শীতের দুপুর আর দাদুর তক্তপোষ
আজ এখানের আকাশে ঝলমলে
রোদ। হাওয়ায় ঠিক ততটুকুই শীতের কামড়, যতটুকু একটা রঙিন ফুলহাতা সোয়েটারে আটকানো
যায়। আমি তার সঙ্গে নেহাত ফ্যাশন করব বলেই মায়ের হাতের বোনা একখানা নরম উলের
মাফলার গলায় জড়িয়ে নিয়েছি। দিব্যি লাগছে। রাস্তার ধারে ডাঁই করা ময়লার ঢিবি,
অটোওয়ালাদের অত্যাচার, মোটরসাইকেলের কান ফাটানো হর্ন, একটু হলেই পাড়িয়ে দেওয়া পথের
ঠিক মাঝখানে থুতুর ডেলা---কিচ্ছু আমার মনমেজাজ বিতিকিচ্ছিরি করে দিতে পারছে না।
অফিসের গেটের উলটোদিকটায় একটা লোক এক ঠ্যালাগাড়ি ঝকঝকে সবুজ অমরুত, যাকে আমরা
পেয়ারা বলি, নিয়ে বসেছিল; আমি গিয়ে তাদের মধ্যে থেকে বেছেবুছে, টিপেটুপে একটা টাইট
দেখে পেয়ারা তুলে বললাম, “ভাইসাব, কাটকে দিজিয়ে প্লিজ।” লোকটা একটা হাতলছাড়া ছুরি
দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত পেয়ারাটা চারফালি করতে করতে মোটা গলায় জানতে চাইল, “মসালা
লাগানা হ্যায়?”
আমি চোখ কপালে তুলে
বললাম, “অফ কোওওর্স।”
না হলে তো গোটা পেয়ারা কিনে
বাড়ি নিয়ে গিয়ে, ভালো করে রানিং ওয়াটারে ধুয়ে, মুছে, টুকরো করে প্লেটে সাজিয়ে,
টাটা টেবিল সল্ট লাগিয়ে লাগিয়ে খেলেই হয়। এই খোলা ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে আধোয়া
পেয়ারা খাচ্ছিই তো ওই মশলাটার জন্য।
আমার মায়ের মতে, যেটা কিনা
দুনিয়ার খারাপ আর অস্বাস্থ্যকর জিনিস দিয়ে বানানো হয়েছে। খেয়েছ কি কলেরা।
পেয়ারা খেতে খেতে,
গুনগুনিয়ে গান ভাঁজতে ভাঁজতে অফিসে ঢোকার সময় হঠাৎ অনেক অনেক অনেক বছর আগের একটা স্মৃতি
মনে পড়ে গেল। স্মৃতিটায় আমাদের বাড়ি, বাড়ির বাগান, বাগানের পেয়ারাগাছটা, আর আমার
ঠাকুরদা আছেন। আর ঠাকুরদার থাকা মানে আমার বয়স চার বছরের কম। তবেই বুঝুন কতদিন
আগের কথা বলছি।
আমার ঠাকুরদা রেলের
সামান্য কেরানি ছিলেন, কিন্তু শুনেছি তাঁর অনেক রকম প্রতিভা ছিল। বরিশালের গ্রামে
যাত্রা শুরু হওয়ার আগে যে কাড়ানাকাড়া বাজার ব্যাপার হত তাতে আমার দাদু স্টার
বাঁশি-বাজিয়ে ছিলেন। দাদুর বাঁশি আমি শুনিনি, তবে ঠাকুমার ট্রাঙ্কে একটা চকচকে
পেতলের বাঁশি এখনও রাখা আছে দেখেছি।
বাঁশি বাজানো ছাড়া আমার
ঠাকুরদাকে আমি আর যে কাজগুলো পারতে দেখেছি সেটা হচ্ছে বাড়িশুদ্ধু লোককে ধমকে সিধে
করে রাখতে, এলাকার একটিও ফুলচোরকে আমাদের বাগানের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না দিতে, আর
পাড়াশুদ্ধু বাচ্চাদের লাই দিয়ে মাথায় তুলতে। আমার আবছা আবছা মনে আছে দাদু আমাকে,
বুচিদিদিকে, পুকিদিদিকে, রাজুদাদাকে বিকেলবেলা স্বপনকাকুর মুদির দোকানের দিকে
মিছিল করে নিয়ে চলেছেন, সেখানে গিয়ে সবাইকে ঠোঙায় করে চোখে জল আনা ঝাল চানাচুর
কিনে দিচ্ছেন, সবাই নাক টানতে টানতে চোখ মুছতে মুছতে হুশহাস করে সেই চানাচুর
খাচ্ছে আর আমি খাওয়াটাওয়া ভুলে দোকানের প্রায় মানুষ-সমান উঁচু দাঁড়িপাল্লার দিকে হাঁ
করে তাকিয়ে আছি।
তবে আমার মতে (ঠাকুমাও
এব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত) আমার ঠাকুরদা সব থেকে ভালো পারতেন আরাম করতে। যখন ডিসেম্বর
মাসের শেষ নাগাদ রিষড়ার বাড়িতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ত তখন দাদু রোজ সকালে উঠে
বাড়ির ভেতর থেকে একখানা তক্তপোষ টেনেহেঁচড়ে বাড়ির বাইরে বাগানে বার করে আনতেন।
ছোটখাট মানুষ ছিলেন, কাজেই ব্যাপারটা শুনতে যতটা জটিল মনে হচ্ছে, বাস্তবে তার
থেকেও অনেক বেশি জটিল হত। বাগানের পেয়ারাগাছের তলায় সেই তক্তপোষ পাতা হত। তক্তপোষের ওপর লেপ তোষক বালিশ ইত্যাদিও ভেতর থেকে বয়ে বয়ে এনে রাখা হত।
তারপর দাদু
দিনের কাজে লেগে যেতেন; বাজার যেতেন, বাগান দেখতেন, আগাছা পরিষ্কার করতেন, ঠাকুমার
সঙ্গে ঝগড়া করতেন। তক্তপোষ আর লেপতোষক ততক্ষণে রোদ খেয়ে খেয়ে গরম হত। তারপর
স্নানটান খাওয়াটাওয়া সেরে, মুখে একখানা পান গুঁজে, তাঁর ইয়াব্বড়, কাঠের বেঁকানো
হ্যান্ডেলওয়ালা প্রিয় ছাতাটি নিয়ে দাদু বাগানে এসে হাজির হতেন। তক্তপোষের সাইডে
কায়দা করে ছাতাটাকে হেলান দিয়ে রেখে, সেই ছায়ায় মাথাটাকে প্লেস করে দাদু গরম
তক্তপোষের ওপর, তপ্ত লেপের তলায়, উষ্ণ বালিশে মাথা রেখে ঘণ্টাখানেক আরাম করে
ঘুমোতেন। আমাকেও মাঝে মাঝে সে লেপের তলায় শুতে হত মনে আছে। তবে দাদুর নাক
ডাকার আওয়াজ পেলেই আমি লেপের তলা থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি করতাম।
রোদ
যখন ছাতার ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যেত, লেপতোষকের ওম ফুরিয়ে যেত, তখন দাদু গা ঝাড়া দিয়ে
উঠে আবার খাটবিছানা ঠেলে ঠেলে বাড়ির ভেতর আনতেন। পরের দিন আবার পুরো ঘটনাটার
পুনরাবৃত্তি ঘটত।
অতটুকু আরাম
করার জন্য এতখানি পরিশ্রম আমি আমার ঠাকুরদা ছাড়া আর কাউকে করতে দেখিনি।
ki bhalo barnana!!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
Delete:)
ReplyDeleteBah. Monta bhalo hoye galo pore. Amar thakurdadao amar chaar bochhorey mara jaan. Tai amakeo eisob half-formed shoishober smritir opor bhorsha korte hoy sobsomoy.
Tobey bolte hobe kintu...gorom toshoker bhetor ghumonor mojata just onyorokom. Just.
p.s. Tumi ki ekhon Dillitei achho pakapaki bhabe? Jodi theke thako tahole berey khobor toh! :D
একদম বিম্ববতী। গরম লেপতোষকের আমিও বড় ফ্যান। হ্যাঁ গো আমি দিল্লিতে পাকাপাকি।
Deleteoh! dilli te pakapaki...tahole ebare deshe gele old dilli te dekha hotey pare :)
DeleteTumi ki Netaji'r "Delhi chalo" bani shunle? :D
Deleteরিয়া, সেই ডাক তো অনেকদিনই শুনেছি। শম্পা, দরিয়াগঞ্জে যাব তোমার সঙ্গে। কেমন?
Deletebah! daroon barnona...tobe sheeth er rodh er byapar e alada. aar chaad e boshe rodh poyano'r aram e alada!!
ReplyDeleteট্রু শম্পা।
DeleteAmi jokhon khub chhoto tokhon amar woolen jamakapor ma roddure dariye fold korto. Tai segulo besh gorom gorom thakto porbar somoy o :) Amader 3tolar chhade khub odbhut ekta angle e rod ashe sheet kale...tobe setai byapok!
ReplyDeleteAmar maoera khub bhalo roddure shuye ghumote jane. Orao orokom fleece er kombol fapiye niye jekhane rod porche sekhane shuye ghumoy :)
বেড়ালরা রাজার জাত কিনা, আরাম করতে জানে রিয়া। আমাদের মতো ওয়ার্কিং ক্লাস নয়।
DeleteJa bolecho! Lakh takar katha!
Deleteকি বর্ণনা! আহা! ওই রোদ্দুরে গরম করা লেপের তলায় শোওয়ার গল্পটা শুনেই আমার ওরকম করতে ইচ্ছে করলো। আজ এখানে আবহাওয়াটাও খানিকটা দেশের শীতকালের মতন কিনা।
ReplyDeleteআমার ছোটবেলাটা কেটেছে এলাহাবাদে, সেখানে শীত পড়ত জব্বর। শীতকালের বেশ খানিকটা সময় রোদ উঠতনা, গোটা দিন কুয়াশা থাকত, কখনো বৃষ্টিও হত। সে সময়টা বাড়ির ভেতর বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিলনা। কিন্তু রোদ উঠলে, আর ছুটি থাকলে, আমি সকালে মাদুর নিয়ে ছাদে গিয়ে রোদে বসতাম, নামতাম সেই মা দুপুরে খেতে ডাকলে। খাওয়ার পর জেনারেলি আরেক রাউন্ড ছাদে শোওয়া হত। তবে আমাদের ছাদে বাঁদর আসত মাঝে মাঝে, সেটা একটা ভয় ছিল।
আমরুদ বা পেয়ারা আমার অন্যতম প্রিয় ফল। একটু ডাঁসা হলে ভালো লাগে, আর ওই মশলা টা থাকলে তো কথাই নেই! এদেশে অবশ্য পেয়ারার দাম ভয়ানক। এদিকে মাকে ফোন করলেই শুনি আমাদের গাছে এত পেয়ারা হয়েছে যে লোকজন কে ডেকে ডেকে বিলিয়েও তারপর নষ্ট হচ্ছে। :-(
ওরে বাবা আমাদের ছাদেও হনুমান আসত মনে আছে। ছাদের কার্নিশে বসত আর ল্যাজ নামত প্রায় আমাদের জানালার নিচ পর্যন্ত। আপনার এলাহাবাদের গল্পও খুব সুন্দর। পেয়ারা আমাদের বাড়িতেও পাখিদের ভোগে লাগছে। কী আর করা।
Deleteki sundor...tomar lekhata pore puro leela mojumdar er "aar konokhane" mone pore gelo..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ স্বাগতা।
Deletedarun likhechho. Rishra amar chhotobelar khub chena jaiga. kolaktai ajkal ar rod-e bosar moton siit porchheina. khub monkharap kore chhotobelar oi rod pohanor kotha mone porle.
ReplyDeleteওহ আপনি রিষড়া চেনেন ইচ্ছাডানা? এইটা শুনলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। ছোটবেলার মতো রোদই ওঠেনা আজকাল, পোহানো তো দূর অস্ত।
Deletetomar dadu vison rosik manus chilen to...aj amar kono dadu beche nei..aha omon jodi akta dadu akhon petam omon toktopose e peyara gacher tolatei bodhai amar sara din kete jeto......sathe roj notun notun golper boi...vabtei valo lagche.
ReplyDeleteপেয়ারা গাছ আর তক্তপোষ থাকলে আমিও সারাদিন তাই করতাম কুহেলি।
Deletesheetkale ma onek koshto kore tene hichre amader khaater bhaari toshok ta rod e dito.. dupurbela sei gorom toshok e shuye diba nidrar ekta alada moja chhilo.. rod e gorom howa je kono jinisher modhyei ekta aram aram byapar achhe. rod e gorom howa chan er jol o aramdayok, jodi kokhono use kore thako... [oboshyoi sheet kaal e].
Deleteএত আগে করেছি সোহিনী, যে আরামটা আমার মাথার ভেতর রিক্রিয়েট করতে পারছি না। তবে খারাপ তো নির্ঘাত লাগত না।
DeleteEi lekhata pore amai je amar dadu ba thakurda kaukei dekhini sei dukkhota realize korlam. Er age kono din sei byapar ta hoi ni. Lep rode deoar trend ta abosso amader bareeteo chhilo. Bhulei gechhilam byapar ta!
ReplyDeleteBangalore-e darun peara paoa jeto. Ar sei jhal jhal masla....mon bhalo kore deoa ekta byapar. Ami chamotkar peara Panama gie kheyechhilam. Dansha ebong darun mishti. Size-eo bangalore-er peara-r cheye tin gun! Kintu kono jhal masla chhilo na sange!
Tumi delhi te pakapaki thakar byabostha korechho mone hochhe. Nischoi notun chakri, atoeb, Congrats!
পানামার পেয়ারা খেতে দেখতে হবে তাহলে মনে হচ্ছে রুচিরা।
DeleteShudhu peara-i noi, okhankar naspati, tormuj egulo-o durdanto! tobe aam gulo amader desher-i better. Ami okhane gachh theke aam chhire ene chatney banie kheyechhilam kintu baddo fiber - bhalo na.
Deleteঠিক বলেছ রুচিরা, ফাইবারওয়ালা আম আমারও বিশ্রী লাগে। আমাদের মালদার ফজলির মধ্যে ওই ব্যাপারটা থাকে বলে আমার বিশেষ পোষায় না।
DeleteAbantar....shong ar sharer nanan tanaporene besh kichudin tomar kache ashte psrini...aj eshe monta bhalo lagai bhore gelo....shei chottobelar rod tar jonno bhishon mon kemon kore kintu tomar lekha porlei mon bhalo.:-)
ReplyDelete