পড়ে পাওয়া রামনবমী





রোটেশনের বাইরে চলে যাওয়া জিন্‌স্‌ পরে পকেটে হাত দিয়ে পাঁচশো টাকার নোট বেরোলে যতখানি আনন্দ হয়, আমার তার থেকেও বেশি আনন্দ হল যখন গতকাল অফিস গিয়ে শুনলাম আজ রামনবমীর ছুটি।

আমার টেবিলের ওপর একটা ছুটির লিস্ট আছে বটে, কিন্তু মনখারাপের ভয়ে আমি সেটার দিকে পারতপক্ষে তাকাই না। বোঝাই যাচ্ছে তাতে লাভ বই ক্ষতি হয় না। সবার কাছে যখন এমন খুশির খবরটা বাসি হয়ে গিয়েছিল, তখন আমি দিব্যি গোমড়ামুখে ট্রেড রিপোর্ট টাইপ করছিলাম। স্বপ্নেও কল্পনা করছিলাম না যে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাক্ষাৎ দেবদূতের মতো চিকু আমার টেবিলে খটাস করে লেমন টি-র কাপ নামিয়ে রেখে বলবে,

“সো ম্যাডাম, হোয়াট ইস ইয়োর প্ল্যান ফর দ্য লং উইকএন্ড?”

লং উইকএন্ড? বলে কী ছোকরা?

“লং উইকএন্ড কাঁহাসে মিলা তুমকো?” অনেক চেষ্টা করেও আমি গলা থেকে বিদ্রূপের ঝাঁজটা সরিয়ে রাখতে পারি না।

চিকু আকাশ থেকে পড়ে বলে, “ও মাই গড, ইউ ডোন্ট নো? কাল রামনবমী হ্যায় না?”

আমি আর একসেকেন্ড নষ্ট না করে ছুটির লিস্টের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চিকু ইস রাইট। শুক্রবার, উনিশে এপ্রিল, ২০১৩, রামনবমীর ছুটি।

চিকু সিরিয়াস মুখে উপদেশ দেয়, “শাদি কা শপিং করনে চলে যাইয়ে।”

আমার বিয়ের খবরটা অফিসে রাষ্ট্র হল কী করে ভগবানই জানেন। আমি নিজে কাউকে বলিনি, আমি নিশ্চিত আমার অফিসের কেউ অবান্তর পড়ে না। একমাত্র যে সম্ভাবনাটা বাকি থাকে সেটা হল, আমার ছুটির দরখাস্ত পাওয়ার পর আমার বস ফোন তুলে তুলে সবাইকে বলেছেন। এই দৃশ্যটা কল্পনা করতে আমার যারপরনাই অসুবিধে হচ্ছে, কাজেই আমার কাছে এই ব্যাপারটা রহস্যই রয়ে গেছে।

রাষ্ট্র হওয়াতে খুব যে অসুবিধে হয়েছে তেমন নয়। আজকাল সবাই জেনে গেছে যে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে নেই, তাই সকলেই মিষ্টি হেসে কনগ্র্যাচুলেশন্‌স্‌ বলে ক্ষান্ত দিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম স। স আমাদের অফিসের সাফাইকর্মী। হিমাচলপ্রদেশের মেয়ে, দিল্লিতে শ্বশুরবাড়ি। সে আমার বিয়ে নিয়ে আমার থেকেও বেশি উত্তেজিত। রোজ সকালে ঝাঁট দিতে দিতে সে আমার বিয়ের আপডেট নেয়।

“ম্যাডামজি, আপ অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ কর রহে হো ইয়া লাভ ম্যারেজ?”

লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হল যে লাভ ম্যারেজই করছি।

শুনে স একটু চুপ করে থেকে জানতে চাইল, “ম্যাডামজিকি মাম্মিপাপা নেহি হ্যায় কেয়া?”

স-এর দোষ নেই। ওদের গ্রামে বোধহয় একমাত্র অনাথ না হলে কোনও মেয়েকে লাভ ম্যারেজ করতে হয় না। বাবামা সৎপাত্র খুঁজে, ব্যান্ড বাজিয়ে, পটাখা ফাটিয়ে, বুক চাপড়ে কাঁদতেকাঁদতে মহাসমারোহে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে।

আমি বললাম যে আমার বাবামা দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে আছেন, কিন্তু তাঁরা আমাকে ততটাও ভালোবাসেন না কিনা, তাই আমাকে উপায় না দেখে নিজের বর নিজেই বাছতে হয়েছে। আমাকে করুণা করেই বোধহয় স এই লাইনে আর কথাবার্তা এগোয়নি। ভাগ্যিস।

যাই হোক। কাল চিকু যখন আমাকে ছুটি খামোকা বাজে খরচ না করে শাদির শপিং-এ যাওয়ার পরামর্শ দিল আমি মনে মনে মুখ বেঁকিয়ে বললাম, ইস তাহলেই হয়েছে আরকি। বয়েই গেছে আমার এই আটত্রিশ ডিগ্রি গরমে ভাজাভাজা হয়ে শপিং করতে। বাড়ি গিয়ে এই যে বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ব, সেই রবিবার সন্ধ্যের আগে আর উঠছি না।

যা হয়। অফিস থাকলে অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে উঠতে হয়, আর ছুটির দিনে অন্ধকার থাকতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দাঁত মেজে চা খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে পা দোলাতে হয়। কখন একটু ভদ্রস্থ সময় হবে, আর মাকে ফোন করে বলা যাবে, ওঠ ওঠ অনেক ঘুমিয়েছ। এবার উঠে আমাকে একটু অ্যাটেনশন দাও দেখি।

অপেক্ষা করতে করতে একটা ভালো জিনিস হল, অনেক দিন বাদে ভোর হতে দেখলাম। অন্যদিন তো ভোর ভোরের মতো আসে যায়, আমি আমার মতো ঘাড় গুঁজে গুনেগুনে টিফিনবাক্স ব্যাগে পুরতে থাকি। পাছে না খেয়ে মারা যাই। আজ সেটা করতে হয়নি। আজ আরাম করে চা খেতে খেতে পুবদিক আলো করে সূর্য উঠতে দেখতে পেরেছি। এমন সুন্দর দৃশ্য একাএকা দেখতে অপরাধবোধ হচ্ছিল বলে আপনাদের জন্য ওপরের ছবিটা তুলেছিলাম। কিন্তু ছবিতে আসল জিনিসগুলোই ওঠেনি। পাখির ডাক, হাওয়ায় দুলন্ত কৃষ্ণচূড়ার ডাল, আর পার্কটার শান্ত নিঃস্তব্ধতা। ওগুলো দয়া করে কল্পনা করে নেবেন।

তারপর তো এঘরওঘর রান্নাঘর ঘোরাঘুরি। সময় আর কাটে না দেখে অবশেষে ঘর ঝাঁট দেওয়া সাব্যস্ত করলাম। রোজ যেমন দিই, এদিকে একটা আর ওদিকে আরেকটা টান, তেমন নয়। সত্যিকারের ঝাঁট দেওয়া। মা থাকলে যেমন করে দেন। খাটের তলা থেকে কত কিছু যে বেরোলো। পেন, পেনড্রাইভ, কার্ডবোর্ডের মতো শক্ত চৌকো দেখতে একটা জিনিস। সেটা কার্ডবোর্ডও হতে পারে, পাউরুটিও হতে পারে। আপনারা যে যেটা ভাবতে চান ভেবে নিতে পারেন। আমি আর খোলসা করছি না।

এতদিন পর ঘরঝাঁট দিয়ে এত খিদে পেয়ে গেল যে দুটো লাঞ্চ করতে হল। তাদেরও ছবি তুলে রেখেছি, দাঁড়ান দেখাই আপনাদের।


লাঞ্চ নাম্বার ওয়ান

লাঞ্চ নাম্বার টু

দিন এখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আজকের দিনটা বড় ভালো কাটল আমার। অন্য ছুটির দিনগুলো, প্রত্যাশিত থাকে বলেই কিনা কে জানে, কেমন যেন গুবলেট হয়ে যায়। সেগুলোরও একটা করে নিজস্ব টু-ডু লিস্ট, সে লিস্টও শেষ না করতে পারার বিরক্তি, শেষপর্যন্ত দিনগুলোকে ছুটি বলে আর চেনাই যায় না।

আজকের দিনটা সেরকম ছিল না একটুও। এই দিনটার যেন থাকার কথাই ছিল না, হঠাৎ করে উড়ে এসে ক্যালেন্ডারে জুড়ে বসেছে। আজ আমি যে কাজগুলো করেছি সেগুলো সবটাই বাড়তি, যে কাজগুলো করিনি, সেগুলো করার কথাই ছিল না কখনও। কাজেই নো অপরাধবোধ, নো হতাশা।

এরকম আরও লক্ষ লক্ষ সত্যিকারের ছুটি আমার আপনার সবার জীবনে আসুক, এই কামনা করি।

Comments

  1. Tomaar lekha oshadharon. Abantor pori niyomito but ei prothom comment korlaam. Tomar blog aar panch ta blog er theke onek alada. Blog er USP obosshoi tomaar durdanto sense of humour.Jodi kokhono shujog ba icche hoy, amader moto jara 'Shibram' pore boro hoyecchi, eder jonne ek adhta boi likho. Chaliye jao!

    Aar Bee

    ReplyDelete
    Replies
    1. কাল দিনটা সত্যি ভালো গেল দেখছি। এই রকম একটা কমেন্ট পড়ে ঘুমোতে যেতে পারলাম। থ্যাংক ইউ আর বি। কতটা খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না। অবান্তর তোমার আরও অনেক অনেক দিন ভালো লাগবে সেটাই চাওয়া।

      Delete
  2. K jodi boi lekhe seta aamra abantor er pathakbrindo best seller kore debo :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. শম্পা, ইচ্ছাডানা, মনে থাকে যেন।

      Delete
  3. oi Cup ta dekhlei lobh lage, darun chhobi hoechhe.
    ar khaoa daoa te abar egg... :-)

    ki moja lagena eirakom pore paoa choddo anai :-).ar seta jodi ekta asto diner chhuti hoi.. Aha !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. কাপটা দিল্লি হাটে একবার দেখেই পছন্দ করে কিনেছিলাম। দরাদরিতে আমি একে ভীষণ কাঁচা, দাম কমান দাদা বলতে গেলে ভয় লাগে, যদি বকে দেয়? এই কাপটাতে একপয়সা কমায়নি, মনে আছে। কেনার পর আধঘণ্টা মন খারাপ হয়ে ছিল। ঠকে গেলাম ভেবে।

      কিন্তু কাপটা বেশ কাজে দিয়েছে। আর আপনাদেরও পছন্দ হয়েছে। পয়সা উশুল হয়ে গেছে আমার।

      Delete
    2. কাপটা আমারও বেজায় পছন্দ হয়েছে। দিল্লি হাট-টা কি? দিল্লির মত শহরে নিশ্চয় হাট বসে না!

      Delete
    3. বসে বসে আবির। শহুরে বড়লোকদের গ্রামের শখ মেটানোর জন্য দিল্লির মাঝখানে একখানা হাট খুলে দিয়েছে সরকার। সেখানে চড়া দামে এথনিক জিনিসপত্র বিক্রি হয়।

      Delete
  4. achha abantor er omelette e ota ki dhone pata na palang shaakh. besh lagchey kintu! aar cup tao darooooon!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আঃ শম্পা, এই সব জায়গায় পালংশাক বলতে নেই জান না? স্পিন্যাচ বলবে, স্পিন্যাচ। স্পিন্যাচ অমলেট, উইথ রেড চিলি ফ্লেক্‌স্‌ (বোকা বাঙালিরা যেটাকে শুকনো লংকা বলে)।

      Delete
  5. আমি এর আগে কাউকে কখনও অমলেটের সঙ্গে ডাবের শাঁস খেতে দেখিনি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ota daaber shnash na fetano doi/raita type er kichu?

      Delete
    2. ভাগ্যিস বললে স্বাগতা, আমি "ডাবের শাঁস" পড়ে দুঃখে রিপ্লাই দিতে পারছিলাম না। ওটা ঘোলের শরবত।

      Delete
  6. khub sundor lekha kuntala di, mon bhalo hoye gelo pore..tobe eita tomar lunch? seriously? mane, seriously??

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। আর লাঞ্চ দেখে মুখ বেঁকাচ্ছ কেন হে? ঘিভাত আর ফিশফ্রাই খেতে পাচ্ছি না বলে খুব আনন্দ পাচ্ছ বুঝি?

      Delete
    2. hahaha.. na na mane boddo light er dike hoye gelo kina tai..tomar roga thakar rohosyo ta bojha jachhe :)

      Delete
  7. ish Kuntala di, cup ta ki sundor!

    sotyi, shoni robi gulo ke aar chuti mone hoyna. taken for granted hoye gyache. weekday gulo te chuti hole sobcheye moja hoy. besh sokale uthe ma-r songe cha ta kheye, tuktak kichu ranna kore, dedar golpo kora jaye. robibar gulote ki rokom jyano "ki lunch hobe ki lunch hobe" ei korte kortei kete jaye. tarpor laptop e kono ekta movie chaliye diye, e ki korechilo, o ki bolechilo, sobai koto kharap, amra koto bhalo...daruun kate dinta!

    ReplyDelete
  8. lekhata khub bhalo r cup tao sundor.daber sans o vabini r ghol to noi e, ami vebechilam lichu..:P

    ReplyDelete
    Replies
    1. লিচু?! কী সাংঘাতিক।

      Delete
  9. omlette-er modhdhey abar ei shob shobuj shobuj impurity add kora keno?

    ReplyDelete
    Replies
    1. পিওর জিনিস ভয়ানক বোরিং হয়, তাই।

      Delete

Post a Comment