শপথ সিরিজ #২---ঘুম



আমি সাধারণত এ রকম সটাং মন্তব্য করা এড়িয়ে চলি, কিন্তু আজ করছি। আমার মতে গত কুড়ি তিরিশ বছরে বাঙালির সংস্কৃতিজগতের সবথেকে বড় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার নাম চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। চন্দ্রিলের ওপর আমার রাগ আছে ভাববেন না, উল্টে এককালে চন্দ্রিলের প্রতি আমার যে কী অবিচল অনুরাগ ছিল, মনে করলে এখন আমার নিজের মনেই ‘ধরণী দ্বিধা হও’ ভাব জাগে। সুদীপ্ত বলে, “তখন ওভারএস্টিমেট করেছিলে, এখন তাই বেশি হতাশ হচ্ছ।”

হয়ত ঠিকই বলে।

চন্দ্রিল কী হতে পারতেন, কী হননি, হওয়ার সংজ্ঞাই বা ওনার কাছে কী, এই সব হওয়াহওয়ি দিয়ে আদৌ একটা লোকের সাফল্য ব্যর্থতা মাপা যায় কি না---সে সব অন্য তর্কের রসদ। আমি নিজে এখনও চন্দ্রিলের মুখ চ্যানেলে দেখালে রিমোট থামাই, কাগজে লেখা বেরোলে সব কাজ ছেড়ে পড়ি (অন্তত চেষ্টা করি)। চন্দ্রিল আমার বড় দুর্বল জায়গা।

চন্দ্রিলের কয়েকটা কথা আমার জীবনে প্রায় খনার বচনের স্থান নিয়েছে। কথাগুলো এত সত্যি, এত হৃদয়বিদারক যে কী আর বলব। তবে এই সমস্ত চন্দ্রিল-উবাচ’র মধ্যে যেটা আমাকে সবথেকে নাড়া দিয়েছে, সেটা হচ্ছে---

“গুরু বাবারা যা পায়নি তা আমরা পাবনা।”

এর থেকে সত্যি কথা আপনি শুনেছেন কি না জানিনা, আমি শুনিনি। জানি কারও কারও জিভের ডগায় অলরেডি মণি ভৌমিক আর আরও অনেক লোকের নাম চলে এসেছে, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রম। ফেনোটাইপ জেনোটাইপের চিরকালীন রেসে, জেনো সামান্য হলেও (আমি বিশ্বাস করি সামান্য নয়, অনেকটা) এগিয়ে থাকে। কেরানির সন্তান কেরানিই হয়, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে হলেও। ভিড়ের মাঝে মিশে থাকা মুখ ভিড়ের মাঝে মিশেই থাকে, সে ভিড় হাওড়া স্টেশনেরই হোক কি গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের।

আমড়া গাছে সত্যিই আম ফলে না। ব্যাপারটা স্যাড, কিন্তু সত্যি।

যদিও আমি এ সব ব্যাপার নিয়ে একটুও স্যাড নই। লেখাটা পড়ে উল্টোটা মনে হতে পারে, আমার নিজেরই হচ্ছে, কিন্তু সেটা আমার নয়, আমার লেখার দোষ। কলমের জোর কম থাকলে এই হয়, লেখা নিজের মতো নিজে চলতে থাকে। আমি কী বলতে চাই, কেন বলতে চাই, কী ভাবে বলতে চাই, সে সবকে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করেই। টাইপ করা থামালে দেখি পাতার ওপর শিব বানাতে গিয়ে বাঁদর বানিয়ে বসে আছি।

এই যেমন আজকের পোস্টটাই ধরুন। ২০১৩ সালের দ্বিতীয় রেসলিউশনটা নিয়ে লিখব বলে বসে তিনশো কুড়ি শব্দ খরচ হয়ে গেল, রেসলিউশনের র-এর চিহ্ন নেই কোথাও। চন্দ্রিলের বচন দিয়ে শুরু করে কায়দা করে গরুকে শ্মশানে নিয়ে ফেলব ভেবেছিলাম, গরু নিজের মনে প্লাস্টিক চিবোতে চিবোতে অন্য দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। আমার শত লেজ মোচড়ানিতেও ডিরেকশন বদলাচ্ছেনা। জঘন্য।

তার থেকে সোজা কথাটা সোজা ভাবে বলে ফেলা যাক। খাওয়ার পর আমার ২০১৩র দ্বিতীয় রেসলিউশন হচ্ছে ঘুম।

ঘুম নিয়ে আমার বড় ঝামেলা, বুঝলেন। কখন যে ঘুমোই, কতক্ষণ যে ঘুমোই তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। এই ধরুন আজ অবান্তর লিখতে লিখতে (আসলে GOMI পড়তে পড়তে) ভোর চারটে বেজে গেল, তো এই কাল আটটা বাজতে না বাজতেই টিভি চালিয়ে, আলো জ্বালিয়ে, বুকের ওপর ল্যাপটপ চাপিয়ে, মুখ হাঁ করে ঘুমোতে লাগলাম। যথারীতি রাত দেড়টা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। তখন আর হয় সিলিং, নয় ইউটিউবের দিকে তাকিয়ে রাত কাবার করা ছাড়া গতি কী?

সবথেকে খারাপ যে ব্যাপারটা হয়, এ রকম ঘুমে কোনও কাজ হয় না। সারাদিন মাথা ঝিমঝিম, ঘাড় টনটন, গা ম্যাজম্যাজ। ডেস্কের ওপর হেড ডাউন করার প্রবল ইচ্ছে দমন করতে করতেই অফিসে সেকেন্ড হাফ কাবার। একটা গোটা রাতের নিশ্ছিদ্র নিটোল নিবিড় ঘুমের পর চোখে আলো আর মুখে হাসি নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ার বিদ্যেটা আমি ভুলেই গেছি। বাবা মা যেটা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন। কী করে দিনের কাজ গুছিয়ে, দাঁত মেজে, চুল বেঁধে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে শুতে যেতে হয়। কী করে বালিশে মাথা ঠেকানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়া যায়।

২০১৩ সালে আমাকে সে বিদ্যা নতুন করে শিখতে হবে।

কাকিমা শুনে বললেন, “অ্যালোভেরা লোশন কিনে মাথায় মাখো। মন্ত্রের মতো কাজ দেবে। চুলও গজাবে।” এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে শুনে আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, “তাই নাকি, কী মজা, মাখব মাখব।”

কাকিমা বললেন, “সবথেকে ভালো হয় টবে গাছ লাগিয়ে নিলে। বেশি যত্ন করতে হয় না, লাগালেই ঝাড়েবংশে বাড়তে থাকে। আমার বাগানে তো ঘৃতকুমারীর একটা ছোটখাটো বন হয়ে গেছে প্রায়। তুমি এলে আমি তোমাকে একেবারে তৈরি গাছ দিয়ে দিতাম।” কাকিমা আফসোস করেন।

“অ্যালোভেরা মানে ঘৃতকুমারী নাকি?” আমার কান খাড়া।

“হ্যাঁ তো। একই জিনিস। বাংলায় যা ঘৃতকুমারী, ইংরিজিতে তাই অ্যালোভেরা।” আজকালকার মেয়েগুলোর জ্ঞানের বহর দেখে কাকিমা নির্ঘাত ফোনের ওপারে চোখ ঘোরান।

তখনি আমার না-দেখা দিদিমার কথা মনে পড়ে গেল। দিদিমার সঙ্গে আমার পরিচয় শুধু কসবার বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো একটা ঘষা কাঁচের ছবি দেখে আর মা মাসি মামা মামিদের মুখে মুখে গল্প শুনে। দিদিমা নাকি মায়ের মতোই পাতলা ছিলেন, ভীষণ ভালো নিরামিষ তরকারি আর পায়েস রান্না করতে পারতেন, বেজায় নরম মনের ছিলেন, গোটা চারপাঁচ ছেলেমেয়ের 24X7 কুরুক্ষেত্রের উত্তরে কেবলমাত্র “আহি আহি” বলে ধমক দিতেন, ( ও কথাটার আক্ষরিক মানে “আসছি আসছি” আর আসল মানেটা হচ্ছে “এসে মজা দেখাচ্ছি”। যদিও রান্না ফেলে উঠে আসার সময় দিদিমার ছিল না। আর এলেও যে বিশেষ ভয়ের কিছু নেই সে বিষয়ে ছেলেমেয়েদের কনফিডেন্সের অভাব ছিল না, কাজেই কুরুক্ষেত্র পুরোদমে চলতেই থাকত।) আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেশাত্মবোধক কবিতা লিখতেন।  

মা গল্প করেন, সারাদিনের মধ্যে দিদিমার একমাত্র হাঁফ ছাড়ার সময় ছিল প্রায় মাঝরাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগের সময়টুকু। গুনগুন করে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে তখন দিদিমা পা মেলে বসে মাথায় ঘৃতকুমারীর তেল মাখতেন, ভালো করে আঁচড়ে টেনে চুল বাঁধতেন, কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে মা কালীর নাম স্মরণ করে, আশেপাশের ছড়ানোছেটানো ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের গায়ের চাদর টেনেটুনে ঠিক করে দিয়ে অবশেষে বিছানায় গা ঢালতেন। মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য। কি তারও কম।

ওই যে পূর্বপুরুষের মতো হওয়া না-হওয়া, পাওয়া না-পাওয়ার কথা বলছিলাম শুরুতে, সেটা যে সবসময় দুঃখেরই হতে হবে তার তো মানে নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তো আমার তো ঠিক তাঁদেরই মতো হতে ইচ্ছে করে। আমার দিদিমার সঙ্গে আমার স্থান কাল, পরিবেশ পরিস্থিতির কত প্রভেদ, এবং সেই প্রভেদের বেশিরভাগের জন্যই আমি কৃতজ্ঞ। তবু আমার দিদিমার কাছে থাকার জন্য মন কেমন করে। দিদিমার জন্য, দিদিমার আদরের জন্য, দিদিমার হাতের লেজেন্ডারি বাঁধাকপির ঘণ্টর জন্য। আমার অতীতের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের সঙ্গে অপরিচয়ের আফসোস যায় না আমার।

সে আফসোস এবার একটু কমবে। যখন আমি ল্যাপটপ গুটিয়ে, দাঁত মেজে, চুল বেঁধে, ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ গুনগুনিয়ে মাথায় ঘৃতকুমারীর তেল মালিশ করব, তখন আমার মনে হবে, এই তো আমি দিদিমার খুব কাছেই আছি। আর তারপর দুচোখে শান্তির ঘুম নেমে আসবে। নিশ্চিন্ত, নির্ভার ঘুম। যে রকম ঘুমে শুধুই দিদিমার হাতের রান্না বাঁধাকপির সুখস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু আসে না।

২০১৩ সালে আমি আবার সে রকম ঘুমোব।

দিগন্তজোড়া ঘৃতকুমারীর বন 
উৎসঃ গুগল ইমেজেস

Comments

  1. aaa !! tomar ghumer jonyo eto pyaintara lagbe ! millo na to ! amar to byaparta jotro totro... keu disturb korar na thaklei holo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. লাকি তো তুমি সোহিনী।

      Delete
    2. Arey Bhut er bikhyato golpo jano na? Chhotobela'r golpo oboshyo. Borora dinner khachhilo ar Bhut tader jhamela korchilo. Emon somoy Kakbhai bollo - Pinky ami kintu ei haat dhuyei giye tomar bichhanay ghumiye porbo, tumi jodi na shute jao. Bhut omni ek doure chole gelo. Kakabhai haat dhuye dekhte giye dekhe Bhut actually bhosh bhosh kore ghumiye poreche!
      Tobe ei ghum byapar ta amader uttoradhikar shutre paoya. Amar chhoto kaka (Kakabhai - ini Bhut-er ekmatro kaka), Bhut ar ami - amra ekkebare bhosh bhosh kore ghumoyi :) Amar to 9 hrs na holey thik hoyna.
      Chandril er katha tar mane ami thik bujhlam na. Kerani'r chhele kerani hoy? Eta abar ki jatiyo katha holo? Tahole to amar professor hoya uchit chilo. Ar Bill Gates er baba ki CEO chilen naki? Jotto sob boka boka katha! Chandril gaan ta to mondo gaye na, osob niye thaklei to pare. Eto "bani" jharte oke ke boleche?

      Delete
    3. arre chandril er bakkya literally noy metaphorically nitey hobe.....aam aar aamra'r moto. jodio as i said before, amra ka chatni >>> aam ka chatni.

      Delete
    4. Na taholeo or boktobyo ta amar kache khub clear noy. Ke aam, kei ba aamra? Seta determine korbe kon kon factor?

      Delete
    5. achha eta numbers aar poverty diye bolbar chesta kori. (ref. niall ferguson...ascent of money, high financier, empire)

      number of people who have lived on the earth till date: 106 billion

      number of people who have lived in poverty or abject poverty till date: 99.4 billion

      therefore the number of people who escaped poverty = 106-99.4 arthat 6% of the total lived population

      ei 6% er madhe kojon er baba poor chilo aar kojon borolok aamra janina. kichu mathematical models achey kintu for simplicity jodi dhori beshir bhag er baba poor (let's say 3/4 er baba poor) tahole bhabo je about 4% escaped their parents destiny.

      tow chandril oi 96% er katha bolchen :)
      obviously poverty can be glorified ebong anekei starting from catholic church seta korechen!!tai seta abar aam and aamra debate hoye jabe)

      Delete
    6. Dhyat!!! Statistics diye abar kobe theke tothyo proved hochhe? Ar tachhara gorib/borolok tai ki ekmatro mapkathi na ki manush mapar?
      Ekjoner baba chilo dhoro gorib station master ar tar chhele holo gorib scientist. To byapar ta ki ek thake? Similarly paji borolok er chhele khub udar borolok holo, daan dhyan korlo, sobar upokar korlo. Setao to hotey pare?

      Delete
  2. একটা গোটা পোস্ট চন্দ্রিল নিয়েই হোক না... পোস্টের প্রথম অর্ধেক ঝরঝর করে পড়ে ফেললাম, গাঁকগাঁক করে বললে বেশি ভাল হবে, তারপর হালকা সিলেবাসের বাইরে চলে গেলো। "চন্দ্রিল কী হতে পারতেন, কী হননি,...সে সব অন্য তর্কের রসদ" তর্কের একটা দিক শোনার জন্যে মুখিয়ে থাকলাম :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. কেন ভাই আমাকে দিয়ে অপ্রিয় কথা বলিয়ে দোষের ভাগী করা? ওসব মুখোমুখি দেখা হলে হবে'খন।

      Delete
  3. amar babar sokalbela dakar paddhotita atantya pashabik chilo..ami ar bhai je ghore shutam sekhane taroshware radio chalie sotan gayer chadarta tene niten...radiote 'uthe paro bandhu vor holo /natun close-uper katha sono...laal nil halud sabuj...aro ki ki jeno kaner kache bajte thakto..ar baba fatafat janla khule gharer modhye prachur alo ene ekgaal hasten ar amader gapitti jwale jeto...nitol ghumer pore mukhe hasi tai amader chotobelay akdom chilona:(
    chandriler proti abichal anurag amaro aksomoy chilo....kintu aste aste kirom jani ube gelo...tabe hya...akhono chandriler nam chapar akkhore dekhle..ba shunle ektu thomakai .......
    kintu eta ki holo lekhar seshata to aloevera ar kakima capture kore nilen !?;)

    ReplyDelete
  4. Ghritokumari naam ta ki hashyokor!!! Amake eksomoy Bhut "acharkumari" naam diyechilo ami botol botol achar sabar kore dicchilam bole. (makhon bhaat ar achar....uuuff se ja khete!) Ekhon mone hochhe ami botol botol ghee khele nishchoyi amar naam "ghritokumari" hoto :D Aloe-vera naam ta besh refined. :D

    ReplyDelete
  5. Kuntaladi, sotyii Chandril-ke niye ekta purnango lekha chai :)

    ReplyDelete
  6. আমার ঘৃতকুমারী শুনলেই "ঘৃতকুমারী অনর্গল" মনে পড়ে যায়!
    এইটা খুব ভালো শপথ।আমিও ঘুমের সময় বাড়ানোর চেষ্টা করছি কিছুদিন ধরে, কিন্তু আপাতত ৩-৪ ঘন্টায় এসে দাঁড়িয়েছে, আর উঠ্ছেইনা।আশা করি নতুন বছরে অবস্থার উন্নতি হবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে "ঘৃতকুমারী অনর্গল" আমার মনেই ছিল না। ভালো মনে করিয়েছেন সুগত।

      Delete

Post a Comment