গুরুজি
রবিশংকরের খবরটা পেয়ে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে সবে ভাবছি ব্যাপারটা ভারতীয়
মার্গসংগীতের পক্ষে ঠিক কতখানি গুরুতর হল, তক্ষুনি মা ফোন করে বললেন, “সোনা, খারাপ
খবর আছে।”
বললাম, “জানি জানি, রবিশংকর তো?”
মা বললেন, সে তো আছেই, তার ওপরেও আরেকটা খারাপ খবর আছে। খবরটা হচ্ছে যে পণ্ডিত
মানস চক্রবর্তী মারা গেছেন।
ভারতীয় মার্গসংগীতের পক্ষে তো বটেই, এই খবরটা আমার নিজের পক্ষেও অত্যন্ত
গুরুতর, কারণ পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী ছিলেন আমার গুরুজি। আমার মোটামুটি দীর্ঘ শাস্ত্রীয়
সংগীত শিক্ষার শেষ তিনটি বছরের মাস্টারমশাই।
গুরুজির কাছে সশরীরে পৌঁছতে পৌঁছতে আমার উনিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু
তাঁকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আট বছর বয়সেই। যে বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যেয় মা বাবা আর আমি
শ্রীরামপুরের অলিতে গলিতে একটা ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, সেই সন্ধ্যেয়। মায়ের
অফিসের শচীনকাকু পণ্ডিত মানস চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতেন, তিনিই প্রথম বুদ্ধিটা
দিয়েছিলেন।
“মেয়েকে ক্ল্যাসিকাল শেখাতে চান অর্চনাদি? আপনাদের বাড়ির কাছেই, শ্রীরামপুরে
আমার গুরুভাই সঞ্জিৎ থাকে, যোগাযোগ করে দেখুন না।”
শুধু এই তথ্যটুকু সম্বল করে, আমাকে ট্যাঁকে গুঁজে, উনিশশো উননব্বই সালের জুলাই
মাসের এক শনিবার বিকেলবেলা বাবা মা বেরিয়ে পড়লেন। কাজটা সহজ ছিল না, একে ঠিকানা জানা
নেই, তায় বৃষ্টি। তবে আমার জনকজননীর ইচ্ছাশক্তি এবং স্ট্র্যাটেজি, দুটোই প্রভূত
পরিমাণে ছিল। তাঁরা প্রথমেই মোটামুটি নামকরা গানের ইস্কুলগুলোয় গিয়ে গিয়ে হবু
মাস্টারমশাইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অচিরেই মেওয়া ফলল। ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরির
পর অবশেষে আমরা স্টেশনের কাছে একটা সরু গলিতে ততোধিক সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়
উঠে একটা ঘুপচি এককামরার ফ্ল্যাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এ ঘরে যে গানবাজনা হয় সেটা
আর বলে দেওয়ার দরকার ছিল না, খাটের ওপর শোয়ানো তানপুরা আর মেঝেতে হারমোনিয়ামই তার
প্রমাণ দিচ্ছিল, কিন্তু সমস্ত সন্দেহের নিরসন করল ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো সুরমণ্ডল
হাতে পণ্ডিত মানস চক্রবর্তীর একটা বড় বাঁধানো ছবি।
তারপর শুরু হল সারেগামা, সারেগা রেগামা, ‘পিয়া কে নজরিয়া’, ‘বন বন ঢুঁড়ন যাউ’,
‘ক্যায়সে সুখ সোহে’ আর ‘তুম রব তুম সাহিব’-র এক অনন্ত মিছিল। মাঝে মাঝে মুখ
পাল্টানোর মতো করে ‘ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান’ আর ‘ঠুমক চলত রামচন্দ্র’। রবিবারের
বিকেল-সন্ধ্যেগুলো গান, গানের স্কুলের আড্ডা, মাস্টারমশাইয়ের গমগমে গলার বকুনি, আর
ক্লাস শেষে বেরিয়ে ঝুলোঝুলি করে মাকে নিমরাজি করিয়ে পথের পাশের ঝুপড়ি দোকান থেকে
কিনে গরম গরম জিলিপি খাওয়ায় ভরে উঠল।
ভালো লাগত কিনা? কে জানে। তখন তো ভেবে দেখিনি। মা সকালবেলা টেনেটুনে ঘুম থেকে
তুলে হারমোনিয়ামের সামনে বসিয়ে দিতেন, আমি ঘুমজড়ানো গলায় গান ধরতাম। গান থেকে তুলে
বইয়ের সামনে বসাতেন, আমি দুলে দুলে পড়তাম। ভালোমন্দ বিচারের শক্তি বা সুযোগ ছিল
কোথায়?
বেশ ক’বছর পর মাস্টারমশাই বললেন, চল্ এবার গুরুজির কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে।
একদিন সকালে তাঁর পিছু পিছু গুরুজির প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির
হলাম। পুরোনো ধাঁচের শক্তপোক্ত দোতলা নিরিবিলি বাড়ি। তার দেওয়াল এত মোটা যে একশো
গজ দূরের বড় রাস্তার কোলাহল বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারে না। একতলাতেই গানের ঘর। বাকি
বাড়িটার থেকেও অন্তত তিনগুণ বেশি শান্ত। তখন শব্দটাই জানতাম না, এখন বুঝি
মিনিম্যালিস্টিক কথাটা ওই রকম ঘরের জন্যই প্রযোজ্য। ঘরের কোণে দুতিনটে লম্বা বেঁটে
তানপুরা দাঁড় করানো, তিনদিকের দেওয়াল ফাঁকা, শুধু একদিকের দেওয়ালে গুরুজির বাবা
পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি টাঙানো। ছবিটার তলায় একটা ছোট
তক্তপোষ। তক্তপোষের ওপর দুটো ছোট তাকিয়া আর একটা সুরমণ্ডল রাখা। বোঝাই যাচ্ছে
গুরুজি ওখানে বসবেন। তক্তপোষের সামনের মেঝেতে মোটা কার্পেট বিছানো আছে। বোঝাই
যাচ্ছে ওখানে আমরা বসব।
বেশিদিন ওই ঘরটায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। সপ্তাহে একদিন করে, এই ধরুন, বছর
তিনেক। তবু বুকের ভেতর দাগ রাখার জন্য সে অনেক সময়। গত দশ বছরের থোড় বড়ি খাড়া
দিনরাত সকালবিকেল, ঘণ্ট পাকিয়ে সময়ের একটা পিণ্ডে পরিণত হয়েছে, কিন্তু গুরুজির
বাড়ির ওই ক’টা সকালকে আমি এখনও স্পষ্ট আঙুল দিয়ে আলাদা করে চেনাতে পারি।
ওই ভারি পর্দা ঢাকা আবছায়া ঘরটায় বসে যখন গুরুজি মৃদু কণ্ঠে সা ধরতেন, আর সেই
সুস্থিত সা-এর চারদিকে আমাদের অপটু অস্থির গলাগুলো ছুটোছুটি করে বেড়াত, শত
চেষ্টাতেও গুরুজির সা-এর ত্রিসীমানায় পৌঁছতে পারত না, আর আমাদের নাকানিচোবানি খেতে
দেখে গুরুজি মুচকি মুচকি হাসতেন, সেই সকালগুলো আমার এ পৃথিবীতে দেখা স্বর্গের
সবথেকে কাছাকাছি জায়গা।
যে স্বর্গ থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। কে জানে কীসের আশায়। ভয়ে ভয়ে “JNU যাচ্ছি” খবরটা
দেওয়ার পর গুরুজি কিছুই বলেননি। খালি মৃদু হেসে বলেছিলেন, “বোকা মেয়ে।”
শত সহস্র অ্যাক্সিয়ম, করোলারি, রিগ্রেশন ইকুয়েশন আর গিনি কোয়েফিশিয়েন্টের অকূল
পাথার পেরিয়ে এসে আমি এতদিন পর বুঝেছি গুরুজি কোন বোকামির কথা বলেছিলেন। সেই স্বর্গটা
আর কখনও তৈরি করতে পারিনি আমি আমার চারপাশে।
গুরুজির গাওয়া মেঘ রাগের আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান ইউটিউবে আছে। সেটা এখানে তুলে দিলাম।
mon bhorey gelo.ar kichhu likhte ichhe korchhe na...
ReplyDeletesotti mon vore gelo
ReplyDeleteদি, আবার একটা খুব সুন্দর লেখা। সুন্দর বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা জানিনা, খবরটা তো দুঃখের শেষ পর্যন্ত। বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যা, বাঙালী মধ্যবিত্ত মা-বাবার বাচ্চা মেয়েকে তারই অজান্তে এক অনাস্বাদিত পৃথিবীর সন্ধান দেওয়া, জিলিপি, ঘুম, গান, পড়া-পড়া খেলা, অসাধারণ সাধকের সাধারন ভাবে বাঁচা (মরা), শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে গেম থিওরি, বোকামো ... সব মিলে মিশে মনটাকে বেজায় ভারী করে দিলে। এই ঘটনাগুলো ছোটবেলাটাকে, যেটা তুলনামূলকভাবে বেশ একটা সহজ সরল পথে চলাফেরা করত, এক ঝটকায় আমাদের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। তোমার লেখাটা পড়ে, সেই কোনকালে পড়া এস. ওয়াজেদ আলীর 'ভারতবর্ষ' গল্পটার কথা মনে পরে গেলো। কয়েক শতাব্দী পরেও হয়ত এই আনোয়ার শাহ-য় এক বোকা কুন্তলা আবার গুরুজির সা-য়ে সা মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে।
ReplyDelete'মেঘ' আমারও একটা খুব প্রিয় রাগ, শুনেছি এই রাগ কে বশে আনাও বেশ চেষ্টাসাধ্য। এই সুন্দর লিঙ্কটার জন্যও তোমার অনেক সাধুবাদ প্রাপ্য।
খুব ভালো লিখেছেন। গানবাজনার সাথে বিশেষ টান না থাকায় আপনার শ্রদ্ধেয় গুরুজির নাম আগে শুনিনি। তবে যে কোন গুণী মানুষকেই আমি ভক্তি করি।
ReplyDeleteছাত্রীর কাছ থেকে এরকম কিছু মনে রাখাই মনে হয় আশা করে থাকেন মাস্টারমশাইরা। রোদেজলে মাখা লেখাটা পড়ে মাথার পেছনে একটা চিনচিনে ভয় বাসা বাঁধলো- আমাদের স্যারেরও বয়স হচ্ছে। একটা অক্ষম শপথ নিলাম, আর একটু বেশি মন দিয়ে বাজাতে হবে।
ReplyDeleteei post-tar sathey relate korte parchhi. bhishon bhishon bhabey.
ReplyDeleteachcha, amra tomar gaan shunbo na?
orre baba....tumi pt manas chakraborty'r chatri. tar mane tow tumi daroon bhalo gaan koro.
ReplyDeletekuntala_di,
ReplyDelete.. lekha-ta pore ami-o fele aasha shonibarer sokalguloe 1 ghonta dhore bus thengiye sheeeiii dumdum-e amar guruji'r class-e pouche gelam jano ... tokhon oboshyo sotti bolbo khoob raag-e hoto jete, shudhu ma-er jor jobordosti tei ja hoar hochilo ... tarpor to kolkata jokhon charlam gaan er paat o chuke buke gelo, ekhon khoob mone hoe chuke buke jawa jinishta je kore hok dhore rakha uchit chilo, aar ekhon majhe majhe khoob mon kharaper somoe mone hoe ei tanpura ta harmonium ta aar gaaner khata ta kache pele mon ta jhorjhore kore nitam ... khoob miss kori aajkal, ei kichudin aagei ami youtube khunje khunje amar guruji-r kichu video baar kore shunchilam ... amar college er somoe uni onekdin oshushto chilen bole kolkata charaar somoe onaar snge dekha o kora hoeni, shebhabe janano-o hoeni, pore onekbaar mone hoeche, ekbaar jai, dekha kore ashi, kichukhon boshe gaan shune aashi, kintu kora aar hoeni ... ekhon tomar pathano megh shunchi :)
Tomar ganer Ekta videor opekkhay roilam.......
ReplyDeleteকুন্তলাদি, বেশ হয়েছে। শেষ প্যারাগ্রাফটা পড়ে মনে হল নিচের কবিতাটা আপনাকে পড়ানো যাক। আমার বাবার লেখা।
ReplyDeleteকালপুরুষ স্যার
_____________
এখনও আপনি বুঝি আগের মতন,
স্কুলের রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন?
বিপথে যাওয়ার জন্য ডাক দিত যারা,
যে সমস্ত লাল নীল ঢেউ
বৃথাই পেরিয়ে গেছে, আমরাও কেউ
অনন্ত সাহস নিয়ে ভাঙ্গিনি পাহারা,
ঢেউ ছুঁতে এগোইনি সে জীবনে আর।
অথচ ভেসেছি ঠিকই, মেঘে মিশে গিয়েছে পাহাড়
ট্রেন চলে যাবে দূরে আরও কিছুদিন বাদে
মফসসল সীমানা ছাড়িয়ে ।
দূরে নীল আকাশের ছাদে
এলোচুলে দাঁড়িয়েছে আকাশপরীরা
আর দুঃসহ হর্ম্যরাজি তারই কিছু নীচে
ঢালছে ভিক্ষুকবৃত্তি, অদৃশ্য পিরিচে।
মৃদুস্বরে এসি চলছে...ঠান্ডা সফলতা...
উড়ে যাচ্ছে স্বদেশে বিদেশে
অসফল দৃশ্যপট? তাও আছে... ঝুলে আছে পিচরাস্তা ঘেঁষে।
আজও ঢেউ ওঠে...
মাস্টারমশাই,
রাত্রি নামছে, আপনি আজও দিগন্তে দাঁড়িয়ে,
হাতে চকখড়ি
ঘন কালো ব্ল্যাকবোর্ডে, ফুটে উঠছে একটা দুটো তারা
সবাইকে মন্তব্য রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমার গান প্রসঙ্গে বলি, ও সব অনেককালের কথা। কবেই চুকেবুকে গেছে।
ReplyDeleteঅনির্বাণ, কবিতাটা আরও অনেকক্ষণ মাথায় ঘুরবে। খুব ভালো লাগল।
Sanghatik kando je, nehat-i su-gaika na hole emon guru to paoa osombhob, gaan shonar ashai roilam. chuke gachhe bolle ki chole, e sur to bholar noi.
ReplyDeleteসে আমার গুরুভাগ্য চিরদিন ভালো, ইচ্ছাডানা।
Delete