ঠাকুমার যুগ
বিয়েটিয়ের ঝঞ্ঝাটের
মধ্যে একটা ভালো খবর হচ্ছে, ঠাকুমা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। এর পেছনে কতখানি ওষুধের
জোর আর কতখানি মনের, সে নিয়ে বাড়ির সবারই সন্দেহ আছে। মেজ (এবং ঠাকুমার ফেভারিট,
যদি নিজের মুখেই বলি) নাতনির বিয়েতে যাতে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে রেখে সবাই বেশিবেশি
আনন্দ না করে ফেলতে পারে সেজন্য ঠাকুমা আদানুন খেয়ে লেগেছেন। এমনিতে ফিজিওথেরাপি
তাঁর দু’চক্ষের বিষ। রোজ সকালে ঠাকুমাকে পাঁচ পা হাঁটাতে গৌতমের ঘাম ছুটে যায়।
ঠাকুমা দার্শনিক মানুষ, নশ্বর শরীরটাকে এত মনোযোগ দিতে ভাল্লাগে না তাঁর। আমাদের
পাড়ার আরও বেশ ক’বাড়ির বুড়োবুড়ি গৌতমের ক্লায়েন্ট। রোজ সকাল ছ’টা বাজতে না বাজতে
ভটভটি চেপে গৌতম আমাদের পাড়ায় ঢোকে, তারপর ঘণ্টাদুয়েক ধরে এপাশওপাশের বাড়ি থেকে
“ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে” জাতীয় চিৎকার শোনা যায়। আমার ঠাকুমা বেশি চেঁচান না, নাতনির
মতোই তাঁরও রাগ হলে শাটডাউন করে যাওয়ার বদভ্যেস আছে, তিনি গোঁজ হয়ে মুখ বুজে সব
যাতনা সহ্য করে নেন।
সেই ঠাকুমা এখন
শুধু গৌতম আসার আগে লক্ষ্মীমেয়ের মতো দাঁত মেজে চুল বেঁধে রেডি হয়ে বসেই থাকেন
না, গৌতম চলে যাওয়ার পরেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওর দেখিয়ে দিয়ে যাওয়া এক্সারসাইজগুলো
একাএকাই যতখানি সম্ভব প্র্যাকটিস করতে থাকেন।
আর কোনও কাজ নেই
বলেই বোধহয় ঠাকুমার মাথায় সর্বক্ষণ বিয়ের কথা ঘুরতে থাকে। এই পয়লা বৈশাখের আগেপিছে
যখন বাংলা টিভি চ্যানেল আর কাগজপত্রিকাগুলো লালপাড়া সাদা শাড়ি পরা, কপালে লেপে
সিঁদুর আর হাতে কুলো আর ঠোঁটে শাঁখ ধরা মহিলার ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল, তখন একদিন হঠাৎ
হাত থেকে কাগজ ফেলে ঠাকুমা ঘরে আগুন লাগার ভাব করে “অর্চনা! অর্চনা!” চেঁচাতে শুরু
করলেন।
মা তাড়াতাড়ি
চৌকাঠ-মৌকাঠ সামলে দৌড়ে এলেন।
“কী হয়েছে মা?”
“কুলা সাজাইতে
হইব না? খালি কলকাতা গেলেই হইব?”
ঠাকুমার আরেকটা
দু’চক্ষের বিষ বাড়ির লোকের সকালবিকেল ব্যাগ দুলিয়ে কলকাতা যাওয়া। ঠাকুমা নিজে
এককালে ছেলেমেয়েকে স্কুল আর স্বামীকে অফিসে পাঠিয়ে সারাদিন কলকাতা চষে বেড়াতেন।
একাএকাই হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন, নিউ মার্কেটে বাজার করতেন। সেসব সুখ তাঁর ঘুচেছে
অনেকদিন হল। তাই এখন অন্য কাউকে কলকাতা যেতে দেখলেই ঠাকুমার গাজ্বালা করে।
মা করুণ মুখ করে
বললেন, “আর কুলো। ওসব হবে না মা, আপনার নাতনি ভেটো দিয়ে দিয়েছে।”
ঠাকুমা দু’সেকেন্ড
ভেবে বললেন, “আচ্ছা। তাহলে প্রদীপ? আমার খাটের তলায় যে বড় পিতলের প্রদীপখান আছে,
ওইটা ভালো কইর্যা মাইজ্যাটাইজ্যা রাখ, সারারাত জ্বালাইতে হইব কিন্তু।”
মা আমাকে ফোনে
জিজ্ঞাসা করলেন, “কীরে, প্রদীপ জ্বালাব? নাকি তাতেও তোর লজ্জা করবে?”
আমি খানিকটা
ঠাকুমার মুখ চেয়েই বললাম, “সে জ্বালাওগে। কিন্তু খাটের তলায় জ্বালাবে বলে দিচ্ছি,
কেউ যেন না দেখে। যত্তসব।”
সত্যি বলছি,
এই বিয়েতে আমার ঠাকুমার পারফরম্যান্স দেখে আমি মুগ্ধ। আমি ভেবেছিলাম আমার বিয়ের রকমসকম
শুনে ঠাকুমা হয় চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবেন নয় কেঁদে বিছানাবালিশ ভাসাবেন। ঠাকুমা
এর একটাও করেননি। ইনফ্যাক্ট ওসব তুচ্ছ ব্যাপারে ঠাকুমার ইন্টারেস্টেডই নন। বিয়ের
আগে তাঁর কড়িয়াল বেনারসীর ব্লাউজপিস বানানো হয়ে আসবে কিনা, একমাত্র সেই চিন্তা
তাঁকে এখন কুরে কুরে খাচ্ছে। অনেক ঘাটের জল খেয়ে ঠাকুমা চুরাশি বছরেরটি হয়েছেন,
তিনি জানেন দরজিব্যাটাগুলোকে বিশ্বাস নেই। রোজ বিকেলে মাকে একবার করে তাঁকে
সান্ত্বনা দিতে হয় যে দেবশ্রীতে ফোন করা হয়েছে, ব্লাউজ এই হয়ে এল বলে। এর মধ্যে
আবার একবার খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে কপালে কালশিটে পড়ে গেছে, তাতে দুবেলা নিয়ম করে
বোরোলিন লাগানো চলছে যাতে ১১ তারিখের আগে দাগটাগ সব মিলিয়ে যায়। এসবের ওপর মাথার
কাজ তো আছেই। অবসর সময়ে ঠাকুমা ভেবেভেবে তাঁর মগজের তূণে বাছাই করা ধারালো রসিকতার
তীর পুরে রাখছেন, যাতে তার ঘায়ে নাতজামাইকে চিৎপাত করতে পারেন।
সবকিছুর মধ্যে
একটা আধুনিকতাই ঠাকুমাকে কাবু করেছে সবথেকে বেশি। বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের ভাবভালোবাসার ব্যাপার অনেকদিন জলভাত হয়ে গেছে, আজকাল
বরং অন্যরকম বিয়ে হলেই সবাই টেনশনে থাকে। কিন্তু বিয়ের আগে যে শাশুড়ি-বউ একসঙ্গে
বেনারসী পছন্দ করতে বেরোয়, আর বেরিয়ে দুপুরবেলা দোকানে বসে চাউমিন খায় আর লাইমসোডায়
চুমুক দিতে দিতে গল্প করে, এইটা বিশ্বাস করতেই ঠাকুমার হাঁ হয়ে যাচ্ছেন।
সেদিন বৌভাতের
শাড়িটাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে ঠাকুমার পাশে বসে নিয়মমতো সারাদিন কী কী হল, কী কী কেনা
হল, কী কী খাওয়া হল এসবের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিলাম। ঠাকুমা অবাক হয়ে শুনছিলেন,
আর মাঝে মাঝে বিজলিদির দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলছিলেন, “কী দিন আইল, অ্যাঁ?”
বিজলিদি বলছিল, “সে
তো আসবেই। আপনি কী ভাবছিলেন, সবাই আপনার যুগে পড়ে আছে?”
ঠাকুমার বুক থেকে
একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরোলো শুধু।
তারপর হঠাৎ কী
ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর শ্বশুরমশাই?”
আমি বললাম, “ছিলেন
তো। ইনফ্যাক্ট কাকুই তো জুতোটা পছন্দ করে দিলেন...”
ঠাকুমার মুখটা তখন
সত্যি সত্যি বিঘতখানেক হাঁ হয়ে গেল।
আর আমি ভাবার
চেষ্টা করলাম, ঠাকুমা যখন বিয়ে হয়ে প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন তখন তাঁর কেমন
লেগেছিল। চোদ্দ বছরের একটা পুঁটলিপাকানো মেয়ে, মাঠঘাটনদীপুকুর ছেড়ে হঠাৎ কলকাতা
শহরের মধ্যিখানে, পাশে ট্রাঙ্ক হাতে একটা বয়সে বড় অচেনা লোক। বাড়িতে দাপুটে
শাশুড়ি, পালপাল দেওর ননদ, যাদের অধিকাংশের বয়সই ঠাকুমার থেকে বেশি। খিদিরপুরের
কোয়ার্টারসের সিঁড়িতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাকুমা। শাশুড়ি এসে চিবুক তুলে মুখ
দেখছেন, প্রতিবেশীরা ভিড় করে উঁকিঝুঁকি মারছে, ননদদেওররা “বৌদি, বৌদি” করে ছেঁকে ধরেছে,
আর চোখভরা টলটলে জল নিয়ে ঠাকুমা কেবল একটা কথা মনের ভেতর জপে চলেছেন, আর মাত্র তিনমাস। তারপরেই বড়দা আসবে দেখা করতে। কথা দিয়েছে।
আমি নিচু হয়ে ঠাকুমার
গলা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, “ভাগ্যিস তোমাদের যুগ আর নেই। থাকলে কী বিপদটাই না হত,
বাবারে।”
satyi bhaggish shei jug ta nei :)
ReplyDeleteসিরিয়াসলি শম্পা। ছিল যে সেটা ভেবেই আমি কূল পাই না। তবে আরও অদ্ভুত লাগে কী বল তো, একদিন আমার নাতনিও আমার যুগটার কথা ভেবে চোখ কপালে তুলবে।
Deletesotti sei jug ar nei bhagye. khub bhalo laglo tomar thakumar sustho hoe othar khabor-e.
ReplyDeleteআমরাও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি ইচ্ছাডানা, ঠাকুমা সুস্থ না হলে আমাদের আনন্দের কোনও মানেই থাকত না।
Deletethiki, tomader barite anonder haat e thakumar bhumika khubi guruttopurno :-)
DeleteSesh-er ongshota Apur Songsar mone poray..
ReplyDeleteসর্বনাশ করেছে।
Deleteকোন কথা হবে না boss.too good.হাল্কা হাসি তবে চোখের জলটাও কিন্তু ছিল । এই বরিশাইল্যা ব্যাপারটা আমাদের বাড়ির সঙ্গে খুব মেলে। কিন্তু ওই লোকগুলো আমাদের পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে । বেঁচে থাকো ।
ReplyDeleteমিঠু
আরে তোমরাও বরিশাল নাকি গো মিঠু? কেয়া বাত।
Deleteমিঠুর কমেন্টটা সেই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বইটার কথা মনে পড়িয়ে দিল, "হাল্কা হাসি, চোখের জল"; ঠাকুমার সুস্থ হয়ে ওঠার খবরে পুলকিত হলাম। বিয়ের আয়োজন বেশ জমে উঠেছে বোঝাই যাচ্ছে। ভাল ভাল। বর্ণনা পড়ে পড়ে আমরাই প্রচুর এনথু কাটলেট হয়ে উঠছি। আমার বিয়ের সময় আমি বিয়ের দিন দুয়েক আগে আর সুজয়িতা কয়েক দিন আগে দিল্লী থেকে কলকাতা পৌঁছেছিলাম, তাই এই আয়োজনের ঊর্দ্ধমুখী টেম্পোটা খুব মিস করেছিলাম। কুন্তলার বিয়ে উপলক্ষে আবার করে বেশ ভাইকেরিয়াসলি সেই অভিজ্ঞতাটা হচ্ছে। মজা লাগছে খুবই!
ReplyDeleteটেম্পো বলে টেম্পো কৌশিক? এইবার টান পড়তে পড়তে তার প্রায় ছেঁড়োছেঁড়ো হয়েছে, আর একটু কান ধরে মুললেই পটাং করে ছিঁড়ে যাবে।
Deleteবালাই ষাট! তার বেশ সুরে বাঁধা আছে, তাই তো সঙ্গীত সুমধুর হচ্ছে!
DeleteAbhishek-da ke support na kore aar parchhi na. ebar edik-odik kora chheRe just romyorochona-y mon dewa uchit. oi dis-or-dat aar quiz aar shaptahiki onyo blog-e thakuk.
ReplyDeleteআরে হবে হবে, এত তাড়া কীসের সোমনাথ? তবে তুমি যে উৎসাহ দিলে সে জন্য থ্যাংক ইউ।
Deleteআমার মনে হয় তোর 'গয়নার বাক্স' ভাল লাগবে। গুণগত মানের জন্য বলছি না। দেখতে ভাল লাগবে। শেষ আধঘণ্টা বাদ দিয়ে।
ReplyDeleteআমারও দেখার ইচ্ছে সিনেমাটা। দেখি এই উইকএন্ডে সুযোগ হয় কিনা।
DeleteKi je boli?kono sobdoi to khuje pachchi na.......just osadharon akta lekha...Ei vabei Biyer sob update pete chai.amonki Biyer din taro.debe to?
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ কুহেলি। আরে না দিলে আমারই পেট ফেটে যাবে দেখবে।
Deletebhalo lekha..thakuma darun :-) natjamaier sange rashikatata kintu thakuma didimader atyantyo priyo khela ..khub sabdhane thakte hoy...
ReplyDeleteহ্যাঁ, আমরাও সেই ভয়ে আছি তিন্নি। তবে ঠাকুমাদের সব সুখই তো গেছে, রসিকতার সুখে থাবা বসালে বড্ড দুঃখ পেয়ে যেতে পারেন। শুনেও শুনিনি ভান করে থাকতে হবে আর কি।
DeleteArey thakuma ra to duurer kotha...amar Baba-Maa r biyer golpo sunlei ami aatke uthi. ki sorbonash. ekbaar dekhe ekta meye ki kore "Hyan" bolte pare, eta ami jibobeo bujhbo na. oboshho bola uchit na, ami ki korbo tar kono thik nei. but thakuma ke amar hebby pochondo. emnitei bangal bhasha bolte para ta ke ami churanto credit mone kori, tar upor abar eto sporting! uni thakchen boss :)
ReplyDeleteসেই সুমনা, বিয়ের সময় যে কে কী করবে তার কোনও ঠিক নেই। মোদ্দা কোথা হল, যেমনই করুক না কেন, বাকি জীবনটা ভালো হলেই হল।
Deleteআমার ঠাকুমা আমার থেকে অন্তত এককোটিগুণ স্মার্ট আর স্পোর্টিং। গুরুদেব লোক যাকে বলে।
ohe K.....you will be the only "kone" je biyer korbar phanke ute ute giye laptop e tokatok type kore berachhe. aar anya dike rajyer habater dol boshe achey kakhon ekta post berobe setake chete chete khabe..eita niyei ekta post/cartoon banano jay :)
ReplyDeleteশম্পা, সেরকম করলে আমার কপালে দুঃখ আছে। আমার বাড়ির লোকদের তো চেন না, হয়তো সবার সামনেই কান মুলে দিলেন। সে রিস্ক আমি নিচ্ছি না। খুব কষ্ট হলেও ওই তিনটে দিন অফলাইন থাকতে হবে। জঘন্য।
Deletepuro ta darun, shesh ta special darun :)
ReplyDeleteআরে ধন্যবাদ শকুন্তলা।
Delete