাপি বার্থডে বললাম। আরেক প্রস্থ ভালো করে খাস, ঠাণ্ডা লাগাস না, দেখিস যেন
অর্চিষ্মান ভালো করে খায়, দেখিস যেন অর্চিষ্মানের ঠাণ্ডা না লাগে-র পর অবশেষে আমার
সুযোগ এল জিজ্ঞাসা করার, ‘আজ তুমি সারাদিন কী করবে বাবা?’
আমার বাষট্টি বছরের বাবা চুপ করে রইলেন। বললেন, ‘এই তো সকালবেলা উঠে বিলায়েত খাঁ-র ললিত চালিয়েছিলাম। কাল হিটার সারাতে দিয়েছিলাম, এখন সেটার তদারকি করতে যাব, ফিরে এসে আবার গান শুনব। আজ সারাদিন গান শুনব আমি।’
গত বছরদশেক হল বেড়াতে
যাওয়ার পাশাপাশি আরও একটা নেশা হয়েছে বাবার। নাওয়াখাওয়া ভুলে গান শোনা। তারপরই
বাবার গলায় আলো জ্বলে উঠল। খবর দিলেন, চোদ্দ তারিখ কর্ণাটকের ঐতিহাসিক বিদার
কেল্লা দেখতে যাচ্ছেন। একাই। টিকিট কনফার্মড হয়ে গেছে।
‘বাঃ বাঃ ভেরি গুড’ বলে, আরও একবার শুভ জন্মদিন বলে ফোন নামিয়ে রাখলাম। চোখের সামনে আমার ভীষণ হ্যান্ডসাম, ভীষণ খেয়ালি বাবার দীর্ঘ, টানটান চেহারাটা জ্বলজ্বল করতে লাগল। রোজই করে, আজ সারাদিন একটু বেশি করে করবে।
darun ..khub bhalo laglo pore...bandhura jakhan babake handsome bole amar toh bhishon garbo hay mone mone ...ar kakur ei eka berate jaoar byaperta amar just durdanto lage
ReplyDeleteবাবার হয়ে আমিই তোকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে দিচ্ছি তিন্নি।
Deletedarun :) jonmodiner srestho upohar ta apnii onake dilen :)
ReplyDeleteওহ, থ্যাঙ্ক ইউ অরিজিৎ।
Deleteআজ বিকেলে বাবাকে আরেকবার ফোন করে কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যান ক্লাবের তরফ থেকে হ্যাপি বার্থডে বলে দেবেন। আর বিদার কেল্লার গল্প জেনে নিয়ে আমাদের শোনাবেন কিন্তু।
ReplyDeleteআহা, কী ভালো ক্লাব। নিশ্চয় বলব দেবাশিস। বাবার তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
Deleteamader sobbaikar tarof theke jodio agei 'Happy Birthday' wish kora hoe gachhe,tobu ami arekbar subhechha janie gelam. ei berate jabar byaparta amaro daruuuun lage, amader barite amar baba , ma ero khubi beranor nesha. seta amio khanik peyechhi, kintu ei eka ekkebare nirjhonjat chintahin... khub khuub bhalo. kellar galpo shunbo bole bose roilam .
ReplyDeleteবাবার তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই ইচ্ছাডানা। আপনি যে বেড়াতে ভালোবাসেন সেটা আপনার ব্লগ দেখলেই বোঝা যায় ইচ্ছাডানা। দেখি বাবাকে বলব কেল্লার গল্প জমিয়ে নিয়ে আসতে।
Deleteআমার বাবাকেও যে ভয়ানক হ্যান্ডসাম দেখতে সেটা আমার এখানকার সমস্ত বান্ধবীরা একবাক্যে জানিয়েছে। যারা নিজেরা জানাতে লজ্জা পেয়েছে তারা আরেকটু নির্লজ্জ কমন বন্ধু মারফত জানিয়েছে। আর তারা বাবার কলেজ লাইফের বেলবটস পরা এলভিস ঝুলপি অলা ছবি দেখেও কথাটা বলেনি, এখনকার সিনিয়ার সিটিজেন বাবাকে জলজ্যান্ত দেখেই বলেছে। দুঃখের বিষয় হল এই বান্ধবীদের কেউই আমায় কোনওদিন হ্যান্ডসাম বলেনি। জঘন্য।
ReplyDeleteযাই হোক, কাকুকে অনেক অনেক হ্যাপি বার্থডে জানালাম। কাকুর এডভেন্চারের গল্প দুয়েকটা কি অবান্তরে আশা করতে পারি?
জঘন্য বলে জঘন্য সুগত। একটাই আশা, ফাঁকতালে নিজেরা বাবা মা হতে পারলে দূর ভবিষ্যতে কোনওদিন হয়তও বাবামা'র গরিমার ছিটেফোঁটা কপালে জুটতে পারে। কাকুর তরফ থেকে শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ। বাবাকে জিজ্ঞাসা করব গল্প পাওয়ার ব্যাপারে।
DeleteHya hya Kunatala di, Kaku ke janmodin er anek shubhechha janalam; kintu kakur adventure er golpo -o lekha hok kaekta!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ কোয়েল, দেখি বাবাকে জিজ্ঞাসা করে।
Deleteখুব ভাল লাগলো এই লেখাটা. সব লেখাই ভালো লাগে কিন্তু এটা খুব স্পেশাল হয়েছে. আমার নিজের বাবার কথা খুব মনে পড়ে গেল. আর সবচেয়ে ভালো লাগলো তিন মাসের বেশি বাড়ি না থাকতে পারার কনসেপ্ট.
ReplyDeleteধন্যবাদ এত্ত সুন্দর লেখার জন্য. আর বই-এর জন্য আগাম শুভেচ্ছা থাকলো.
ইনিয়া
আরে থ্যাংক ইউ ইনিয়া। অবান্তরে আত্মপ্রকাশের জন্য, আর বইয়ের শুভেচ্ছার জন্যও। তিনমাসের বেশি বাড়িতে না থাকাটা খুবই কাজের কনসেপ্ট, কাজে লাগাতে পারলে।
Deleteবাবার মেয়েকে অনেক শুভেচ্ছা, বাবার নাম এমন সুন্দর রৌশন করার জন্য৷ ফেসবুকের দেওয়ালে রোহণ অবান্তরের প্রিভিউ লটকেছে, পড়ে আর একবার মুগ্ধ হলাম৷
ReplyDeleteআরে থ্যাংক ইউ অদিতি।
DeleteApanar babake amar torof theke onek subhechha janaben! Uni jano aro ghure berate paren, ei kamonai kori! Amakeo sobai bole amar ma-ke darun dekhte!
ReplyDeleteরুণা, বাবার তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। মন্তব্য পেয়ে খুব ভালো লাগল। আপনার মাকে তো বটেই, আমি নিশ্চিত আপনাকেও ভীষণ ভালো দেখতে।
Delete