ছবি তোলার গল্প



রবিবার সকালে চোখ মেলেই আমার প্রথম যে কথাটা মনে এল সেটা হচ্ছে, ছবি তুলতে হবে। না হলে শনিরবি ছাপবে না।

ছবি তুলতে আমার ভালোও লাগে না, খারাপও লাগে না। ছবি ছাপার পর আপনারা আমার মিছিমিছি একগাদা প্রশংসা করে পিঠ চাপড়ে দেন, সেটা অবশ্য ভয়ানক ভালো লাগে। আর তাছাড়া ডেপথ অফ ফিল্ড, হোয়াইট ব্যালেন্স, রুল অফ থার্ডস্‌ ইত্যাদি শব্দ জানা থাকলে উইকএন্ডে আড্ডা দেওয়া অনেক সহজ হয়।

মোটামুটি এই দুটো কারণে আমার ক্যামেরাটায় অলরেডি ধুলো জমতে শুরু করেনি।

যাই হোক, আমি রবিবার সকালসকাল উঠে দাঁত মেজে জল খেয়ে ওষুধ খেয়ে এবং চা না খেয়েই তড়িঘড়ি ক্যামেরা গলায় পার্কের দিকে রওনা দিলাম। সকালের চা বাদ দেওয়ার মতো তাড়া কিসে লাগল যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে বলব দেশে স্বাস্থ্যসচেতনতা যে কী রেটে বাড়ছে সেটা কল্পনার বাইরে। অন্ধকার থাকতে শুরু হয়, ছুটির দিন চলে বেলা বারোটা পর্যন্ত। নেহাত সূর্য ততক্ষণে ঠিক চাঁদির ওপরে এসে থামে আর সানস্ট্রোকের সম্ভাবনা ঘোর বাস্তব হয়ে দেখা দেয়, তাই নিমপাতা চিবোনো মুখ করে লোকজন ইয়োগা ম্যাট গুটিয়ে যে যার বাড়ি ফেরে। ভয়ানক অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রসঙ্গ যখন উঠেইছে তখন আরেকটা ব্যাপার না বলে পারছি না। ১৫ই মার্চের সানন্দা পত্রিকা দৈবক্রমে হাতে এসে পড়েছিল। সেই পত্রিকার এমলাট থেকে ওমলাট উল্টে চমৎকৃত হওয়ার মতো অসংখ্য খুঁটিনাটি নজরে পড়লেও এখন সেসবে যাচ্ছি না। বরং শুধু কয়েকটা শিরোনাম তুলে দিচ্ছি। মনে রাখবেন সবকটি শিরোনামের লেখা ওই একটি সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছে। এবং এর একটিও ওই সংখ্যার প্রচ্ছকাহিনি নয়।

পার্শ্বরচনা একঃ ফুড প্রফেশনালস্‌
ডায়েটঃ ডায়েট সলিউশন
পার্শ্বরচনা দুইঃ আপনার বাচ্চা এবং হেলদি ডায়েট
অন্দরমহলঃ খাওয়ার ঘরের সাজ
রিলেশনশিপঃ খাওয়াদাওয়ার বায়নাক্কা
স্বাস্থ্যঃ কোলেস্টরেল এড়াতে খাওয়াদাওয়া
বাচ্চার স্বাস্থ্যঃ বাচ্চার হেলদি খাবার
আপনার ছেলেমেয়েঃ গুড ফুড হ্যাবিট
মানে কীঃ ইমোশনাল ইটিং

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যদি ওবেসিটি বাঙালিকে না ধরেছে তাহলে আমি আমার নাম বদলে ফেলব। কোনও রামদেবের বাবার সাধ্য নেই রোখে।

হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিল। আমি তো চা না খেয়েই হাঁপাতেহাঁপাতে গিয়ে পার্কে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি অলরেডি পার্কে ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে গেছে। চারদিকের চারটে গেট দিয়ে পিলপিল করে লোক ঢুকছে, ইয়োগাওয়ালারা একে অপরকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ভালো দেখে গাছের ছায়া বেছে ম্যাট পাতছেন, যাতে শবাসনটা নির্বিঘ্নে প্র্যাকটিস করা যায়। বুড়োরা গোল করে দাঁড়িয়ে হাহা করে হাসছেন, বুড়িরা বেতো হাঁটু নিয়ে জাহাজের মতো দুলেদুলে হাঁটছেন। আর কাক চড়ুই শালিখ কাঠবেড়ালিরা “ব্যস্‌, হয়ে গেল” মুখ করে সেদিনের মতো দোকানপাট বন্ধ করে যে যার বাসায় ফিরছে।

আমি আর কোনওদিকে না তাকিয়ে ফুলপাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম।

প্রতিভা না থাকার এই হচ্ছে বিপদ। ভালো ছবিতুলিয়েদের চোখই আলাদা। আমার এই গোদা চোখে ফুল আর পাতার থেকে সুন্দর আর কিছু চোখেই পড়ে না, কিন্তু তাঁরা সবসময় অন্যরকম জিনিস থেকে সৌন্দর্য টেনে বার করে আনতে পারেন। জং ধরা রেলিং, শালিখের ঠোঁট, ফোয়ারার জলে ভাসন্ত কাকের বিষ্ঠা। এইরকম এক প্রতিভাবান ছবিতুলিয়ের সঙ্গে আমাকে একবার ডেটে যেতে হয়েছিল। স্বেচ্ছায় নয়, মায়ের ঝুলোঝুলিতে। আমার যেমন চশমা ছাড়া চলে না, তাঁরও তেমনি ডি এস এল আর ছাড়া দুনিয়া অন্ধকার। আমরা গিয়েছিলাম ছবির মতো সুন্দর জার্মান ভিলেজের একটা রেস্টোর‍্যান্টে। রেস্টোর‍্যান্টের পাশে গড়ের মাঠের সাইজের একটা ভীষণ সুন্দর পার্ক ছিল। আমার খিদে পায়নি শুনে আমার সঙ্গী মহানন্দে সেই পার্কে ঢুকে ছবিশিকারে নেমে পড়লেন।

ছবি তোলা চলল, সঙ্গে লেকচার। লেকচার বলছি বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিত ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। আমি পাছে বোরের হদ্দ হয়ে যাই সেই ভয়েই তিনি ননস্টপ কথা বলে যাচ্ছিলেন। তখনই শুনলাম, ভালো ফোটো তোলার গোড়ার কথা হচ্ছে পার্সপেকটিভ। আমি হলে মাটিতে দু’পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফোয়ারার পরীর মুণ্ডুর ছবি তুলতাম, উনি দেখছিলাম রেলিঙের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে পরীর হাঁটুতে ফোকাস করছেন।

কনভারসেশনে পাছে হেরে না যাই, সেজন্য আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, “জানি জানি, সেই যে একটা কথা আছে না, সবাই ক্যামেরা বসায় দরজায় জানালায় আর সইত্যZত বসায় ঘুলঘুলিতে।” বলে আমি নিজের বাঙাল রসিকতায় নিজেই গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলাম আর ভদ্রলোক ছবি তোলা থামিয়ে ভীত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সে ডেট জার্মান ভিলেজের পর আর এগোয়নি। অর্চিষ্মানের কপাল ভালো।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, এখন আপনাদের সেদিনের তোলা ছবিগুলো দেখাব। আর দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, আমার চোখ এখনও অন্যরকম সৌন্দর্য খুঁজে বার করতে পারেনি, সেই ফুলপাতা আকাশবাতাসের চর্বিতচর্বণের চক্রব্যূহে ঘুরে মরছে। তবু সাহস করে সেগুলো অবান্তরে ছেপে দিলাম। আপনাদেরই তো দেখাচ্ছি, বলুন?  




Comments

  1. তোর জীবন খুব ইন্টরেস্টিং।

    ReplyDelete
  2. ছবি তোলাটাই শেষ কথা নয় । ওই যে একরাশ হলুদ ফুলের মাথার ওপর ঝুল বারান্দাটা, ওখানে বসতে ইচ্ছে করছে কি না?হলিহক ফুলের পাশ দিয়ে ওই সবুজ বাঁকা রাস্তা টায় হাঁটতে হবে না?দু দিকে দুটো হাত ছড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিলাম ছবিগুলো দেখে।

    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. মিঠু, যদিও ওটা আমার বাড়ির বারান্দা নয়, কিন্তু আমার বাড়িও ওই লাইনেই, আর আমার বাড়িতেও ওইরকমই একটা বারান্দা রয়েছে। শুধু বারান্দা দেখেই আমি বাড়িটা পছন্দ করেছিলাম, জানো। হলিহক ফুল বুঝি ওগুলো? আমি নাম জানতাম না, কিন্তু ফুলগুলো থাকাতে রাস্তাটা ফুলের থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে, তাই না?

      আমাদের পার্কটা এতল্লাটের সুন্দরতম পার্ক। আমার যদিও তাতে কোনও কৃতিত্ব নেই, তবু আমি এই বিষয়টা নিয়ে গর্ববোধ করি।

      Delete
  3. হ্যাঁ বুঝতে পারছি । কি জানো, আমি একবার একটা ঝাঁ চকচকে এই উঁচু মেকানিকাল ফ্ল্যাট ছেড়ে ওই বাগান গাছপালা ফুল সবুজ লন বারান্দাওয়ালা একটু পুরনো বাড়িতে চার মাসের মধ্যে শিফট করে যা সব মন্তব্য শুনেছিলাম ! আমিতো খুব এনজয় করেছিলাম যেমন তুমি করছ ।

    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. মিঠু, লোকের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে আমার অনেকদিন ধরেই সন্দেহ ছিল, তোমার কথা শুনে সেটা আরও দৃঢ় হল।

      Delete
  4. দিল্লী বেশ সুন্দর জায়গা তো।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দিল্লি অসম্ভব সুন্দর জায়গা আবির।

      Delete
  5. tomar barir pashe erom sundor ekta park achhe !! tumi daruun bhagyoboti ! chhobi gulo to dibbi hoechhe.. ami oboshyo oi kaydar photography r bishesh kichhu bujhina, tai amar chhobi r subject sundor hole ar jhapsha na holei chhobi bhalo lage... joto kayda kore tolai hok, oi jong dhora railing er theke surjomukhi phool dekhte onek bhalo...

    ReplyDelete
    Replies
    1. পাশে মানে? নাকের ডগায় বল সোহিনী। আমারও মানুষের ছবি দেখতে সবথেকে ভালো লাগে, আর মানুষ নেহাত না পাওয়া গেলে আকাশবাতাসনদীপাহাড়। ব্যস।

      Delete
  6. লজ্জার মাথা খেয়ে জানাচ্ছি - সেই জার্মান ভিলেজের গল্পটা আরো বিশদে শুনতে ইচ্ছে করছে। ইন ফ্যাক্ট, যে কোনো ডেটই বোধহয় আলাদা গল্প হবার দাবি রাখে। বলা যায় না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা অনির্বাণ, সে তো রাখেই। ইন ফ্যাক্ট, তোমার কমেন্ট পড়ে গল্পগুলো টাইপ করার জন্য আমার আঙুল নিশপিশ করছে।কিন্তু মুশকিলটা কী বলতো, সব গল্পগুলোতেই আরেকজন কেউ না কেউ থাকবেন, যিনি আমি নিশ্চিত, গল্পের চরিত্র হতে চাইবেন না। তাই একটু কিন্তুকিন্তু লাগে আরকি।

      তবে একটা করা যায়, ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো করে বলা যায়, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। দাঁড়াও, আমার ক্ষমতায় সেটা কুলোলে লিখব'খন।

      Delete
  7. ki darun Park, ar darun GREEN. khub bhalo laglo lekha ar chhobi duii. amar nijero photography-r sokh, tobe ta ekebarei anarir moton. ekebarei niom kanun janina, chhobi tolar anonde ja pari tule jai. jatoi sekhar chesta kori boi toi khule sesob porashuno chhobi tolar somoi bemalum bhule jai.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইচ্ছাডানা, আপনার দেওলো পোস্টের ছবিগুলো খুব ভালো হয়েছিল বাই দ্য ওয়ে।

      Delete
    2. utsaho debar jonye onek dhonyabad Kuntala :-) .

      Delete
    3. সত্যি বলেছি কিন্তু। আপনি ছবি তোলা আর লেখা দুটোই চালিয়ে যান।

      Delete
  8. মা বাবার ঝুলোঝুলিতে একবার আমাকেও ডেট এ যেতে হয়েছিল ।কোথায় জানো? বইমেলায় । বেশ ইনফরমাল ব্যাপার হবে। আমি বাড়ি ফিরে বললাম কেউ কাউকে খুঁজেই পাই নি । এবং সত্যিই পাইনি । পুরোটাই আমার প্ল্যান মাফিক।লিখে বেশ মজা লাগছে।

    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. মাবাবারা ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। বাঁচা গেছে খুঁজে পাওনি মিঠু। পুরো বিকেল মাটি হত।

      Delete
  9. hok hok!!golay pore date er golpo hok...amar o abdar roilo.. :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখছি সৌমেশ। পারলে নিশ্চয় লিখব।

      Delete
  10. Ki sundor park Kuntala di!erokom park majhe majhe dyakhai bhalo. baRir samne thakle hoyto mashe ek baar dekhtam. tar cheye ei, ekhane dyakhai bhalo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই সুমনা। বাড়ির সামনে থাকতেও তাকাই না। কালকেই ভাবছিলাম, ঘাড় তুলে আকাশটার দিকে তাকাই না পর্যন্ত। কী অবস্থা হয়েছে আমাদের।

      Delete
  11. Bhalo chhobi tolar arekta gorrar kawtha achhe. Chhobitey ki dekhachhen, seta jerokom gurutwopurno, tawtotai gurutwopurno holo je ki dekhachhen na. Ei chhneke ber kawrata jawto obhyas kawra jayy tawtoi bhalo. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ এইটা ভালো কথা বলেছেন তো। খেয়ালা রাখার চেষ্টা করব।

      আমি অবশ্য এতই আনাড়ি যে যেটা দেখতে চাই সেটাও ফ্রেমের ভেতর রাখতে পারি না, অভ্যেসে কী না হয় শুধু সেই ভেবে ক্যামেরা কামড়ে পড়ে আছি।

      Delete
  12. besh tow lagchey chobi gulo. chobi'r subject gulow bhaloi
    (shoni-robi'r kono kathay hobe na). ekhon french surrealist photographer hotey chaile hoyto aaro training dorkar, ta nahole tumi bhaloi chobi tulecho.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, অনেক ট্রেনিং দিলেও ফ্রেঞ্চ সুররিয়্যালিস্ট হবে না শম্পা সে তুমিও জানো আমিও জানি। তবে তুমি উৎসাহ দিলে দেখে আমি খুব খুশি হলাম।

      Delete
  13. khub bhalo hoyeche chhobi gulo. depth of field o bhaloi eseche dekhchi. :) amio ja pai tar e chhobi tuli, specially pahar hole anoboroto chhobi tulte thaki. kichu chhobi rule of average ei bhalo uthe jay. date er golpo shonar request amio rakhlam. :)

    ReplyDelete
  14. tomar para to baro sundor. eta Delhi'r kon dik ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সি আর পার্ক, বং মম।

      Delete
  15. Aamar songe date-e geleo nirghat loke erakom-i bolbe. Bhagyis ami blogger der songe date e jaaini kakhono...
    Chhobi bhalo hochchhe, kintu kachhe jete bhoy pachchhen keno? Phooler close-up tulun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সাহস দিচ্ছেন যখন, তুলব।

      Delete
  16. sesh duto chobi khub bhalo laglo..bisheshoto sesher akash ar krishnochura ta..amar barite shuye janla ta khule dile thik ei chobi ta fute uthto, jodio akhon mone hochhe se bodhoy onyo kono jonmer kotha..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরেব্বাস, তোমার বাড়িটা তো খুব সুন্দর তার মানে স্বাগতা।

      Delete
  17. sabkata chabi i khub bhalo...sabtheke bhalo sesherta

    ReplyDelete

Post a Comment