শব্দ
সুপারমার্কেটে
নিয়ে যাওয়ার আগে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তালাচাবি বুঝিয়ে দিতে দিতে ওয়াফা বলেছিল, “অ্যানাদার
থিং, প্লিজ ডু নট মেক নয়েজ, আদারওয়াইজ...” এটুকু বলে চোখ তুলে ওপরতলার দিকে দেখিয়ে
বাকিটা শেষ করেছিল।
“ক্রেজি পিপ্ল্
লিভ হিয়ার। অ্যাবসলিউটলি ক্রেজি।”
ক্রেজি শব্দটা
বলার সময় ওর কাজলটানা বড় বড় চোখদুটো এমন ভঙ্গিতে পাকিয়েছিল ওয়াফা যে হাসি পেয়ে
গিয়েছিল আমার। ওকে আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, কোনও ভয় নেই। পাগল প্রতিবেশীদের চটানোর
মতো জোর আমার গলায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওয়াফা জবাব দিয়েছিল, সে নাকি আমাকে
দেখলেই বোঝা যায়। বয়স কচি হলে কী হবে, ভাড়াটে দেখে দেখে লোক চেনা হয়ে গেছে ওর এখন।
কার ঝামেলা পাকানোর ক্ষমতা কতখানি সে ও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধরে ফেলতে পারে।
কিন্তু আমি যেটা
ধরতে পারিনি সেটা হচ্ছে যে আওয়াজ করার লোক বাড়িতে একা আমি নই। ল্যাপটপের দিকে
তাকিয়ে যখন বসে থাকি, মুখে রা কাড়ি না, অনেক সময় নিঃশ্বাসও ফেলতে ভুলে যাই, তখনও
আমার চারপাশে, ওপরনিচে, কারা যেন শব্দ করে। খুটখাট, মচমচ, ধুপধাপ।
কাঠের মেঝে
এইজন্য আমার এত অপছন্দ। শুনতে রোম্যান্টিক, দেখতে ভালো, কিন্তু দুর্বল হার্ট লোকের
পক্ষে প্রাণঘাতী। আমার হৃদয় শক্তপোক্ত এ অপবাদ আমার শত্রুরাও দিতে পারবে না, কাজেই
আমার পক্ষে তো ভালো নয়ই। একসপ্তাহ আগে যখন বাড়িটার সঙ্গে ভালো করে আলাপ পরিচয়
হয়নি, দু’চারটে কোণাঘুঁজি তখনও নেড়েচেড়ে দেখা বাকি আছে, দরজার পেছনের ছায়াছায়া
কোণগুলোকে যখন এতটাও হার্মলেস মনে হচ্ছে না---তখন নিজের চারপাশে
অবিরাম শব্দ শুনতে পেতাম আমি।
ডাইনিং টেবিলে
বসে ঝড়ের বেগে টাইপ করছি, এমন সময় হঠাৎ খট্ করে একটা শব্দ।
আমার পেছন দিক
থেকে এসেছে শব্দটা। আমার আঙুল থেমে গেছে, শব্দটাও। ভুল শুনেছি? মাথা বলছে শুনতেও
পারি, মন বলছে তুমি জান তুমি ঠিক শুনেছ। আরেকবার শব্দটা হলেই ল্যাঠা চুকে যায়,
কিন্তু সে হওয়ার জো নেই। আমার ঘাড়ের পেছনে লম্বাটে আলোআঁধারি ফ্ল্যাটটা ঘাপটি মেরে
শুয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে মজা দেখছে, আমি উঠে আওয়াজের উৎস সন্ধানে বেরোই কি না।
না বেরোনো ছাড়া
আর কী অপশন আছে আমার?
কলজেটা হাতের
মুঠোয় চেপে ধরে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ি। ডাইনিং রুম, লিভিং রুম পেরিয়ে তবে শোয়ার ঘর।
লিভিং রুমের দেওয়াল জোড়া কাঠের ক্যাবিনেটের কয়েকটার পাল্লা পুরো বন্ধ হয় না।
সেগুলোর ফাঁক দিয়ে ঘুরঘুটি কালো অন্ধকারেরা উঁকি মেরে আমাকে দেখে। পায়ের নিচে প্রবল
ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলে হেঁটে আমি শোয়ার ঘর পর্যন্ত পৌঁছই। চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে
দেখি। কোথাও কিছু নেই।
ভীষণ ভয় লাগত
প্রথম প্রথম। রাতে বিছানায় শুতে গিয়ে কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ প্যারানর্ম্যাল
অ্যাক্টিভিটিস্-এর দৃশ্য ঝলক দিত মাথার ভেতর। ঘুমন্ত মেয়েটাকে লেপের ভেতর থেকে
বার করে মেঝের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। ভীষণ শীতে হঠাৎ শরীরের সমস্ত রোমকূপ
কাঁটা। বাড়িভর্তি অজানা ভূতপ্রেতের বদান্যতার কাছে নিজের নিরাপত্তা গচ্ছিত রেখে
লেপের তলায় আত্মগোপন করা ছাড়া আর কিছু করার থাকত না আমার।
সাতটা দিন আর
সাতলক্ষ অকারণ শব্দ অনুসন্ধানের পর বুঝেছি, বুড়ো বাড়িটা এমনি এমনিই আওয়াজ করে।
আড়মোড়া ভাঙে, শব্দ করে হাই তোলে, দু’হাতের দশ আঙুল মটকায়। আমার ঠাকুমার মতো। খাটে
শুয়ে শুয়ে হঠাৎ ভীষণ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে, “মা গো...”। শুনলে মনে হবে কত কষ্ট,
কিন্তু আসল ব্যাপারটা হচ্ছে ঠাকুমার সঙ্গে কেউ কথা বলেনি অনেকক্ষণ। মা হিন্ট ধরতে
পেরে পর্দা সরিয়ে ঠাকুমার ঘরে ঢোকেন। “ঠাকুর দেখতে যাইবা না তোমরা?” মা মুখব্যাদান
করেন, “যা ভিড়।” ঠাকুমা গত আড়াই বছর ধরে ফাঁকা ঘরের বিছানায় একলা শুয়ে আছেন, ভিড়
যে কেন কারও খারাপ লাগবে সেটা তাঁর কাছে রহস্য। ঠাকুমা মায়ের অজুহাত এককথায় নাকচ
করে দেন। বলেন, যতই ভিড় হোক, মাদুর্গাকে প্রণাম করে আসতে। মায়ের ছোটবৌদি যে শাড়িটা
দিয়েছে, মা চাইলে সেটা পরে যেতে পারেন। এক্সট্রা হেল্পফুল হয়ে মাকে পরামর্শ দেন
ঠাকুমা।
এই বাড়িটারও
ঠাকুমার মতো একা লাগে বোধহয়। হয়তো আমার আগের ভাড়াটের দুটো ছোট ছোট বিচ্ছু বাচ্চা
ছিল, গলার স্বর অকারণে সপ্তমে তুলে করে হয়তো তারা দৌড়োদৌড়ি করত সারাদিন। তাদের মা
হয়তো রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে তাদের বকতেন। এত চেঁচামেচি শুনে ক্রেজি
প্রতিবেশীদের কেউ কেউ ওয়াফাকে নালিশ করেছিল, সেটাও হতে পারে। বাড়িটার খারাপ লাগত কি
না কে জানে। তারা চলে গিয়ে এই যে একাবোকা আমি এসেছি, সারাদিন ঘরে থাকি না, যতক্ষণ
থাকি ততক্ষণও শ্মশানের নীরবতা, হয়তো এটাই অসহ্য লাগে ওর। তাই ছল করে মাঝে মাঝে
আওয়াজ করে আমার প্রতিক্রিয়া দেখে। গোটা বাড়িটা একবার হাঁটিয়ে নেয়।
তাই এখন টুকটাক শব্দ হলে সেটা অগ্রাহ্য করি। ইউটিউবে
জোরে গান চালিয়ে দিই। যাতে আমাকে জ্বালাতন করার বদলে গান শুনে টাইমপাস হয় বাড়ির।
কদ্দিন দেবে জানি না, তবে আপাতত টোটকাটা ম্যাজিকের মতো কাজ দিয়েছে।
aijonne boli eto bhuter cinema dekhben na...
ReplyDeleteহাহা সৌমেশ, আমার মাও তাই বলেন।
Deleteক্রেজি পিপ্ল্ er sange dekha hoyeche ?!...ami bhuter chabi dekha bandho kore diechi ...eka thaklei bidghute sab drishyo mone pore ...
ReplyDeleteসিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে তো দেখা হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বাইরে থেকে দেখে তো বোঝা যায় না কে ক্রেজি আর কে নন-ক্রেজি। সকলকেই দু-পেয়ে মানুষের মতো দেখতে লাগে। সিরিয়াসলি, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা ভুলে যাই, ভূতুড়ে দৃশ্য কেন ভুলি না কে জানে।
DeleteAha. Paris er bhoot nishchoi khub "cultured" hobe. Nidenpokkhe ektu aantel proshno korte pare. Bhoy toy dekhabe na asha kora jay.
ReplyDeleteযত কালচারড হোক না কেন বিম্ববতী, আমাদের ভুশুণ্ডির মাঠের ভূতেদের থেকে বেশি কালচারড কিছুতেই হবে না।
Deleteparis e ekta ghost walk hoy.....notre dame theke start kore....besh bhalo bhabe historical context rekhe guide ra bhuter goppo boley. tate marie antoinette e bhut kokhon kaar ghar e pore tar goppo o boley. parle ota niyo.
ReplyDeleteতাই নাকি? খোঁজ নিয়ে দেখব তো। থ্যাংক ইউ শম্পা।
Deletedarun laglo lekhata :)
ReplyDeleteami kintu recently ektu sahosi hochi, sedin aka aka raate bose akta serial killer er chobi dekhechi.. boro hochi mone hoche :P
ধন্যবাদ ধন্যবাদ স্বাগতা। করেছ কী, রাত্তির বেলা সিরিয়াল কিলিং? সত্যি বড় হয়ে গেছ দেখছি।
Deleteকুন্তলা, তুমি কি ভূতে বিশ্বাস কর? আমি কিন্তু করিনা। বুক বাজিয়ে বলি, অনেক লেকচার দেই, লজিক্যালি প্রমাণ করেই ছাড়ি যে ভূত বলে কিছু নেই। তবুও কে যেন আমায় অনেক রাতে দরজার আড়াল থেকে দেখে। কখনো সখনো স্যাঁৎ করে এপাশ থেকে ওপাশ সরে যায়। গভীর রাতে বাথরুমের দরজা খুলতে গেলে মনে হয় দরজার ওপারে কে যেন আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
ReplyDeleteপ্যারিস হল খানদানি ভূতেদের আস্তানা। চোখে প্যাঁশ্নে লাগিয়ে হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে ভূতেরা যখন সান্ধ্যভ্রমণে বের হন, তুমি তাঁদের হ্যালো বলেছো তো? তুমি যদি ইউটিউবে ভালরকম একটা মালকোষ বাজাও, তবে খানিক পর পিছনে ফিরলে হয়তো দেখবে এদেশের মুস্কো খোট্টাই ভূতগুলোও হাজির হয়েছে উবু হয়ে বসে গান শুনতে। ওরা যে মালকোষ শুনতে বড্ড ভালবাসে। তথ্যটা অবশ্য শরদিন্দুর গল্প থেকে জোগাড় করা গেছে।
মালবিকা, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় পাই। আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারটা খুবই মিলেছে দেখতে পাচ্ছি। সর্বনাশ করেছে, আমি গত ক'দিন খুবসে আমির খানের মালকোষ শুনছিলাম, তাতেই বোধহয় বাস্তুভূতেরা অত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। মালকোষের ছায়া পাড়ানো যাবে না দেখছি এবার থেকে। ভাগ্যিস বললেন, থ্যাংক ইউ।
Deleteআরে আমার আমেরিকায় এসে ঠিক এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একা একা কাঠের বাড়িতে থাকা যে কি ভয়ের কি বলব! আমাদের বেসমেন্টে আবার একটা পয়সা ফেলা ওয়াশিং মেশিন ছিল, যাতে কোয়ার্টার ফেলে কাপড় কাচতে হত, কিন্তু আমার বাড়িওয়ালা পয়সা নিতেননা, তাই পয়সার ট্রেটায় চাবি খোলা থাকত আর কয়েকটা কোয়ার্টার রাখা থাকত। আমরা কাপড় কাচার সময়ে ঐখান থেকেই পয়সা বের করে ঐখানেই আবার ফেলে মেশিনটা চালু করে দিতাম। মাঝে মাঝেই একেকটা কোয়ার্টার স্লটে ফেলার পর ট্রেতে না পড়ে হঠাত কোথায় চলে যেত আর পাওয়া যেতনা। আমার বাড়িওয়ালা ঠাট্টা করে বলতেন ওটা এই বাড়ির আগের মালকিন, তাঁর ভাগের পয়সা আদায় করছেন। সেটা শুনে আমি ওনার সামনে খুব হি হি করে হাসতাম বটে, কিন্তু একা বেসমেন্ট থেকে লন্ড্রি নিয়ে ওঠার সময়ে যখন কাঠের সিঁড়িতে একটা অদৃশ্য পায়ের আওয়াজ পিছন পিছন উঠত তখন সেটা মনে পড়ে গলা শুকিয়ে যেত। এ প্রসঙ্গে বলি ভুতের সিনেমা ভালো লাগলে "The Conjuring" দেখতে পারেন, একটু ক্লিশেড হলেও আমার ভালো লেগেছে।
ReplyDeleteOre baba. Conjuring dekhe ami bejay bhoy peyechhilam. Amar oboshyi bhoyer cinemar tolerance level ta kom. :/
Deleteসুগত, আপনার বাড়িওয়ালার রসিকতার বলিহারি যাই। ভূতের সিনেমা দেখা আমার কাছে অনেকটা নিজেই নিজের পিঠে চাবুক মেরে আনন্দ পাওয়ার মতো। সিনেমাটার নাম যখন বললেন, তখন দেখব নিশ্চয়, কিন্তু একা নয়, এই বাড়িতে তো নয়ই।
Deleteবিম্ববতী, আমারও টলারেন্স লেভেলও তোমার থেকে খুব বেশি উঁচুতে হবে না আমি শিওর। তবু দেখা চাই।
amio bhut nei bhut nei kortam TILL mauna kea trip in hawaii. observatory'r theke firbar raastay emon sho sho awaaj aar gari'r steering ta nije nije ghure jachhilo (on god father mother, i never held the wheel so hard in all my life)....pechoner seat er passenger ra chil chitkaar korchey ora rear window theke kemon ekta awaj pachhe. edike GPS constantly bole jachhe "leave road and go onto unpaved path"....aami GPS-phiPS chere tokhon shoja raasta dhorlam. pore rental car ta return korte gelam jakhon tokhon lok ta bollo je oi raastay sondhe 6 tar por anekei emon report korechen. aar oi unpaved road leads to graveyard of indian warriors!!
ReplyDeleteজিপিএস ও সব বলছে! আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না শম্পা, আমার ঘাড়ের চুলগুলো সব স্ট্যাটিক খাওয়ার মতো খাড়া হয়ে গেছে এখন। কি সাংঘাতিক। প্লেসেস নট টু গো-র লিস্টে তোমার জায়গাটার নাম লিখে নিলাম, ও মুখো হচ্ছি না এ জীবনে।
Deleteore baba re, ei galpota to sanghatik. amio jaigatar naam tuke rakhchhi, konodin omukho hobona
DeleteKuntala, bhuteder khabor ki?
ReplyDeleteভূতেরা এখন ঠাণ্ডা মেরে আছে ইচ্ছাডানা। কষে ক্ল্যাসিক্যাল শুনিয়েছি তো, বোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। তবে মালবিকার উপদেশ মতো মালকোষটা এড়িয়ে চলছি।
Delete