আইল্যান্ড অফ দ্য সিটি
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগের, যীশুখ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের
কথা। জুলিয়াস সিজার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে গল-দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একের পর এক
গল-গ্রাম, শহর, নগর কচুকাটা করতে করতে এগোচ্ছেন তিনি। গলদেশের গোটাটাই প্রায় গিলে
ফেলেছে রোমানরা, বাকি আছে শুধু একটি পুঁচকে গ্রাম। উত্তরসাগরের তীরের সে গ্রামের
নাম কী কেউ জানে না, শুধু জানে সে গ্রামের লোকেদের গায়ে ভীষণ জোর। কানাঘুষোয় শোনা
যায় সে গ্রামের কবিরাজ নাকি জড়িবুটি দিয়ে কী এক ওষুধ বানাতে জানেন, সেই ওষুধ খেলে
একটা লোকের গায়ে একশোটা মত্তহস্তীর বল জন্মায়। সেই বলে বলীয়ান গল-গ্রামের লোকেরা
চারধারে তাঁবু পেতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা রোমানদের ঠেকিয়ে রেখেছে।
জড়িবুটি-সংক্রান্ত অংশটুকু বাদ দিলে ঠিক ওইরকম একটা গলগ্রাম ছিল এই প্যারিসেই। খ্রিস্টজন্মের প্রায় বাহান্ন বছর আগে। সেকালের গলদেশ, একালের ফ্রান্স-বেলজিয়াম। সেন নদীর বুকের ওপর তখন অনেক প্রাকৃতিক দ্বীপ মাথা তুলে ছিল, তারই কোনও একটায় আমাদের গলেরা থাকত। দুঃখের বিষয় তাদের গ্রামে জড়িবুটি ছিল না, এটাসেটামিক্স ছিলেন না, অ্যাসটেরিক্স-ওবেলিক্সের ধুমধাড়াক্কা জুটি ছিল না। আর তাই তারা রোমানদের ঠেকাতে পারেনি।
কেউ কেউ বলে সেই গলগ্রাম ছিল, এখন লোকে যে জায়গাটাকে Île de la Cité বলে জানে সেই জায়গাটায়। এই ভীষণ শক্ত নামওয়ালা জায়গাটা হচ্ছে সেন নদীর ওপর অবশিষ্ট মোটে দু’খানা প্রাকৃতিক দ্বীপের একখানা দ্বীপ। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এটা সেটা নয়, সে দ্বীপ কবেই তলিয়ে গেছে নদীর পেটে। সে যাই হোক, এখানে গলেরা থাকুক আর না থাকুক, যে ব্যাপারটা সকলেই মেনে নেন সেটা হচ্ছে এই Île de la Cité থেকেই প্যারিসের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। দ্বীপ বলে শত্রুর আক্রমণ সহজে ঠেকানো যেত বলে, মুড়িমুড়কির মতো যুদ্ধবিগ্রহ করে ফেরা রাজাদের কাছে চিরকালই Île de la Cité-র গুরুত্ব ছিল অসীম।
দ্বীপে পৌঁছতে গেলে প্রথমেই পেরোতে হবে নদী। বাঁয়ে হাত কা খেল, কারণ নদীর ওপর দিয়ে পাতা আছে প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি সংখ্যক ব্রিজ। Île de la Cité-তে পৌঁছতে গেলে তাদের মধ্যে অনেকগুলোই ব্যবহার করা চলে, কিন্তু আমার মতো ট্যুরিস্টরা সাধারণত যে ব্রিজের ওপর দিয়ে নদী পেরোতে পছন্দ করেন তার নাম Pont Neuf অর্থাৎ কি না নতুন ব্রিজ।
ব্রিজের নাম ‘নতুন’ কারণ ষোলশো সাত সালে এটাই ছিল
প্যারিসের নতুনতম ব্রিজ। চারশো বছর পরে পুরোনো ব্রিজেরা সব ঝরেপড়ে গেছেন, কিন্তু
নতুন ব্রিজ এখনও জোরকদমে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। প্যারিসের আর সব ব্রিজের থেকে বয়সে
অনেক বুড়ো হওয়া সত্ত্বেও।
ব্রিজ
পেরিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম Île de la Cité-তে। শনিবারের সকাল বলে প্রচুর টুরিস্টের ভিড় ছিল। যদিও আমি
গুগল ম্যাপ দেখে কোন রাস্তা ধরে কোথায় কোথায় যাব সব নোট করে নিয়েছিলাম, কিন্তু তার
দরকার ছিল না। ভিড়ের ল্যাজ ধরে হাঁটলেই হয়ে যেত।
Île de la Cité-র পশ্চিমদিকের
পুরোটাই একসময় ছিল রাজপ্রাসাদ। দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজবংশের লোকেরা
এতল্লাটে বাড়ি বানিয়ে থেকেছেন। নতুন রাজারা এসে সে সব রাজবাড়ি ভেঙেছেন, গড়েছেন,
হালফ্যাশনের আবার নতুন নতুন প্রাসাদ উঠেছে। Saint Chapelle, Louvre সবই হল এই সব প্রাসাদের অংশ। Palais de
Justice হল সেইরকম একটা প্রাসাদ। Palais de
Justice যদিও তৈরি হয়েছিল নেপোলিয়নের আমলে, ইতিহাসের বিচারে
দেখতে গেলে এই সেদিন, কিন্তু মধ্যযুগ থেকেই এই জায়গায় আইনআদালতন্যায়বিচারের
কাজকর্ম হয়ে আসত। এখনও এ প্যালেসের কিছু কিছু অংশ সরকারি আইনআদালতের কাজে ব্যবহার
হয়ে থাকে।
Palais de Justice-এর যে অংশগুলো এখন আর ব্যবহার হয় না তাদের মধ্যে বিখ্যাত,
বা কুখ্যাত, হচ্ছে La Conciergerie। পনেরোশো একত্রিশ সালে পুরোনো প্রাসাদের একটা অংশে জেলখানা
স্থাপিত হয় আর আগের অফিসের নামে সেই জেলখানার নামও হয়ে যায় La Conciergerie। এখন আমরা জেলখানায় পাজি পলিটিশিয়ানদের জন্য ফোন, ল্যাপটপ, টিভি ইত্যাদি দেখে
রাগে জ্বলেপুড়ে মরি, এ জিনিস কিছু নতুন নয়। La Conciergerie-তে চিরকালই আসামিদের কাকে কীভাবে ট্রিট করা হবে সেটা ঠিক করা হত তাদের পয়সা,
সোশ্যাল স্ট্যাটাস এই সব দেখে। রইস আসামিরা পয়সা দিয়ে নিজেদের জন্য খাটবিছানা
টেবিলচেয়ার আদায় করতেন, মাঝারিরা কোনওমতে বিছানা কিনতে পারলেই বর্তে যেত। আর সেটাও
যারা পারত না, অর্থাৎ যারা একেবারে হাভাতে ক্রিমিন্যাল, তাদের রাখা হত অন্ধকার, ভেজা, স্যাঁতসেঁতে
কুঠুরিতে। যাতে বিষাক্ত পোকামাকড় ইঁদুরবাঁদরের সঙ্গে ঘর করতে করতে তারা এমনিতেই
প্লেগ হয়ে মরে যায়। সরকারের আর ফাঁসি দিয়ে মারার দায় না থাকে।
এই দুই
নম্বর বাড়িই হচ্ছে সেই La Conciergerie। এ বাড়ি খ্যাতির মধ্যগগনে উঠেছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়।
বিশেষ করে সতেরোশো তিরানব্বইয়ের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে সতেরোশো
চুরানব্বইয়ের জুলাই পর্যন্ত যে রেইন অফ টেরর চলেছিল, তার সময়। রাষ্ট্রের শত্রু হওয়ার অভিযোগে
এই দশ মাসে চল্লিশ হাজারেরও বেশি লোককে জেলে পুরে কিংবা ফাঁসি দিয়ে মারা হয়েছিল
ফ্রান্সে। রেভলিউশনারি ট্রাইবুন্যাল বসেছিল পাশের বাড়ি Palais de Justice-এ। La Conciergie-র নাম লোকমুখে হয়ে দাঁড়িয়েছিল অ্যান্টিচেম্বার টু দ্য
গিলোটিন। প্রায় দু’হাজার সাতশো লোক গিলোটিনে চাপার আগে La Conciergie-তে
ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত বন্দী ছিলেন রাণী মারি আঁতানয়েত।
আমার
ম্যাপে এরপর লেখা ছিল সেন্ট চ্যাপেল। ম্যাপ মানে গুগল ম্যাপ থেকে নোটপ্যাডে টুকে
নেওয়া নির্দেশাবলী। তা বলে হেলাফেলা করার কিছু নেই, অত খেলিয়ে আমি মাধ্যমিকের
ভাবসম্প্রসারণও লিখিনি যত খেলিয়ে এই ম্যাপ টুকেছিলাম। কিন্তু তাও মাঝেমাঝেই সব
গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। আমার দোষ নয়, দোষ গুগলের। আমার মতে গুগল ম্যাপ দরকারের থেকে বেশি
নিখুঁত। আমি ছোটবেলা থেকে অ্যাটলাসের ম্যাপ দেখে অভ্যস্ত, খালি মনে হয় ম্যাপে যে
দূরত্বটা দেখায়, বাস্তবের রাস্তায় সেটা আসলে অনেকটা। A থেকে
বেরিয়ে রাস্তা ধরে ডানদিকে সোজা হেঁটে যাওয়ার কথা লেখা আছে, হেঁটে গিয়ে ডানদিকে
তাকালেই নাকি B দেখতে পাওয়া যাবে। আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো নাকবরাবর হাঁটছি
তো হাঁটছিই, B-এর পাত্তা নেই। তখন লজ্জার মাথা খেয়ে লোককে জিজ্ঞাসা করে
বুঝি B আসলে A-র ঠিক ডানদিকের বাড়িটা। জঘন্য। এই করতে গিয়ে সেন্ট চ্যাপেল
গোলমাল হয়ে গিয়েছে আমার। কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না, সেন্ট চ্যাপেল না দেখে
আমি নিজে প্যারিস থেকে যাব না, আপনাদেরও না দেখিয়ে ছাড়ব না। কিন্তু আজ নয়।
সেন্ট
চ্যাপেলের আশায় জল ঢেলে আমি ভিড়ের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই আকাশের গায়ে এইটা দেখা গেল।
তখন
জানতাম না, এখন জানি, এটা হচ্ছে Notre
Dame ক্যাথিড্র্যালের
পশ্চিমদিকের গা। এখন এও জানি যে ক্যাথিড্র্যাল বানানো শুরু হয়েছিল এগারোশো
তেষট্টিতে আর শেষ হতে হতে ক্যালেন্ডারে হয়ে গিয়েছিল প্রায় তেরোশো পঁয়তাল্লিশ। তারপরও অনেকবার অনেক মেরামতি হয়েছে Notre Dame-এর ওপর। ফরাসি রেভলিউশনের সময় ডিসেক্রেশনের নামে প্রচুর ক্ষতি করা হয়েছিল
ক্যাথিড্র্যালের, সে সব সারানো হয়েছে। তাছাড়া বয়সজনিত ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই।
Notre
Dame প্যারিস এবং পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় টুরিস্টস্পট হলেও, এখানে এখনও নিয়মিত পুজোআর্চা
হয়ে থাকে। যদিও যে’রকম টুরিস্টের ভিড়, তাতে সিরিয়াস প্রার্থনাকারীর জন্য Notre
Dame কতটা সুবিধেজনক সে নিয়ে সন্দেহ আছে। পশ্চিমদিকের দেওয়ালের উল্টোদিকে একটা উঁচু
কাঠের গ্যালারি মতো বানানো আছে, তার ওপর চড়ে বসে ক্যাথিড্র্যাল দেখতে সুবিধে। না হলে
কিছুক্ষণ বাদে ঘাড়ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা। আমি সেই গ্যালারিতে বসে খানিকক্ষণ ক্যাথিড্র্যাল
আর ক্যাথিড্র্যাল দেখতে আসা লোকজনদের পর্যবেক্ষণ করলাম।
দলছুট হওয়া
রোখার জন্য এই পন্থাটা বেশ মনে ধরেছে আমার।
গ্যালারি
থেকে নেমে ক্যাথিড্র্যাল প্রদক্ষিণ শুরু করলাম। সব জায়গাতেই লিখেছে Notre Dame হচ্ছে ফ্রেঞ্চ গথিক স্থাপত্যের
অনবদ্য নমুনা। ক্যাথিড্র্যালের গা থেকে বেরিয়ে আসা কুৎসিতদর্শন গারগয়েলদের কথা শুনেছিলাম
আগেই, এবার চাক্ষুষ করা গেল। এ’রকম বিতিকিচ্ছিরি জিনিসপত্র দিয়ে ক্যাথিড্র্যালের সৌন্দর্য
খাটো করাটা অবশ্য শখে নয়, এর পেছনে উদ্দেশ্যটা নিতান্তই কেজো। গারগয়েলগুলো হচ্ছে আসলে
একএকটা জল পড়ার পাইপ। ছাদের জমা জল যাতে ক্যাথিড্র্যালের গা থেকে যথাসম্ভব দূরে গিয়ে
পড়ে সেইজন্য এইসব বীভৎস লম্বাগলা জানোয়ারের আমদানি।
আর এইটা
হচ্ছে ক্যাথিড্র্যালের পুর্বদিকের মুখ। কী কেলেংকারি রকমের জটিল ইন্জিনিয়ারিং দেখেছেন।
আর এই যে বেঁকানো আর্চের মতো জিনিসগুলো দেখছেন, একে বলে ফ্লাইং বার্ট্রেস্। এ জিনিসটা
আর্কিটেকচারের ক্ষেত্রে খুব বিরল না হলেও, Notre Dame হচ্ছে সেই প্রথম যুগের বাড়িগুলোর
মধ্যে অন্যতম যেখানে এ জিনিসের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সোজা কথায় বলতে গেলে এদের কাজ হচ্ছে
“ঠ্যাকনা দেওয়া”। Notre Dame-এর মতো বাড়ির ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ভেতরের কারুকার্যের
চোটে দেওয়াল বাইরের দিকে হেলে পড়তে থাকে, তখন এই সব ফ্লাইং বার্ট্রেসরা সেই দেওয়ালকে
উল্টোদিক থেকে হেঁইও বলে ঠেলে রাখে।
Notre Dame-এর আসল আবেদন অবশ্য ফ্লাইং বার্ট্রেস বা গারগয়েল নয়। স্থাপত্যের কেরামতি
তো অনেক বাড়িরই থাকে, তা বলে কি তারা সবাই Notre Dame? আসলে যেটা লাগে সেটা হচ্ছে ইতিহাসের
সাক্ষী হতে পারা। আর জনপ্রিয় সংস্কৃতির অঙ্গ। ভিক্টর হিউগো যদি এই ক্যাথিড্র্যালকে
কেন্দ্র করে অমন একখানা জমকালো উপন্যাস না লিখতেন, তাহলে কি আর এত লোক এতদূরে হেদিয়ে
এ ক্যাথিড্র্যাল দেখতে আসত? গল্প ছাড়াও আরও নানারকম ঘটনা ঘটেছে Notre Dame-কে কেন্দ্র
করে যেগুলো গল্পের চেয়েও গায়ে কাঁটা দেওয়া। চোদ্দশো পঞ্চাশ সালের শীতকালে একদল মানুষখেকো
নেকড়ে নাকি বন থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়েছিল প্যারিসে। তাদের পালের গোদা ছিল ববটেল নামে
এক লালরঙের নেকড়ে। গোটা চল্লিশ লোককে মেরে খাওয়ার পর প্যারিসিয়ানরা খেপে গিয়ে, নানারকম
ফাঁদ পেতে নেকড়ের দলকে শহরের মধ্যিখানে টেনে এনে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল---এইখানে, এই Notre
Dame-এর সামনে।
ক্যাথিড্র্যালের ছবি তোলার সময় আশপাশের দোকান থেকে যে’রকম
খাবারের খুশবু আসছিল, গন্ধ বন্ধ করার ক্যামেরা থাকলে আমি সে সব খুশবু বন্দী করে এনে
আপনাদের শোঁকাতাম। এই গলির প্রায় সব দোকানের নামই Notre Dame ক্যাফে বা এই ক’টা শব্দের
পারমুটেশন কম্বিনেশন।
Île de la Cité প্রায় মেরে এনেছি আমরা, বাকি আছে শুধু আরেকটি দ্রষ্টব্য জিনিস (জানি জানি,
সেন্ট চ্যাপেল বাদ দিয়ে)। এই জায়গাটা অবশ্য লাফিয়েঝাঁপিয়ে আনন্দ করে দেখতে যাওয়ার
কিছু নয়। বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত প্রায় দু’লাখ
মানুষের স্মৃতিতে তৈরি এই Mémorial des Martyrs
de la Déportation। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করে এই মেমোরিয়ালের
বানানো আছে সরু অন্ধগলি, লাইন দেওয়া বন্ধকুঠুরি। দিগন্ত কাকে বলে সেটা ভুলিয়ে
দেওয়ার জন্য এর ভেতর থেকে তাকালে শুধু মাথার ওপর আকাশ দেখা যাবে। ক্যাম্পের প্রতিটি
বাসিন্দার গায়ে আঁকা থাকবে নানা রঙের ত্রিভূজ। যাতে তার দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া
যায় কে ইহুদি, কে রাজনৈতিক বন্দী, কে আসামি, কে অভিবাসী, কে সমকামী, কে মানসিক
ভারসাম্যহীন, কে বেশ্যা, কে ভবঘুরে, কে অলস।
Île de la Cité ছাড়া যে দু’নম্বর প্রাকৃতিক দ্বীপটা রয়েছে সেন নদীর ওপর তার নাম Île Saint-Louis। এই দ্বিতীয় দ্বীপটা Île
de la Cité-র থেকে সাইজে ছোট হল কী হবে, এর মগজে বুদ্ধি বেশি।
কেড্স্ পরা, ম্যাপ হাতে ঘোরা, চিৎকার করে কথা বলা টুরিস্টদের হাত থেকে বাঁচার
জন্য এ দ্বীপে একটিও মেট্রো স্টেশন নেই। দ্বীপের লোকেরা বেশিরভাগই বাসে চড়ার পক্ষে
বড়লোক তাই মোটে দুটি বাস এখান থেকে মূল শহরে যাতায়াত করে। লোকে বলে একশো-দুশো বছর
আগে প্যারিস কেমন ছিল, সেটা দেখতে হলে Île Saint-Louis-এ আসতে হবে।
Île Saint-Louis-এ একটিই বড় রাস্তা আর সেই রাস্তার প্রস্থ হচ্ছে ওপরের ছবিতে যা দেখছেন,
তাই। জায়গাটার হাবভাব অনেকটা দিল্লির খান মার্কেটের মতো। সব দোকানই বুটিক কিংবা আর্টিসান।
দামি দোকান, দামি জিনিস, দামি খদ্দের। আমি অবশ্য এখানে শপিং করতে আসিনি, কাজেই দাম
নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই আমার। আমি যেটা করতে এসেছি, নাকবরাবর খানিকক্ষণ হাঁটতেই
সেটার সন্ধান পাওয়া গেল।
আইসক্রিম
নিয়ে ছেলেখেলা করা আমার অভ্যেস নয় বলে আমি সোজা চলে গেলাম ৩১ নম্বর বাড়ির সামনে। বাড়িটা
আসার খানিকক্ষণ আগেই অবশ্য আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আশেপাশে আইসক্রিম কোন হাতে ধরা
লোকের সংখ্যা বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। অবশেষে দোকানের সামনে পৌঁছে, গোটা দশেক লোকের
পেছনে লাইন দিয়ে কাউন্টারে পৌঁছলাম।
নানারকম ফ্লেভারের আইসক্রিম পাওয়া যায় Berthillon-এ। শুধু আইসক্রিম না, ফ্রুট ফ্লেভার্ড্
সরবে-ও পাওয়া যায়। কিন্তু আমি জানতাম আমি কী অর্ডার করব। গান শুনতে হলে ক্ল্যাসিক্যাল,
আইসক্রিম খেতে হলে চকোলেট। ভীষণ সুন্দরী আর ভীষণ রাশভারি মহিলা এক স্কুপ আইসক্রিম কোনে
পুরে আমার হাতে দিলেন, আর ঘুপচি দোকান থেকে “পার্ডোঁ পার্ডোঁ” বলতে বলতে ভিড়ের মধ্যে
দিয়ে এঁকেবেঁকে খোলারাস্তায় নেমে এসে আমি আমার হাতে ধরা ব্যাপারটার দিকে প্রথমবার ভালো
করে তাকিয়ে দেখলাম।
খেতে
কেমন? সোজা কথা সোজা করে বলাই ভালো, আমি এত ভালো আইসক্রিম জীবনে খাইনি। পারফেক্ট মিষ্টি,
পারফেক্ট ঠাণ্ডা, পারফেক্ট টেক্সচার। মুখে দিলে মসলিনের মতো মিলিয়ে যায়। সন্দেহ হয়,
সত্যি কি আমি আইসক্রিম খেলাম, নাকি একটা ভীষণ সুন্দর স্বপ্ন দেখে উঠলাম এইমাত্র? আলোছায়াখেলা সরু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে একমনে
পুরো আইসক্রিমটা শেষ করে আমার সেই স্বপ্নটার জন্য এমন মন কেমন করতে লাগল যে আমি
লজ্জার মাথা খেয়ে আবার লাইনে দাঁড়ালাম।
এবার
Praline-Pignon। পৃথিবীর বাকি সব Praline-Pignon-এর থেকে ভালো
খেতে, আমি নিশ্চিত।
আইসক্রিম হাতে নিয়ে পিছু হাঁটছি যখন তখন মেঘ ছিঁড়ে রোদ্দুর বেরিয়েছে। ব্রিজের ওপর একসারি প্লাস্টিকের পলকা কাপ রেখে তার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে রোলার স্কেটিং করে খেলা দেখাচ্ছে একদল ছেলে। একজন সারা গায়ে প্লাস্টারের মতো কী সব মেখে হাতে একটা বিরাট ঝাঁটা নিয়ে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দেখে কে বলবে স্ট্যাচু নয়? ঝাঁটার সামনে কয়েকটা খুচরো পয়সা ছড়ানো ছিল তাই, না হলে আমি অন্তত বলতে পারতাম না।
আইসক্রিম হাতে নিয়ে পিছু হাঁটছি যখন তখন মেঘ ছিঁড়ে রোদ্দুর বেরিয়েছে। ব্রিজের ওপর একসারি প্লাস্টিকের পলকা কাপ রেখে তার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে রোলার স্কেটিং করে খেলা দেখাচ্ছে একদল ছেলে। একজন সারা গায়ে প্লাস্টারের মতো কী সব মেখে হাতে একটা বিরাট ঝাঁটা নিয়ে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দেখে কে বলবে স্ট্যাচু নয়? ঝাঁটার সামনে কয়েকটা খুচরো পয়সা ছড়ানো ছিল তাই, না হলে আমি অন্তত বলতে পারতাম না।
আমি জানি লেখাটা অসম্ভব রকমের লম্বা হয়েছে, কিন্তু এতখানিই যখন ধরেছেন, আরেকটু
ধৈর্য ধরুন দয়া করে। ঘোরা প্রায় শেষ, মাত্র আরেকটা স্টপ বাকি। চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা
সব ইন্দ্রিয়ের সাধ মিটেছে, এবার একটু বইপত্র না ঘাঁটলে মা সরস্বতী ভয়ানক রাগ করবেন
যে।
বইয়ের
দোকান পৃথিবীতে অনেক আছে, কিন্তু তারা কেউ শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নয়, কারণ একদিক
থেকে দেখতে গেলে শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিই বইয়ের দোকান নয়। কখনওই ছিল না। এই যে
দোকানটার ছবি দেখছেন ওপরে এটা কিন্তু আসল শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নয়। আসল দোকানটা
খুলেছিলেন সিলভিয়া বিচ নামের, প্যারিসে ঠাঁই গাড়া এক অ্যামেরিকান মহিলা, উনিশশো উনিশ
সালে। শুরু থেকেই অন্যরকম ছিল শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। বই বিক্রি হত, কিন্তু
দেদার বই ধারও পাওয়া যেত সিলভিয়ার দোকান থেকে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এজরা পাউন্ড,
ফিটজেরাল্ড এই দোকানে রীতিমত বসবাস করতেন। জেমস জয়েসের নিজস্ব লেখার দপ্তর ছিল
দোকানের কোণে। তাঁর 'ইউলিসিস' বই হিসেবে প্রথম ছেপেছিলেন সিলভিয়া বিচ। ইংল্যান্ড,
আমেরিক্যায় নিষিদ্ধ হওয়া ডি এইচ
লরেন্সের বইপত্র বুক ফুলিয়ে বিক্রি করত শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি।
যুদ্ধের
কোপে সিলভিয়ার এত সাধের দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল উনিশশো চল্লিশ সালের চোদ্দই জুন। যুদ্ধ
থামার পরেও সে আর খোলেনি।
উনিশশো
একান্ন সালে জর্জ হুইটম্যান বলে আরেক অ্যামেরিকান, আরেকটা বইয়ের দোকান খুলেছিলেন
প্যারিসে। সে দোকানের ধাতও ছিল সিলভিয়ার দোকানের মতোই। স্ট্রাগলিং কবিসাহিত্যিকদের
জন্য জর্জের দোকানের দরজা হাট করে খোলা থাকত। উনিশশো চৌষট্টি সালে সিলভিয়া মারা
যাওয়ার পর, জর্জ নিজের দোকানের নাম বদলে রাখলেন শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি। সেই
দোকানই ওপরের ছবির দোকান। তাঁর দোকানের নামবদল সম্পর্কে একটা খুব সুন্দর কথা
বলেছিলেন জর্জ। বলেছিলেন, শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি একটা নাম নয়, এটা হচ্ছে “A novel in three words”।
অস্বীকার করে কোনও উপায় নেই শেকসপিয়ার
অ্যান্ড কোম্পানি এখন যত না বইয়ের দোকান, তার থেকে অনেক বেশি প্যারিসের মাস্ট-ডু
লিস্টের একটা আইটেম। দোকানের ভেতরটা দেখলেই মনে পড়ে “কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর-আঠা দিয়ে
সেঁটে,/ সুতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে।” মিটমিটে আলোজ্বালা দোকানের মাটি
থেকে সিলিং পর্যন্ত খালি বই আর বই, সিঁড়ির তলায় বই, সিঁড়ির ওপর বই। টেবিলের ওপর
গুছিয়ে রাখা বই, যেমন তেমন করে মুখ থুবড়ে ছেতরে থাকা বই। শেলফের কোণে ধুলো মাখা
ফার্স্ট এডিশন, প্রথম পাতায় মালিকের কায়দার সই আবছা হয়ে এসেছে। আর এই বইয়ের
জঙ্গলের মধ্যে নিঃশব্দে পিঁপড়ের মতো ঘুরছে মানুষের দল। দেড়হাত চওড়া ক্যাঁচকেঁচে
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে। দোতলায় ছোটদের বই, আর বিছানা। এখানেই অ্যালেন গিনস্বার্গ
শুয়ে থাকতেন কি না কে জানে। পুঁচকে টাইপরাইটারের সামনে চামড়া ফেটে তুলো বেরিয়ে পড়া
চেয়ার। চেয়ারে বসে টাইপ করা থামিয়ে মুখ তুললেই জানালার বাইরে নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে
আছে Notre Dame। পুরো
ব্যাপারটা একটা অবিশ্বাস্য ছবির মতো।
দোকানে
ঢুকলেই বাঁদিকে সায়েন্স, ডানদিকে ফ্রেঞ্চ লিটারেচার, তারপর একে একে ফিলসফি,
হিস্ট্রি, রিলিজিয়াস স্টাডিস্, ফিকশন। সব ভাগাভাগিই মোটের ওপর কারণ অত বই কে
গোছাবে, আর দেখলেই বোঝা যায় বই গুছিয়ে রাখাটা এ দোকানের ফ্যাশনের বিরুদ্ধে। সিঁড়ি
দিয়ে ওপরে ওঠার আগেই দেখি দেওয়ালের মাথার ওপর গোটা গোটা করে লেখা ইকনমিক্স। দেখেই
প্রাণ হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি পালিয়ে বেঁচেছি।
মন
প্রায় খারাপ হব হব করছে, ভাবছি হাইফাই দোকান বলে কথা, হয়তো...এমন সময় দোতলা থেকে
নেমে এসে সিঁড়ির তলার শেলফের গায়ে দেখি আবছা অক্ষরে লেখা ‘ক্রাইম’। চেঁচিয়ে উঠে
লাফ যে দিইনি সেটাই ভাগ্য। শেলফে থরে থরে সাজানো বইয়ের মলাট থেকে আমার দিকে তাকিয়ে
আছে পাইপ মুখে শার্লক হোমসের প্রোফাইল, ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়া কবলস্টোনের পথ বেয়ে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ের শরীর, উদ্যত ছুরি থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে
গাঢ় লাল রক্ত, আর সেই রক্তের স্রোতের ভেতর ফুটে উঠেছে ছ’অক্ষরের একটি স্বর্গীয়
শব্দ---মার্ডার।
আমি
ওখানেই তাঁবু ফেললাম নেক্সট একঘণ্টার জন্য। কোনটা ফেলব? কোনটা নেব? পড়েছি তো কী
হয়েছে, আবার পড়ব না কেন? প্লট জানি, খুনি চিনি, তা সত্ত্বেও নতুন করে চিনব না কেন?
মিস মার্পল অমনিবাস বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, তারপর হতচ্ছাড়া মাথা মনকে
যুদ্ধে হারিয়ে দিল, আর আমিও ডরোথি সেয়ার্সের একটা না পড়া বই (দ্য ডকুমেন্টস্ ইন
দ্য কেস) তুলে নিয়ে কাউন্টারে এসে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই মেয়েটি বুঝেছে যে এ
দোকানে জীবনের বাকি ক’টা দিন রোজ একবার করে ঢুঁ মারার সুযোগ আমার হবে না, সে বইটা
আমার হাতে দেওয়ার আগে প্রথম পাতায় একটা গোল স্ট্যাম্প মেরে দিল। কালো কালির একটা
গোলের মধ্যে শেকসপিয়ারের মুখ। ওপরে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা শেকস্পিয়ার অ্যান্ড
কোম্পানি, নিচে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা কিলোমিটার জিরো প্যারিস। Notre Dame ক্যাথিড্র্যালের দরজা হচ্ছে
প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দু, শহরের বাকি সব জায়গার দূরত্ব ওই বিন্দু থেকে মাপা হয়।
শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির দোকান সেই বিন্দু থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে বলে ওই
ছাপ।
শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি নামের দোকান পৃথিবীতে আরও আছে। সিলভিয়া বিচ আর
জর্জ হুইটম্যানের নিজেদের দেশ অ্যামেরিকাতেই। চার-চারটে শেকস্পিয়ার খুঁজে পাওয়া
যাবে এক নিউ ইয়র্ক সিটিতেই। তাদের সঙ্গে এই কিলোমিটার জিরোর শেকস্পিয়ার অ্যান্ড
কোম্পানির কোনও সম্পর্ক নেই। থাকবে কী করে, সে সব দোকানের দোতলায় তো তেরোখানা
বিছানা নেই, আর দোকান খোলার দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ হাজার লোক
কেন, একজনও সে সব দোকানে রাত্রিবাস করেনি। আসল শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি
একটাই, এর কোথাও কোনও শাখা নেই। থাকতেই পারে না।
*****
khub khub bhalo laglo pore :) icecream toh darun mone hocche ....boier dokaner bhitarer bujhi ar chabi tola jeto na?
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ তিন্নি। আরে তোলা হয়তো যেত, কিন্তু আমি সিরিয়াসলি প্রাণ থাকতে এই কাজটা করতে পারলাম না। লোকজন চুপি চুপি বইয়ে হাত বুলোচ্ছে, পা টিপে টিপে হেঁটে একে অপরকে সাইড দিচ্ছে, আর তার মধ্যে আমি হঠাৎ ডি এস এল আর বাগিয়ে খচাৎ খচাৎ---ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। তাই ছাড়ান দিয়েছি।
Deletebhaloi korechish ! :)
DeleteEi dokaner bhetorta ekta asadharon abhigyata- chhobi ba video dekhe thik bojha jai na. But anek cinema-y dekha jai. Tarmoddhe jaddur mone porchhe Before Sunset ekta. Amelie cinema tateo chhilo ki? Youtube-eo ekta video achhe. Tobe sesab dekha dudher sadh ghole metanor mato.
Deleteআমারও দোকানটা খুব মনে ধরেছে রুচিরা।
Delete:-) darun laglo pore, darun beralam chhobisaho. Etasetamix der kotha mone korie dile, boigulo abar ekhuni porte ichha korchhe .
ReplyDeleteধন্যবাদ ইচ্ছাডানা। আরে পড়ে ফেলুন, আমারও খুব ইচ্ছে করছে পড়তে।
DeleteParis er sobkichhui kirom sundor dekhte mairi! Girja, rasta, lokjon, dokan, maaye ice cream porjonto!
ReplyDeleteযা বলেছ, বিম্ববতী।
DeleteTrivia: Usually, the first footnote in a page is marked * and the second footnote is marked †. These are commonly known as the “Star” and the “Club”. In phonetic symbology, these are known as Asterisk and Obelisk respectively.
ReplyDeleteEi trivia tar jonno thanks :-)
Deleteআমার তরফ থেকেও থ্যাংক ইউ।
Deleteporlaam ghurlaam .. bhishon bhalo laglo..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, simple girl.
Delete