সাপ্তাহিকী ও ক'টি অবান্তর কথা






আমি না নিলেও, আমার বাবামা আমার সংগীতশিক্ষাকে যারপরনাই সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। গান শেখার জন্য শুধু মাস্টারমশাই খুঁজেই তাঁরা ক্ষান্ত দেননি, তাললয়ের দিকটাতেও যাতে খামতি না পড়ে সে জন্য একজন তবলার মাস্টারমশাইকেও ধরেবেঁধে নিয়ে এসেছিলেন।

মাস্টারমশাই আসতেন রবিবার সকাল দশটা নাগাদ। তারপর ঘণ্টাদুয়েক ধরে তিনতাল, ঝাঁপতাল, দাদরা, ধামার, তেওড়াতে কসরত চলত। আমি গাইতাম, মাস্টারমশাই বাজাতেন, বাবা তালে তালে মাথা নাড়তেন। একই স্থান, কাল ও পরিস্থিতিতে অবস্থান করা সত্ত্বেও আমাদের তিনজনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। মাস্টারমশাইয়ের উদ্দেশ্য থাকত যেনতেনপ্রকারেণ আমাকে তালচ্যুত করা, আমার উদ্দেশ্য হত প্রাণপণে তালের ল্যাজ ধরে ঝুলে থাকা, বাবার কী উদ্দেশ্য ছিল সেটা বাবাই ভালো বলতে পারবেন।

বলাই বাহুল্য, মাস্টারমশাই তাঁর উদ্দেশ্যে সফল ও আমি আমার উদ্দেশ্যে চরম ব্যর্থ হতাম। মাস্টারমশাইয়ের আকারটি ছিল নিতান্ত ভালোমানুষ গোছের, কিন্তু প্রকারে তিনি ছিলেন নির্মম। আমি তাল থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে গেছি দেখেও তিনি বাজনা থামাতেন না। আমি সমে ফেরার জন্য হাঁচোড়পাচোড় করতাম, আর মাস্টারমশাই ঠিক সময়ে একটা অদরকারি লয়কারি দিয়ে আমাকে ফের ছিটকে দিতেন। ঠিক যেমন লাস্ট সিনে ভিলেন খাড়া পাহাড়ের গায়ে গজানো মিহি ঘাসের গোছা আঁকড়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করে, আর ওপর থেকে হিরো একটা লম্বা বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে বেচারার সে চেষ্টাকে ক্রমাগত ব্যর্থ করে দেয়। সে এক করুণ দৃশ্য।

ইদানীং দৃশ্যটা বার বার ঘুরেফিরে মনে আসছে। আমি আনতে চাইছি না, তবু। তার কারণ আছে অবশ্য একটা। অবান্তরে এখন সেই তালকাটা দশা চলছে। সমে ফেরার সেই চেনা হাঁচোড়পাঁচোড়, সেই পরিচিত ছিটকে যাওয়া। আমি এম এস ওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আছি, এম এস ওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়ি ঘুরে যাচ্ছে, দিন বয়ে যাচ্ছে, সপ্তাহ ঘুরে একটা সাপ্তাহিকীর জায়গায় আরেকটা সাপ্তাহিকীর পালা চলে আসছে, আমার আঙুলনিঃসৃত প্রলাপের প্রস্রবণটিই যা শুধু রুদ্ধ।

সত্যি বলছি ভেবেছিলাম, সাপ্তাহিকী বার করব না। লেখার বেলায় ঢুঁ ঢুঁ, এদিকে ফাঁকি মেরে চুরি করা লিংক ছাপার বেলায় একেবারে লাফ দিয়ে রেডি। লজ্জাই হচ্ছিল। কী ভাববেন আপনারা সবাই।

কিন্তু তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। সাপ্তাহিকী ছাপছি, কারণ এটা ওই সমে ফেরার হাঁচোড়পাঁচোড়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেলে সমে ফিরবই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু না গেলে যে কোনওদিনও ফিরব না, সে গ্যারান্টি অবধারিত। কাজেই, যত ফাঁকিবাজিই দেখতে লাগুক না কেন, আমি সাপ্তাহিকী ছাপার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমি তো চাইছিই, আপনারাও প্লিজ মনে মনে চান – অবান্তর যেন শিগগিরি নিজের তাল খুঁজে পায়।


*****


বোদ্ধার মহামারী লেগেছে চতুর্দিকে, এ আমি অনেকদিন ধরেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

মাত্র উনিশ বছরে কতকিছু বদলে যায়, হ্যাঁ?

এই ক্যানসেলড ভেকেশনের ক্যান্ডেললাইট আমাকেও জ্বালাতে হবে দেখছি। জ্বালাতন।


বাকিগুলোর কথা জানি না, তবে অ্যাভয়েড হিউম্যানস ডট কম-এর নাম শুনেই তো বেশ কাজের সাইট বলে মনে হচ্ছে।

মায়ের  অপত্যস্নেহের যে জাত হয় না, সে কথা আবারও প্রমাণ হল। ছবিগুলো পাঠিয়েছে তিন্নি।


এতে অ্যান্টিসোশ্যালের কী আছে কে জানে বাবা। আমরা সবাই-ই কি পরিস্থিতিবিশেষে এইরকম নই?

দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, মেজাজ, বদভ্যেস তো বটেই, এরা বলছে স্মৃতিও নাকি ডি এন এ-র প্যাঁচে প্যাঁচে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিবাহিত হয়।




Comments

  1. Aha. Abar birohor gaan keno? Ekei kemon mushre porechho mone hochhe. Kaal RD'r kota gaan gungun korle? Amar mathay sara din ghur ghur korlo "tu jahan mile mujhe".

    ReplyDelete
    Replies
    1. aar hyan, chhobigulo-y parent-ra ki shudhu-i ma? parenting-er modhdhey shudhu motherhood-ke glorify korar moddhey ki kono sexism nei? just asking :)

      Delete
    2. হাহাহা মুষড়ে পড়েছিলাম সেটা ঠিকই ধরেছ সোমনাথ, কিন্তু এক্ষুনি সে মুষড়ানি কেটে গেল সেটাও ঠিক। কারণ আমার একটা 'মনে হওয়া' একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। আমি যখন তিন্নির ছবিগুলোর ব্যাপারে লিখছিলাম, 'মা' কথাটা লেখার আগে তিন সেকেন্ড থমকেছিলাম। কারণ পেঙ্গুইনদের যে ছবিটা আছে, ভিড় করে ছানা পেঙ্গুইনদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, সে ভিড়ে সকলেই 'মা' কি না সেটা কে জানে। আমার মন বলছে অনেক 'বাবা'রাও আছেন, বা ওখানে শুধু বাবা পেঙ্গুইনরাই আছেন সেটাও হতে পারে।

      তবু লিখলাম কারণ বাকি ছবিগুলো মূলত মা জানোয়ারদের ছবি। তবে আমার লেখা উচিত হয়নি, নিঃশর্তে মেনে নিচ্ছি।

      তবে মন ভালো হয়েছে এই জন্য নয় যে তুমি আমার ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছ, মন ভালো হয়েছে এই কারণে যে ওই তিন সেকেন্ডে পেঙ্গুইনদের সঙ্গে সঙ্গে সোমনাথ মুখার্জির কথাও আমার মনে পড়েছিল। আমি জানতাম তোমার এটা চোখে পড়বে। মাদারহুডকে গ্লোরিফাই করার মধ্যে যে সেক্সিজম আছে, সেটা তুমি খেয়াল কর এবং সেটা তোমাকে ভাবায়, আমি জানি। ভাবানোই উচিত।

      আমার মনে হওয়াটা এইভাবে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য থ্যাংক ইউ।

      Delete
    3. শুধু কতগুলো কমেন্টের ভিত্তিতে আমার চরিত্র ধরে ফেলেছ দেখে আমি বেশ অবাক। আমাদের বাবারা বড্ড আন্ডারআপ্রিশিয়েটেড। আমি আজও মা কে নিয়ম করে দিনে একবার ফোন করি। ১৫ মিনিটে দিনের ডাউনলোড দি। আর বাবার সাথে গত এক মাসে কথাই হয়নি। আমার ছোটবেলাটাও শুধু মার কাছেই কেটেছে। বাবা কে খুব কম পেয়েছি। অন্য শহরে থাকত, চাকরির জন্য। কিন্তু যারা আমায় চেনে, তারা খুব ভাল জানে আমার মধ্যে আমার বাবার চরিত্র অনেক বেশি। সেটা কি এমনি এমনি হয়?

      Delete
    4. এই রে, আমি তোমার চরিত্র ধরে ফেলিনি, সোমনাথ। আমি কি নিজের চরিত্রই ধরতে পেরেছি যে তোমারটা পারব? তবে কিছুদিন ধরে কথাবার্তা হলে কোনও কোনও ইস্যুতে কার কী মত সেটা হয়তো পরিষ্কার হয়ে যায়, এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে মনে হয়।

      আমি একেবারেই মানছি, যে ছেলেমেয়ে লালনপালনের ক্ষেত্রে বাবাদের ভূমিকার স্বীকৃতি এখনও অপ্রতুল আমাদের সমাজে। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর, সেটাও একটা সেক্সিজমের ফল। স্বীকৃতি-টিকৃতির ব্যাপারগুলোও তো আসলে অভ্যেস। জন্মজন্মান্তরের অভ্যেস।

      আমি জানি, একটা অন্যায়ের ব্যাখ্যা অন্য একটা অন্যায় দিয়ে দিতে যাওয়াটা ভারি অন্যায়। অর্থহীন। তবু সান্ত্বনা হিসেবে বলছি। এই অভ্যেসটা কিন্তু মায়েদের ভূমিকাকেও একইভাবে ছোট করে। বাবাদের প্রতি এই অবিচারের প্রতিযুক্তি হিসেবে অনেকেই যেমন বলেন, (বানিয়ে বলছি না, অন গড ফাদার মাদার বলেন) যে আ-আ-রে, মায়ের যতই ন্যাওটা হোক না কেন, টাকার জন্য হাত পাততে হবে তো সেই বাবার ব্যাংকে।

      কথাটা এমনিই যথেষ্ট আপত্তিজনক, কিন্তু যে ক্ষেত্রে মা সমান তালে রোজগার করছেন এবং সমান তালে সে রোজগার সংসারসন্তানের পেছনে ঢালছেন, সে ক্ষেত্রে তো সটাং মিথ্যে। বাবার আদর যেমন লোকে দেখতে পায় না, মায়ের অর্থনৈতিক (এবং অফ কোর্স, আদরের থেকে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ) অবদানও তেমনি খুব কম লোকেই দেখতে পায়। আশা করি, সময়ে দুটো বিষয়ই - মায়ের পয়সা এবং বাবার আদর - আমাদের সমাজে যথাযথ স্বীকৃতি পাবে।

      আর বাবামায়ের মতো হওয়ার কথা আর বোলো না। আমার মাবাবার যে চরিত্রগুলোকে আমি প্লেগের মতো ভয় পাই, মাবাবার ঠিক যে যে ভাবভঙ্গিগুলো আমার অসহ্য লাগে, ঠিক সেইগুলোই, সব, স-অ-অ-ব আমার মধ্যে একে একে ফুটে বেরোচ্ছে। ওটার সঙ্গে ক্লোজনেস ইত্যাদির কোনও সম্পর্ক নেই, সব ডি এন এ-র প্যাঁচ।

      Delete
    5. "বানিয়ে বলছি না, অন গড ফাদার মাদার বলেন" - কেন বলেন ??? তুমি তাদের প্লেগের মত এড়িয়েই বা চলনা কেন?
      তবে সুশীল সমাজ চালাক। শিখে গেছে, আজকের জমানায় মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতাটা সমর্থন করা হেব্বী ইম্পরট্যান্ট। ওই নিয়ে ট্যাঁ ফু করলে... হুঁ হুঁ বাওয়া... তাই এইরম কথা ব্লগ-টগ -এ বড় একটা পাবে না। সে মনে যাই থাক।
      কিন্তু... ছানাপোনা মানুষ করার ব্যাপারটা এখনও... ওই আর কি... "মায়েদের একটা ব্যাপার থাকে" - এটা যে কতবার শুনেছি !! আর সেটা মহিলারাই বেশী বলেন, এটা না ভেবে যে নিজেরাই নিজেদের চারপাশে মা-নামক একটা গণ্ডী বেঁধে দিচ্ছেন। একটা তকমা। আইডেন্টিটি। যার বাইরে তার আর কোনো আইডেন্টিটি থাকতেই পারে না।

      Delete
  2. এত মুষড়ে পড়লে কেন কুন্তলা? সারা জীবন একভাবে চললে তো বোর্‌ড লাগবে। আজ যে মাদারহুডের ছবি পাঠিয়েছ, সব কিছুর মধ্যে সেটার থেকে ভাল আমার কাছে আর কিছুই লাগেনি। এমনিতেই আমার মনুষ্যেতর জীবদেরই বেশি পছন্দ। তুমি যখন পোস্টটা তৈরী করছিলে, তোমার কি আনন্দ হয় নি? সবার মধ্যে আনন্দকে ছড়িয়ে দিতে তুমি সিদ্ধহস্ত, আমি তো এটাই জানতাম। বাক আপ, ডিয়ার। জীবনকে কত কোণ থেকে দেখা যায়, সেটা তো তুমিই দেখালে।
    তিন্নিকে একটা পর্বতপ্রমাণ ধন্যবাদ জানাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, তিন্নি খুবই কাজের কাজ করেছে, মালবিকা। আর অবান্তর আপনাদেরকে আনন্দ দিতে পারে জেনে ভালো লাগছে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. Amar Abantor k ektuo talkata lagchena...sudhu jomia ekta golpo naman somoy berkore...idea lagle bolben... :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, দারুণ অফার তো সৌমেশ। যে অবস্থা চলছে, প্লটের জন্য এবার অবান্তরে অ্যাড দিতে হবে মনে হচ্ছে। আপনি যে নিজে থেকেই আশ্বাস দিলেন, সে জন্য অনেক অনেক থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. কুন্তলা প্লীজ কিছু মনে কোরো না, কিন্তু পেরেণ্টিং মোমেণ্টসের বাংলা মাতৃস্নেহ আমি তোমার কাছ থেকে অন্তত আশা করি নি। শব্দটি পরে বদলে দিয়েছ দেখেছি, এবং সেটা খুব খুব দরকার ছিল, কিন্তু প্রথম ভুলটা হওয়াই উচিত ছিল না। প্লীজ প্লীজ মাইণ্ড কোরো না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে না না, মাইন্ড করার কিছু নেই অদিতি।

      Delete
  5. amar darun laglo facebooker videota ..khub hesechi..ar photo series tao darun,sabcheye majar akdom sesh chabitay cheleke anekta pratham chabir babar moto lagche..:) dna r pyanch ...ar hya sitegulo khubi kajer mane hocche ...
    amar ektuo mone hay na abantor er taal kete geche..mone hay tui kichudin age abdi jerokom lihtish taar theke ektu alada rakam likhte chaichish.. gato du tin mashe je lekhagulo beriche segulo kintu darun...- tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. sorry last chabitay dujanke ak rakam lagche ..taina ?

      Delete
    2. আমাদেরও ওই ফোটো সিরিজটা ভালো লেগেছে তিন্নি। ফেসবুক ভিডিওটা মজার না?

      Delete
  6. ইএ ... মানে তাল খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত্য ভূত, পাগল বা নিদেন পক্ষে একটা মাতাল দিয়ে কাজ সারলে হত না ??

    ReplyDelete
    Replies
    1. শ্রীরামপুর, রিষড়া এরিয়ার লোকজনদের অনেক রকম স্পেশাল ক্ষমতা থাকে জানি, তা বলে এক্কেবারে থট রিডিং, আত্মদীপ? আমি গ্যারান্টি দিয়ে কিছু বলতে চাই না, তবে পাগলের পাল্লায় খুব শিগগিরি পড়তে পারেন। সাবধানে থাকুন।

      Delete
  7. Bresh Bresh .. pagol er pallay pore abantor e khanik golmaal hok !!!
    -- Atmodip

    ReplyDelete

Post a Comment