মোনালিসা



প্যারিসে এসেছি দুসপ্তাহ কেটে গেছে, আর তিন-তিনটে উইকএন্ড। এখনও লুভ্‌র্‌ দেখা হয়নি। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে উঠেছে। শেষরাতে বাবা ফোন করে বলছেন, এখনও যে গেলি না, একদিনে যদি কভার করতে না পারিস, দ্বিতীয়বার যাওয়ার সময় হাতে রাখতে হবে তো। আমি কোনওমতে হাই চেপে বলছি, বাবা এখনও দেড়মাস বাকি আছে। বাবা বলছেন, দেড়মাস কত তাড়াতাড়ি কাটে সেটা খেয়াল আছে তোর? তুই গেছিস কদিন হল? জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টো...এই তো চার মাস হয়ে গেল, দেড়মাস হতে কতক্ষণ?

স্থির করলাম, এই উইকএন্ডেই একটা এসপার-ওসপার করতে হবে।

একটাই রক্ষা, হোমওয়ার্কটা করা ছিল। কীভাবে যেতে হবে, কোথায় যেতে হবে, কখন যেতে হবে। লুভ্‌র্‌ খোলা থাকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছদিন। সব দিন নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, শনিরবিবার মিউজিয়াম খোলে সকাল নটায়, বন্ধ হয় ছটায়। মিউজিয়ামে কী কী দেখব সে অনুযায়ী বিভিন্ন দামের টিকিট পাওয়া যায়। আমি পার্মানেন্ট কালেকশনটাই দেখব, তাই দাম পড়বে মোটে বারো টাকা। অবশ্য পকেট থেকে একটি পয়সাও খরচ না করে লুভ্‌র্‌ দেখা যায়, প্রতি মাসের প্রথম রবিবার। সেদিন ধনীদরিদ্র সবার জন্য লুভ্‌রের দরজা হাট করে খোলা। আমার লেজেন্ডারি কিপটেমোর কথা যারা জানেন তাঁরা নির্ঘাত ভেবেছিলেন আমি এমন সুযোগ হাতছাড়া করব না, কিন্তু তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীর মুখে ছাই দিয়ে আমি পুরো দাম দিয়ে টিকিট কেটে মোনালিসা দেখাই সাব্যস্ত করলাম। কত বারো টাকা আসবে যাবে, মোনালিসা তো জীবনে একবার।

অবশ্য লুভ্‌রে ঢুকব বললেই তো হবে না, কোন দিক দিয়ে ঢুকব সেটাও ঠিক করতে হবে। মিউজিয়ামে ঢোকার চারটি দরজা আছে। তাদের মধ্যে সিংহদরজা হচ্ছে গিয়ে পিরামিড, ড্যান ব্রাউনের দৌলতে যার জনপ্রিয়তা মিউজিয়ামের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে অনেকদিন। অনলাইন ফোরামে ঘোরাঘুরি করে জানলাম, পিরামিডের সামনে সারাদিন আর্ট-অনুরাগীদের লাইন লেগেই থাকে। তাঁদের সঙ্গে ঠেলাঠেলির অমূল্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গেলে মিনিমাম ঘণ্টাখানেকের ধাক্কা। অনলাইন ফোরামে এও সতর্ক করা ছিল, পিরামিড দরজা দিয়ে না ঢুকলে লুভ্‌রে দেখাও যা না দেখাও তাই। তবু আমি ঠিক করলাম, সিংহদরজা মাথায় থাক, আমার পক্ষে ব্যাকডোরই যথেষ্ট।

ব্যাকডোর, অর্থাৎ Galerie du Carrousel. এক নম্বর মেট্রো লাইনের স্টেশন Palais Royal-Musee du Louvre, স্টেশন থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার ওপর উঠে এলেই চোখে পড়বে Carrousel du Louvre, একটি আন্ডারগ্রাউন্ড শপিং মল। চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে শপিং মলের ভেতর নেমে যাও, সোজা গিয়ে ডানদিকে বেঁকো, তীরচিহ্ন ধরে এগোও, খাঁ খাঁ টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কাটো, দুপাশে চোখ ধাঁধানো ব্র্যান্ড আউটলেটদের মাঝের প্রশস্ত বারান্দা দিয়ে হাঁটো, বেশি না, মিনিটখানেক, চোখের সামনের আবছা অন্ধকার ভেদ করে একটা আভা ফুটে উঠছে মনে হচ্ছে যেন...


দ্য ইনভার্টেড পিরামিড। নাকি চ্যালিস? ধারণের প্রতীক? নারীত্বের চিরন্তন চিহ্ন? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পালাতে পালাতে অবশেষে এর নিচে এসেই কি শয্যা পেতেছেন ইতিহাসের সবথেকে ঘৃণিত নারীটি, যার একমাত্র অপরাধ ছিল ভগবানের পুত্রকে মনুষ্যত্বে উন্নীত করা?

বাই দ্য ওয়ে, ফ্রেঞ্চরা যখন লুভ্‌র্‌ বলে তখন সেটাকে লুভ্‌, কিংবা তার কাছাকাছি শুনতে লাগে। ঘটনাটা জানার পর থেকে আমিও লুভ্‌ই বলছি। অবশ্য জায়গা বুঝে। বাড়িতে ফোন করে লুভ্‌ দেখে এলামবললে সকলে অ্যাঁ? কী দেখে এলি?” করে করে মাথা খারাপ করে দেবে, তাই বাড়ির লোকদের কাছে লুভ্‌র্‌ বলছি, সমঝদার বন্ধুদের কাছে লুভ্‌। আমার ইমপেকেবল্‌ ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ শুনে তাঁরা যথোপযুক্ত মুগ্ধ হবেন এই আশায়। অবান্তরের পাঠকমণ্ডলীর সমঝদারিত্ব নিয়ে আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহ নেই, তাই এই লেখাতেও এখন থেকে লুভ্‌ শব্দটিই ব্যবহার করা হবে।


লুভ্‌ মিউজিয়ামের ষাট হাজার ছশো স্কোয়্যার মিটার জায়গা জুড়ে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি ওয়ার্ক অফ আর্ট প্রদর্শিত আছে। রিসার্চাররা এস্টিমেট করে জানিয়েছেন, সব ঠিক করে দেখতে গেলে একজন অ্যাভারেজ মানুষের সময় লাগবে নমাস। কাজেই বুঝতেই পারছেন, একটা প্ল্যান থাকা জরুরি। আনতাবড়ি আর্ট দেখে তো লাভ নেই, যা যা দেখলে চেনা লোকদের বলতে সুবিধে হবে সে সবের লিস্ট আগেভাগে তৈরি করে ব্যাগের ভেতর না রাখলে বিপদ।


আমি রেডি ছিলাম। পায়ে কনভার্স, ব্যাগে জলের বোতল, হাতে ম্যাপ নিয়ে। আমার নিজের হাতে, অনেক সময় নষ্ট করে বানানো ম্যাপ। কী কী দেখব, সেগুলো মিউজিয়ামের তিনটে মূল উইং-এর (Richelieu, Sully, Denon) কোথায় কোন তলার কোন কোণে গোঁজা আছে---সব গোটা গোটা করে সাদা কাগজে লিখে রেখেছিলাম। একটা আর্ট দেখে পরের আর্টে কী ভাবে পৌঁছতে হবে, সব পথনির্দেশ ছবির মতো করে টুকে নিয়েছিলাম।


মিউজিয়ামে ঢুকে এদিকওদিক খানিকক্ষণ হেঁটে বুঝলাম, আমার ম্যাপের সঙ্গে বাস্তব মিলছে না। এটা কী করে ঘটতে পারে আমার মাথায় ঢুকল না। ঢুকত, যদি জানা থাকত যে মিউজিয়ামের ভেতর যখনতখন আর্টের ঠিকানা বদল হয়। আমার ম্যাপে হয়তো লেখা আছে ভেনাস দে মিলো রাখা আছে Richelieu-র একতলার পাঁচ নম্বর ঘরে, কিচ্ছু ভুল লেখা নেই, কারণ অ্যাদ্দিন ওটা সেখানেই ছিল, কিন্তু আগের সপ্তাহেই কর্তৃপক্ষ সেটাকে রেখে এসেছেন Sully-র বেসমেন্টে। ভগবানই জানেন কেন। ফেং শুই-টুইয়ের ব্যাপার আছে নিশ্চয়। ছবিটবি তাও বুঝি, কিন্তু টন-টন ওজনের মার্বেলের মূর্তি ঘাড়ে নিয়ে ঘোরাফেরা করাটা শখে হতে পারে না।


সমাধান অবশ্য হয়ে গেল চটপট। আমার ম্যাপের বদলে মিউজিয়ামের ম্যাপ দিয়ে কাজ চালাতে হল এই যা। হলের মাঝখানে ইনফরমেশন সেন্টারে বুকলেট থরে থরে সাজানো ছিল। ইংরিজিতে লেখা বুকলেটটা খুঁজে হাতে নিয়ে দেখি, খেলানো ম্যাপে উইং আর তলা ধরে ধরে রংচঙে টিপ পরিয়ে অবশ্য-দ্রষ্টব্য আর্ট আইডেন্টিফাই করা আছে। যেগুলো না দেখলে জীবন বৃথা। দুর্গা বলে যাত্রা শুরু করলাম।


আপনার যদি আর্টে বিন্দুমাত্র উৎসাহ না থাকে, বিশ্বজোড়া যুদ্ধ দারিদ্র্য অনাহারের মধ্যে এক প্রাসাদ ভর্তি রংচঙে ছবি আর পাথরের তাল দেখতে যাওয়াটা যদি আপনার সিমপ্লি কুরুচিকর বলে মনে হয়, প্রতিবাদ হিসেবে লুভে গিয়ে যদি আর কিচ্ছু না দেখে শুধু একতলার ক্যাফেটেরিয়ায় বসে Pain aux raisins সহযোগে নাতিশীতোষ্ণ কফিতে চুমুক দিয়ে কিংবা সুভেনির শপ থেকে মোনালিসার ছবি আঁকা চাবির রিং কিনে বাড়ি চলে আসেন, তবু Lisa Gherardini-র ছবিটা আপনাকে দেখতেই হবে। সাধারণ লোকে যাঁকে মোনালিসা বলে চেনে। এটা আর্ট ভালো না-লাগার প্রশ্ন নয়, এটা তার থেকে অনেক গভীরের কথা। রোজ সকালে যে আকাশে সূর্য ওঠে, আপনি কি সেটা নিয়ে প্রশ্ন করেন? কিংবা সূর্যের দিকে ফ্রি টিবেটলেখা কালো ব্যানার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন? মোনালিসা হচ্ছে মানবসভ্যতার আকাশের হাতে গোনা সূর্যদের মধ্যে একটা। এ সূর্য মানুষের নিজেরই হাতে গড়া, আর তাই তার গরিমা আসল সূর্যের থেকেও অনেক বেশি।


মোনালিসার এত কাছে গিয়ে যাতে তাকে দেখা ফসকে না যায় আপনার, সে ব্যাপারে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ভয়ানক সচেতন। লম্বা লম্বা করিডর, চওড়া চওড়া সিঁড়ি পেরোনোর সময় অবিরত চোখে পড়বে পথনির্দেশ। এই যে এইদিকে। এইবার ডান, তারপর বাঁ। একের পর এক বাঁক যত ঘুরবেন আপনি, বুকের ভেতর ঢেঁকির পাড় ততই স্পিড তুলবে। শেষ করিডরটা যে আলোকোজ্জ্বল ঘরে গিয়ে মিশেছে, সে ঘর থেকে একটা গুনগুন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আপনি ভাববেন আওয়াজটা এত চেনা লাগে কেন, কোন বিস্মৃত অতীতে যেন এই আওয়াজটাকে নিজের নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই চিনতাম আমি...ভাবতে ভাবতে ঘরের ভেতর যেই না পা রাখবেন, অমনি অতীত-টতিত সব হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ঘোর বর্তমান হয়ে এসে দাঁড়াবে।

অফ কোর্স, রেলস্টেশন।

পিলপিল করছে লোক, তাদের সম্মিলিত ফিসফিসানির চিৎকার আর মাথার ওপর তুলে ধরা স্মার্টফোনের খচাখচ---সব মিলিয়ে মোনালিসার সামনে পৌঁছে যদি আপনার অফিসটাইমের হাওড়া স্টেশনের (এয়ারকনডিশন্‌ড) কথা মনে না পড়ে, তাহলে আপনার কল্পনাশক্তির বলিহারি।


অবশ্য মোনালিসার সামনেই পৌঁছেছি কি না সেটা তখনও আমি জানি না, কারণ পাঁচ ফুট দুইঞ্চি হাইট নিয়ে আমি তখনও কেবল লোকের মাথা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। এবং পরিস্থিতি যা বুঝছি, আদৌ যে কিছু দেখতে পাব সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

অগত্যা কাজে লাগতে হল।


হাওড়া স্টেশন আর লুভ্‌ মিউজিয়ামের মোনালিসার ঘর, দুটো জায়গার মধ্যে সবথেকে বড় মিল হচ্ছে দুটোর কোনওটাই চক্ষুলজ্জা কিংবা ভদ্রতা প্র্যাকটিস করার জায়গা না। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের জিপ ঠিকমতো টেনে বন্ধ করা আছে কি না দেখে নিলাম। হাতে ক্যামেরা বন্দুকের মতো বাগিয়ে ধরলাম। (হাওড়া স্টেশনে ঠিক যে ভাবে ছাতা বাগাই।) তারপর জয় মোনালিসার জয়বলে সোজা ঝাঁপ দিলাম ভিড়ের ভেতর। ফুলের মতো টডলাররা পায়ের তলায় পিষেই গেল, না কি খুরখুরে বুড়ি দিদিমারা কানে কনুইয়ের মোক্ষম গুঁতোই খেলেন, সে দিকে বিন্দুমাত্র দৃকপাত না করে।

থামলাম একেবারে সামনের সারিতে পৌঁছে। পৌঁছতেই ভিড়ের রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। রেলিং-এর গায়ে লাইন দিয়ে নারীপুরুষেরা দাঁড়িয়ে আছেন। সামান্য বিভঙ্গ তোলা শরীর, কোমরে হাত, মুখে অবিকল মোনালিসার মতো মুখটেপা মৃদু হাসি। হাসিটা না থাকলে দৃশ্যটা অনেকটা ফায়ারিং রেঞ্জের মতোই দেখাত। বন্দুক অর্থাৎ ক্যামেরা হাতে নিয়ে নাকের ডগায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন যার যার সঙ্গী। খচাৎ খচাৎ শাটার পড়ছে উঠছে, ফোটোগ্রাফারেরা চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে ভুরু কুঁচকে ভিউফাইন্ডারে নিজের সৃষ্টি দেখছেন, লিওনার্দোর ছবির মতো ভালো হয়নি দেখে মাথা নেড়ে আবার সাধনায় নামছেন। আবার শাটার পড়ছে, উঠছে।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোনালিসাকে দেখলাম। মোনালিসার কোলের ওপর জড়ো করা দু'হাত, মাথার ওপর স্বচ্ছ কালো আস্তরণ, দুকাঁধের দুপাশের দুটি বেমানান দিগন্তরেখা, বাঁ কাঁধের ওপর থেকে খসন্ত আঁচল, অদৃশ্য ভুরুর তলায় নিভন্ত দুটি চোখ। আমি যেদিকেই যাই, সে চোখ আমার চোখ থেকে দৃষ্টি সরায় না।  

আর দেখলাম মোনালিসার হাসি। পাঁচশো বছর ধরে যে হাসির অর্থ খুঁজতে মানুষ মাথা কুটে মরেছে। শেষে হাল ছেড়ে রেগে গিয়ে বলেছে, হাসি না ছাই, ফোকলা দাঁত ঢাকতে গিয়ে ঠোঁট ওইরকম ছেতরে গেছে। কম্পিউটার অনেক হিসেবটিসেব কষে বার করেছে, মোনালিসার হাসির উপাদান হচ্ছে তিরাশি শতাংশ হ্যাপিনেস, নয় শতাংশ বিরক্তি, ছয় শতাংশ ভয় আর দুই শতাংশ রাগ।

হাসি তো অনেক তুচ্ছ জিনিস, মোনালিসা আসলে কে, সেটাও তর্কের ব্যাপার। ধনী বণিকপত্নী, নাকি লিওনার্দো নিজেই? নাকি লিওনার্দোর প্রিয়তম শিষ্য (এবং লিওনার্দোর বেশ কয়েকটি ছবির অফিশিয়াল মডেল) Salaì?

রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি এইসব ভাবতে লাগলাম। ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে ভাবলেও হত, পিঠের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছিলও, কিন্তু আমি নড়লাম না। মডেলেরা সব মোনালিসার ঠিক সামনের অংশটুকু দখল করে দাঁড়িয়ে আছেন, কাজেই আমি মোনালিসাকে দেখছি সাইড থেকে। তাতে জগতের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছুই হচ্ছে না, কিন্তু আমার জেদ চেপে গেছে। আমি মোনালিসার ছবি দেখব একেবারে সামনে থেকে। একএক করে মডেলরা মঞ্চ ছাড়তে লাগলেন, আর আমিও ইঞ্চিইঞ্চি করে মোনালিসার দিকে এগোতে লাগলাম। এত কষ্টের কেষ্ট অবশেষে মিলল। ক্যামেরা চোখ থেকে নামিয়ে, মোনালিসাকে শেষবারের মতো একবার দেখে নিয়ে আমি ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে এলাম।


জম্মের মতো একটা কম্ম সারা হয়ে গেল। এবার শান্তি করে বাকি মিউজিয়ামটা দেখা যাবে।

মোনালিসা ছাড়াও লুভে আরও অনেক কিছু দেখার আছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। লুভের ভেতরটা তো দেখার মতো বটেই
, বাইরেটাও চোখ চেয়ে দেখার মতো সুন্দর। লুভ্‌ আসলে হচ্ছে বারোশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ফিলিপের আমলে বানানো একটি দুর্গ। হাত এবং চেহারা দুইই বদলাতে বদলাতে শেষে লুভ্‌ এসে পড়ে চতুর্দশ লুইয়ের হাতে। লুইরাজার জামাকাপড়জুতোমোজার জন্য লুভে জায়গা কম পড়ছিল, তাই তিনি ষোলশ বিরানব্বই সালে লুভ ছেড়ে চলে গেলেন ভার্সাই প্রাসাদে। আর সেই প্রথম লুভ্‌ ব্যবহার হতে শুরু করল রাজার আর্ট-সংগ্রহের প্রদর্শনী হিসেবে।


এই হচ্ছে তৃতীয় নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড সালোন।

আর এই হচ্ছেন তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজে। প্রজাদের টাকা মেরে নিজের বাড়িতে ঝাড়লন্ঠন ঝুলিয়েছেন।

নেপোলিয়নের অগাধ ঐশ্বর্যের কিছুই আমার চাই না, কেবল বাঁদিকের ওই জানালার কোণটার ওপর বড় লোভ জেগেছে আমার। জানালার পাশে বসে আমি আর অর্চিষ্মান আনন্দবাজার পড়ব, আর এই কাপদুটোয় করে টাটা গোল্ড খাব। ভালো হবে না?


এটা কী বলতে না পারলে বুঝব, ক্লাস সেভেনের ইতিহাস ক্লাসে কিচ্ছু শুনছিলেন না, জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিলেন কখন টিফিন হবে। ইনি হচ্ছেন লে কোড দে হামুরাবি। আমি জানি না কেন, এত কিছুর মধ্যে এটা দেখেই আমার সবথেকে বেশি উত্তেজনা হয়েছে।            

লুভ্‌ আমার কেমন লাগল? আর্টের লিস্ট যখন টিক মারতে মারতে প্রায় শেষ, জলের বোতল ফাঁকা, বুড়ো আঙুল টনটনাচ্ছে, তখন বুকের ভেতর বেশ একটু দুঃখ দুঃখই টের পাচ্ছিলাম। পাঁচঘণ্টা হেঁটে, পঁয়ত্রিশ হাজারের মধ্যে মধ্যে মেরেকেটে গোটা পনেরো শিল্পকর্ম মন দিয়ে দেখেছি আমি। তাও নিতান্ত আনাড়ির মতো দেখা। ওপর ওপর। রংচঙে ছবির মেয়েটার মুখের হাসিটাই দেখছি শুধু, কত সূক্ষ্ম কারুকাজ ওই হাসিতে লুকিয়ে আছে, ঠোঁটের ওই ভঙ্গিটুকুর পিছু ধাওয়া করতে পাঁচশো বছর আগে একটা লোকের কত রাত নিদ্রাহীন কেটেছিল, তার বিন্দুমাত্র আন্দাজও কি আমার আছে? আর সেটা না থাকলে কি ছবিটার মর্ম উপলব্ধি করা আমার পক্ষে সম্ভব? মর্মের কথা যদি ছেড়েও দিই, কত কিছুর দিকে তো তাকিয়েও দেখলাম না। বিখ্যাত শিল্পীদের বিখ্যাত শিল্পদের ছায়ায় কত কিছু মুখ লুকিয়ে রইল। সেগুলোও তো অনেক যত্নের সৃষ্টি, অনেক পরিশ্রমের ফসল।

      
হাঁটতে হাঁটতে গলা চুলকোতে গিয়ে সিলিং-এর দিকে অজান্তে তাকিয়ে ফেলবেন, আর এই রকম সব দৃশ্য ভেসে উঠবে আপনার চোখের ওপর। সিলিং-এর গায়ে, সিঁড়ির তলায়, ঝুলবারান্দার রেলিং-এ, কত আর্ট যে বৃথাই অপচয় হচ্ছে লুভে, তার ইয়ত্তা নেই। কেউ দেখছে না, কেউ হাততালি দিচ্ছে না, কেউ ছবি তুলে ইনস্টাগ্র্যামে আপলোড করছে না। এতদিন যখন করেনি, আর করার আশাও নেই।


তাই বলে কি তাদের একটাকে চুপিসাড়ে সরিয়ে নিলে কিছু কম পড়বে না কোথাও? মোনালিসার ঘরের দরজার বাইরে যে একলা দেবশিশুটি গালে হাত দিয়ে বসে আছে, তার মণিহীন দু’চোখে বিষাদ যদি অত নিখুঁত নাই ফুটত, তাহলেও কি কারও কিছু এসে যেত?

যেত। সেই যে অনেকদিনের কথাটা জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধরার ধূলায় যত হোক অবহেলা”---লুভের সম্পদও ঠিক তেমনি। আমার মতো অপোগণ্ডের দল ঝাঁক বেঁধে আসবে যাবে, হইহই করে মোনালিসার ছবি তুলে রইরই করে ফিরে যাবে। আমাদের মূল্যায়নের আশায় লুভ্‌ বসে নেই। মানুষের অবিশ্বাস্য অস্তিত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণ বুকে নিয়ে সে নিজের গর্বেই নিজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।


রু দে রিভোলি ধরে মেট্রোস্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ থেকে ফোন বার করে নম্বর টিপলাম। লুভ্‌র্‌ দেখে বেরোলাম বাবা।” “দেখলি!বাবার গলায় উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে। লেডি অফ দ্য রক্‌সের ছবিটা দেখলি সোনা? সেই যে যার পেছনে ল্যাংডন্‌ সেই চাবিটা খুঁজে পেয়েছিল?”

রাস্তার গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ছাপাতে গিয়ে গলা বেশ খানিকটা তুলতে হল আমাকে। দেখলাম তো..."

Comments

  1. স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, মা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে তো সুচিত্রা আর শীর্ষেন্দু লিখেই চলেছেন, লাঠিপেটা না করলে থামবেন না... ও পথ মাড়িয়ে লাভ নেই। সব গল্পই ব্যারাকপুর থেকে ঠাকুরপুকুরের মধ্যে, সেই একই চর্বিতচর্বণ।

    আপনি ভ্রমণকাহিনী লেখা শুরু করুন, আপনার জ্ঞানপীঠ ঠেকায় কে। সাহিত্য আকাদেমিও বেশ ভালো টাকাপয়সা দিচ্ছে আজকাল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেবাশিস, একেবারে বাও করে থ্যাংক ইউ বললাম। আজ সারাদিন ভালো কাটবে কোনও সন্দেহ নেই।

      Delete
    2. দেবাশিসের সঙ্গে একমত।
      মিঠু

      Delete
    3. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ মিঠু।

      Delete
  2. বাব্বাহ! এ তো ১ কুইন্টাল আঁতলেমি!

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্মৃতিলেখা, এবার আমাকে প্রতিবাদ করতেই হচ্ছে। আমি বেঁটে, মেরুদণ্ডহীন, অসৎ সব হতে পারি, কিন্তু একটা জিনিস আমি নই, সেটা হচ্ছে আঁতেল। কাজেই আঁতলেমো করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

      Delete
    2. হালকা অস্বস্তি হল বলে মন্তব্য করছি- @কুন্তলাদি: আঁতেল নও বলছো মানে ওটা একটা গালি বলে মনে কর, তাই তো? সকলেই করে প্রায়- আর পারলেই অন্যকে আঁতেল বলে... তাই বহুদিন থেকে এর মানে জানার শখ। আপাত-সর্বজ্ঞ গুগ্‌ল্‌ কে জিজ্ঞেস করায় প্রথমে এক লাইনের উত্তর- (http://www.ebangladictionary.com/4640)
      তারপর পাতাজোড়া- (http://bit.ly/1gYQKY3)
      যার শেষ কথা:
      "যদি আমিও জানি / পারি, তুমিও জানো / পারো : তা ভালো
      যদি আমিও জানি না / পারি না, তুমিও জানো না / পারো না : তাও ভালো
      যদি আমি জানি / পারি, তুমি জানো না / পারো না : তা সবচেয়ে ভালো
      যদি আমি জানি না / পারি না , কিন্তু তুমি জানো / পারো : তাহলেই তুমি আঁতেল"

      এ যদি ঠিক হয়, তবে কি আঁতেল হওয়া খারাপ? (যখন এটা পরিষ্কার যে আঁতেল এর সংজ্ঞা আপেক্ষিক?)

      Delete
    3. এই দেখো, তুমি ঠিক সেই কথাটা বলছ সুনন্দ, যেটা আমি পাঁচবছর আগে বলতাম। (তার মানে কিন্তু এটা একেবারেই বলতে চাইছি না যে আমার থেকে তোমার ম্যাচিওরিটির বয়স পাঁচ কম। আর পাঁচবছর পৃথিবীর ঘানি টানলে তুমিও হুবহু আমার কথারই প্রতিধ্বনি করবে, একেবারেই সেরকম কিছু বলতে চাইছি না।) আমি একসময় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম আঁতেল কথাটা গালি হতে পারে না। আফটার অল কথাটা 'ইন্টেলেক্ট' থেকে এসেছে। আর ইন্টেলেক্ট কি খারাপ হতে পারে? কখনও?

      আসলে পুরোটাই প্রসঙ্গের ব্যাপার। আমার স্মৃতিলেখার কমেন্টটা পড়ে মনে হয়েছে, যে 'আঁতলেমো'টাকে আমরা গালি দেওয়া অর্থে ব্যবহার করি, উনি সে অর্থে করেছেন। তাই অত জোরে মাথা নেড়েছি। (এইবার আরেকটা বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, জঘন্য। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, আমার অ্যাকশনকে ভালো 'আঁতলেমো' দিয়ে বর্ণনা করলে আমি মিষ্টি হেসে মৌনং সম্মতি লক্ষণম্‌ করে মাথা হেলাব। মরে গেলেও না।)

      আঁতেলের সংজ্ঞা আপেক্ষিক এ নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু যে সাপেক্ষেই দেখ না কেন, আমি যে কোনওদিক থেকেই আঁতেল নই, সে নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই।

      Delete
  3. ^Eita amio support koti. Durdanto lekha. Sahityo Akademir paisa diye arekbar (Archishman soho) Louvre dyakha hoye jete parey. :D

    ReplyDelete
  4. E baba. Ami Debasisher commenter dikey arrow dekhiechhilam. Smritilekhar noy. Slight keche gachhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে কিচ্ছু কাঁচেনি বিম্ববতী। লেখা ভালো লেগেছে জেনে নিতান্ত পুলকিত হয়েছি। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. shotti bhromon kahini lekho..amar Louvre dekhar mugdhota ta abar khujey pelam tomar lekhar modhye diye!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধন্যবাদ পৌষালি।

      Delete
  6. satti ato bhalo laglo pore ....:)

    ReplyDelete
  7. Paris ami Jaini,kono din jabo kina Tao Janine...Kintu tomar lekha pore manash bhromon hoye gelo...onek din age Buddhadeb Guhar "ektu ushnotar jonno"porechilam....porei Mccluskeygunge berabar icche hoyechilo....sherokomi Paris jete icche korche

    ReplyDelete
    Replies
    1. রণিতা, আমি তোমার এই কমেন্টটার উত্তর দিতে এতদিন দেরি করলাম কেন ভগবানই জানেন। প্রতিবারই দেখি, আর ভুলে যাই। সত্যি সরি।

      আমি নিশ্চিত প্যারিসে তুমি আসবে, মোনালিসাও প্রাণ ভরে দেখবে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আমারও খুব যাওয়ার ইচ্ছে, এখনও যাওয়া হয়নি। জঘন্য ব্যাপার।

      Delete
  8. apni ke moshai .. emon kore moner kotha bolte paren .. bhari bhalo laglo lekha ta pore .. mon chhuye gelo .. ar kono comment pochhondo na hole dukhkho / raag korben na .. folonto gaachei dhil maara hoy .. erokom lekhar capa oneker i nei :) .. ei proshonge bhebe newar jonno chomotkar provision ache bangla bhashaye .. NIKUCHI KORECHE .. likhe jaan please

    arekta kotha .. bangla horof pore jeno monta aro bhalo laage .. thank you

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। অবান্তরে স্বাগত। বাংলা হরফের কৃতিত্বটা অবশ্য আমার না। আমি ইংরিজি স্ক্রিপ্টেই লিখে যেতাম, যদি না হিতৈষীরা সদুপদেশ দিতেন।

      Delete
  9. অসাধারণ লেখা কুন্তলা। কত লোকই তো কত জিনিস দেখতে যায়, আপনার মতন করে সবাই বর্ণনা করতে পারে কই?

    আমার সঙ্গে মোনালিসার সম্পর্কটা একটু ব্যক্তিগত, যদিও দেখা হয়নি এখনও। আমি যখন খুব ছোট, তখন দেখেছিলাম আমার দাদুর ঘরে টাঙানো বিরাট ফ্রেমে বাঁধানো খানিকটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হাসি-হাসি এক মহিলার ছবি। কার ছবি জানতে চাওয়ায় শুনি মোনা লিসা। আমার তখন যে বয়েসটা, তাতে মোনালিসা কি, বা দা ভিঞ্চি কে সেসব বুঝিয়ে লাভ ছিলনা, তাই মনা লিসা আমার কাছে বাড়ির আর পাঁচটা অবিচ্ছেদ্য অংশের মতন থেকে যায়। যেমন বাবা, মা, দাদু, ঠামু আছে, তেমনি নিল আলখাল্লা পরা রবীন্দ্রনাথ আর মোনা লিসা আছে। পরে জেনেছিলাম ওই ছবিটা লুভ্‌ থেকেই আমার দাদুর এক ছাত্র এনে দিয়েছিলেন দাদু কে। তারও অনেক পরে প্রমান সাইজের একটা মোনালিসার প্রিন্ট বাবা নিয়ে এসেছিল লুভ্‌ থেকে, যেটা আমাদের এলাহাবাদের বাড়িতে শোভা পেত। সে প্রিন্টে রঙের প্রতিটি ফাটল দেখা যেত। সেটাও ঘন্টার পর ঘন্টা দেখেছি। আপনি আমাদের বাড়ি এলে বাইরের ঘরে ঢুকলেই সেটা দেখতে পাবেন।

    আর ওই লুভ্‌ মিউজিয়ামের ছাদ রেলিং ইত্যাদির কাজ কিছু হলেও আমি দেখেছি বাবার তোলা ছবিতে। তখন তো ফিল্মের যুগ ছিল, না এত ছবি তোলা যেত, না এত লো লাইটে ছবি তোলা যেত, আর না এত আপলোড করার ব্যবস্থা ছিল। তবে আপনি আমাদের বাড়ি এলে একটা মহাভারত সাইজের অ্যালবাম পেড়ে দেখাব।

    ছবিগুলো খুব ভালো হয়েছে, আর আপনার লেখার সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই। আপনি চালিয়ে যান, আমাদের বেশ ফ্রীতে ইউরোপ টুর হচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সুগত। এতদিন হয়ে গেল, এখনও আপনার প্রশংসা যে কতখানি মাইলেজ দেয়, বলে বোঝানো শক্ত।

      বেশি দূর তো নয়, একদিন আপনাদের বাড়ি গিয়ে মোনালিসার ছবি দেখে আসব। আর কাকুর প্যারিসের অ্যালবাম।

      Delete
  10. jodio onek deri holo. tobu purota pore ar chhobi dekhe je mugdho hoe gelam seta tomake janie gelam.'আর্ট-সংগ্রহের' galpe mugdho. :-)


    ReplyDelete
    Replies
    1. কিচ্ছু দেরি নয় ইচ্ছাডানা। আপনার মোনালিসার গল্প পড়ে ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment