পাড়াপড়শি


দিন ক্ষণ মাস বছর মনে নেই, একদিন সন্ধ্যেবেলা কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখমুখ কুঁচকে বাগানের আধোঅন্ধকার থেকে তাঁকে আলাদা করার চেষ্টা করছি দেখে তিনি খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “বড়রা কেউ বাড়িতে আছেন?”

আমি, ব্যাপারটা আমার ডিপার্টমেন্টের নয় বুঝে, পাততাড়ি গোটালাম। ঠাকুমা পরিস্থিতি হাতে নিলেন। একটু পরে মা-ও অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি সামনের ঘরে বসে পড়লেন। চা বিস্কুট সহযোগে গল্প খুব জোর জমে উঠল। আমি পড়া থেকে মাঝে মাঝে উঠে এসে উঁকি মেরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। দরজার আড়াল থেকে দেখে যেটুকু বুঝলাম ভদ্রলোক বয়স্ক। ষাট পঁয়ষট্টি তো হবেই। মাথায় পাতলা হয়ে আসা সাদা চুল, চোখে চশমা, গলার আওয়াজ শুনলেই মনে হয় ভালো লোক।

অতিথিবিদায় হলে জানা গেল ইনি আমাদের নবতম প্রতিবেশী। পাড়ার বড় মাঠটার একটা কোণা বিক্রি হয়ে গিয়ে যে বাড়িটা তৈরি হয়েছে সেটা নাকি এঁরই।

ও, ইনিই তবে আসামে থাকা সেই রহস্যজনক ব্যক্তি যিনি গত বছরখানেক ধরে আমাদের পাড়ায় খেলিয়ে বাড়ি বানাচ্ছেন। তাতে আমাদের মাঠের একটা অংশ বেহাত হয়ে যাওয়ার রাগও যেমন হয়েছিল, একটা নতুন খেলার জায়গা পাওয়ার আনন্দও তেমন হয়েছিল। নির্মীয়মাণ বাড়িতে খেলার মজা যে কী, যারা না খেলেছে জানে না। পর্যাপ্ত কোণাঘুঁজি, লম্বা লম্বা বাঁশ, পিলার, ঢালু সিঁড়ি, রেলিং ছাড়া প্রশস্ত ছাদ---খেলাধুলোর আদর্শ আবহাওয়া। দেদার খেলেছি। তারপর বাড়ি যখন পুরো বানানো হয়ে গেছে, মেঝেতে মার্বেল আর সিলিং-এ ফ্যান লেগে গেছে, তখন একদিন বৃষ্টির বিকেলে পুকিদিদির সঙ্গে ফাঁকা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপে টিপে সবগুলো সুর শুনেওছি।

ভদ্রলোক চলে গেলে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “লোকটা কী বলতে এসেছিল মা?” মা বললেন, “লোক আবার কী সোনা? ভদ্রলোক এ সপ্তাহে পাকাপাকি ভাবে আসাম থেকে চলে এলেন, তাই নতুন প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করছেন।”

আমি ভুরু কপালে তুলে চোখ ঘুরিয়ে বলেছিলাম, “কী অদ্ভুত রে বাবা, এ রকম আবার কেউ করে নাকি?”

মা বলেছিলেন, “এঁরা বয়স্ক লোক কিনা, পুরোনো দিনের আদবকায়দায় বিশ্বাস করেন। এর পর আর কেউ করবে না, চিন্তা কোরো না।”

করেও না। এ পাড়ায় এসেছি বেশ কিছুদিন হল। নেমপ্লেট দেখে দেখে সব বাড়িওয়ালার পদবীও জেনে ফেলেছি, সকালে বেরোবার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের সবজি কেনার সময় আড়চোখে তাকিয়ে পদবীর সঙ্গে মুখচোখ মিলিয়েও নিয়েছি। আমিও ঘাড় ঘোরাইনি, তাঁরাও চোখ তোলেননি। মনে মনে খুশিই হয়েছি।

যাক বাবা, পাড়াটা সিভিলাইজড।

কিন্তু সিভিলাইজেশন তো উৎপাতবিহীন হয় না। এই সিভিলাইজেশনের মূর্তিমান উৎপাত আমার প্রতিবেশীর বুড়ো কুকুর। সাদা ঝুপোঝুপো লোমওয়ালা কুকুরটা সারাদিন গ্রিলের গেটে গা এলিয়ে বসে থাকত আর ফেরিওয়ালা দেখলেই হুঙ্কার ছাড়ত। ফেরিওয়ালা, কাবাড়ি, কুড়াওয়ালা আর আমাকে দেখলে। সকাল আর বিকেলে আমি যখন গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হেঁটে ওই বাড়িটার সামনে দিয়ে পেরোতাম, শান্ত নিরিবিলি পাড়াটা ঘেউ ঘেউ চিৎকারে খান খান হয়ে যেত। আর আমি প্রত্যেকবার মনে মনে অসভ্য, অভদ্র, অশিক্ষিত কুকুরটার মুণ্ডপাত করতাম, ভাবতাম ধরণী দ্বিধা হলে বাঁচি।

তারপর মাসখানেক আগের এক শনিবার বেলা দশটা নাগাদ সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা বিরাট ডেকচি চাপিয়ে, “মাছ আছে মাছ...তাজা রুই ইলিশ পাবদা, জ্যান্ত কই শিঙি মৌরলা, নেবেন নাকি মাসিমা-আ-আ” চেঁচাতে চেঁচাতে একটা লোক হাজির হল। গোটা পাড়াটা জেগে উঠল যেন হঠাৎ। আশেপাশের বাড়ি থেকে মেসোমাসিমারা বেরিয়ে এলেন। কইমাছের গন্ধে গন্ধে আমিও না গিয়ে থাকতে পারলাম না। গিয়ে দেখি সবাই আলাপসালাপ করছেন, মাছওয়ালাকে বকাঝকা দিচ্ছেন। আমি যেতে সবার মনোযোগ আমার দিকে ঘুরে গেল।

“নতুন মনে হচ্ছে?”

“কোন জগতে থাকেন আপনি তারাদি? ডাক্তারবাবুদের দোতলায় লোক বদল হয়েছে দেখেননি?”

গর্বিত মুখে যিনি আমার দিকে তাকালেন তাঁর দরজায় রায়চৌধুরী লেখা, আমি বেশ কিছুদিন হল দেখেছি। আমি নার্ভাসমুখে হাসি। একে একে প্রশ্নবাণ শুরু হয়। কী কর? অফিস কোথায়? মা বাবা কোথায়? গুঁফো ছেলেটা কে? তোমার বয়ফ্রেন্ড?

আমি হাঁ করে থাকি। বুঝি আমিই শুধু তাঁদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করিনি, তাঁরাও করেছেন। তবে আমার দৌড় নেমপ্লেট পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে, এঁরা অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, আমার হাঁড়ির খবর বার করে ছেড়েছেন।

সেই থেকে পাড়ার মাসিমেসোদের সঙ্গে বেশ আলাপপরিচয় হয়ে গেছে আমার। আমি তাঁদের দেখে হাসি, তাঁরা কোন দোকানের সীতাভোগ ফ্রেশ সে বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দেন। কেবল ঝুপো কুকুরটা আমার ওপর সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন সামনে দিয়ে গেলে ঘেউ ঘেউ তো দূরে থাক, চোখ ফিরিয়ে তাকায় না পর্যন্ত।

Comments

  1. Merry X-mas !!! besh likhechho. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. মেরি ক্রিসমাস আপনাকেও ইচ্ছাডানা।

      Delete
  2. tomar ma thik i bolechilen. ekhon oto alaap er bahar nei....aar markin deshe tow ekebarei noy. ei bochar prothom block party aar christmas walk boley ekta byapar e parar lokjon ke motamuti chinlam. edike kolkatay amader protibeshi kakima roj sakale tar bagan er phul tule amader thakur er samne rekhe jaan. everyday!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ক্রিসমাস ওয়াক! বেড়ে ব্যাপার তো শম্পা।

      Delete
  3. hyan bede byapar. aami prothom ta bhabchi je ei morechey abar jisu-tisu saajte hobe na tow. tarpor janlam je 23 bikel theke parar anek lokjon volunteer korechey tader bari sajiye rakhbe open house thakbe giye cake, cookie etc khao, small talk koro sange choto khato gift ditey paro. aamar jehetu jisu'r gaach tara astabol er department ta ektu "weak" tai ebochar aar naam dilam na....tobe next year readymade tree/ghora/khor/jisu'r father mother kine bhalo poroshi hobar chesta korbo :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাবসলিউটলি শম্পা। এসব মাঝে মাঝে করলে শরীরমন ভালো থাকে।

      Delete
  4. eta bhison majar.....darun lekha:)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ তিন্নি।

      Delete
  5. গুঁফো ছেলেটা কি আপনার বয়ফ্রেন্ড?

    এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে একটা বিশেষ দিক মনে পড়ে গেল - এই যে প্রতিবেশীদের হাঁড়ির খবর আপনি জানেন, বা তাঁরা আপনার টা জানেন, সেই সঙ্গে একটা যুতসই নামও কিন্তু দেওয়া হয়ে থাকে। এই যেমন ধরুন "উঁকি মারা" (কারনটা বলাই বাহুল্য), বা "ভাইয়াজীর মা" (তাঁর ছেলে সবাইকে ভাইয়াজী বলে ডাকত), কিম্বা "তেন্ডুলকর" (এদের ছেলেটাকে সচিনের মতন দেখতে) ইত্যাদি। নামটা অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল। এ দেশে অনেক কিছুর সঙ্গে এই জিনিসটাও ভীষণ মিস করি যে আমাদের এপার্টমেন্ট বিল্ডিংএর কাউকে আমি চিনিনা, এক কুকুরওয়ালা ভদ্রমহিলাকে ছাড়া। ওনার সঙ্গেও পরিচয় নেই, তবে ওনার কুকুরটা আমায় রাস্তায় দেখলেই পরিত্রাহি চ্যাঁচায়, তাই একটা মুখ চেনা হয়ে গিয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ রকম নাম আমিও অহরহ দিয়ে থাকি। এ পাড়ায় অলরেডি একজনকে বাঘমামা বলে ডাকা হয়, আরেকজনকে যোগা-বৌদি বলে।

      Delete

Post a Comment