ডয়েশ ভেলে
উৎস গুগল ইমেজেস
গতকাল আমরা ডয়েশ
ভেলের হেডঅফিস দেখতে গিয়েছিলাম। ডয়েশ ভেলে-র আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে গিয়ে ডয়েশ তরঙ্গ,
অর্থাৎ কি না ডয়েশ দেশ থেকে যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের তরঙ্গ আকাশবাতাস দিয়ে
ভেসে ভেসে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
সোজা কথায় রেডিও।
অ্যামেরিকার যেটা ভয়েস অফ অ্যামেরিকা, ব্রিটেনের যেটা বিবিসি, আমাদের যেটা অল
ইন্ডিয়া রেডিও, জার্মানির সেটাই ডয়েশ ভেলে।
আমাদের যুগের
অনেক লোকই ছোটবেলা থেকে ডয়েশ ভেলে শুনে এসেছে। ডয়েশ ভেলের মূল উদ্দেশ্যটাই অবশ্য
তাই, বিদেশের কাছে জার্মানিকে পরিচিত করা। জার্মানির সংস্কৃতি, দর্শন,
সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ, অর্থনীতি---সবকিছু। উনিশশো তিপ্পান্ন সালে পত্তন হওয়া থেকে
ডয়েশ ভেলে এই কাজ করে এসেছে। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে বিশ্বায়নের কাজ। দিবে আর
নিবে মিলাবে মিলিবে, এই হচ্ছে ডয়েশ ভেলের মূলমন্ত্র। আপাতত তিরিশটি ভাষায় ডয়েশ ভেলের
অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। বাংলা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা। এই খবরটা এতদিন রাখিনি
কেন কে জানে। ঠিক করেছি, দেশে ফিরে গিয়ে নিয়মিত ডয়েশ ভেলের বাংলা চ্যানেলের খবর
শুনব। রেডিওতে না হোক, ওয়েবসাইটেই।
ডয়েশ ভেলের অফিস
রাইন নদীর একেবারে ধারে। অবশ্য এইটুকু শহরের প্রায় কোনও কিছুই রাইন থেকে এমন কিছু
দূরে নয়, কিন্তু ডয়েশ ভেলের বারান্দায় দাঁড়ালে রাইনের হাওয়া গায়ে লাগে। রাজধানী
বার্লিনে চলে যাওয়ার আগে এই বাড়ি পার্লামেন্টের অংশ ছিল। উনিশশো নিরানব্বই-এ
পাকাপাকি ভাবে পার্লামেন্ট পাততাড়ি গুটোলে ডয়েশ ভেলে বাড়ি অধিগ্রহণ করে। ঘাড়ের ওপর
দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটা বাড়ি দেখিয়ে গাইড বললেন, ওই বাড়িটাও একসময় পার্লামেন্টের ছিল,
আপাতত ইউ এন-এর।
ঘুরে দেখা
শুরু হল। প্রথমেই আমরা একটা অডিও স্টুডিও দেখতে গেলাম। কাঁচের ওপারে একটা ঘর, তার
ওপারে আরেকটা। সব আয়নার মতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একদম ওপারের ঘরে বসে আফ্রিকার
হাউসা ভাষায় একজন ভদ্রমহিলা খবর পড়ছেন, আর মাঝের ঘরে ইঞ্জিনিয়ার বসে সবকিছু তদারকি
করছেন। জানলাম আরবিক, ফ্রেঞ্চ, ইংরিজি, পর্তুগিজের পরে হাউসা ভাষাতেই আফ্রিকার
সবথেকে বেশি লোক কথা বলেন। খবরের মাঝে একবার ব্রেক নিয়ে ডয়েশ ভেলের সিগনেচার টিউন
বাজানো হল। খবরপাঠিকা হাত তুললেন, ইঞ্জিনিয়ার হাত তুললেন, বাজনা বাজল, বাজনা বাজতে
বাজতেই খবরপাঠিকার সামনে সাদা আলো জ্বলল, সাদা নিভে লাল আলো জ্বলা মাত্র বাজনা
থেমে গেল আর খবরপাঠিকা আবার খলবল করে কথা বলতে শুরু করলেন।
মাল্টিটাস্কিং-এর
বহরটা ভাবতে পারছেন? এত শত হাত তোলাতুলি আলো জ্বলাজ্বলির দিকে খেয়াল রাখতে গেলে
আমার দ্বারা আর খবর পড়া হত না। অথচ ওঁরা এমন অনায়াসে কাজ করছিলেন, মুখ দেখে মনে
হচ্ছিল এক্ষুনি হাই উঠবে।
তারপর আমরা গেলাম
মাস্টার কন্ট্রোলরুমে। একটা বিরাট ঘরের দেওয়াল জোড়া শত শত টিভি, হাজার হাজার
কম্পিউটার আর কোটি কোটি বোতাম। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো। দেখলেই টকাটক টিপে
দিতে মন চায়। পৃথিবীর যেখানে যেখানে ডয়েশ ভেলের তরঙ্গ পৌঁছচ্ছে, সেই সব প্রান্ত
থেকে সব সিগন্যাল এই ঘরে এসে জমা হচ্ছে। এত বড় কর্মযজ্ঞ চলছে, অথচ পাহারা দেওয়ার
লোক বলতে মোটে দুজন ভালোমানুষ দেখতে ইঞ্জিনিয়ার। দেওয়াল জোড়া টিভির কোনওটায় সোয়াহিলিতে
অনুষ্ঠান হচ্ছে, কোনওটায় পাশ্তুতে, কোনওটায় হিন্দিতে, এঁরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।
এত রকম আওয়াজে এঁদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না কেন? কারণ কোনও টিভি থেকেই আওয়াজ
বেরোচ্ছে না। স্রেফ ছবি। অডিও ঠিক চলছে কি না সেটা দেখার জন্যও ভিস্যুয়াল
ব্যবস্থা। টিভিতে সবুজ রঙের কতগুলো কলাম নাচছে, সেই নাচ দেখেই ইঞ্জিনিয়াররা বুঝে
ফেলছেন দর্শকেরা সব গান, সংলাপ, সাক্ষাৎকার ঠিকঠিক শুনতে পাচ্ছেন কি না। সায়েন্স
এগিয়েছে বটে।
কিন্তু মাস্টার
কন্ট্রোলরুমের থেকেও ইন্টারেস্টিং যে ব্যাপারটা দেখলাম কাল, সেটার কথা বলব আপনাদের
এখন। বেশিরভাগ ভিডিও রেকর্ডিং যদিও বার্লিনেই হয়, তবু বনেও গোটাতিনেক ভিডিও
স্টুডিও আছে। তারই মধ্যে একটায় আমাদের গরুর পালের মতো ঢোকান হল। ভিডিও স্টুডিওর একদিকে কুটকুটে সবুজ রঙের দেওয়াল। সেই দেওয়ালের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে দেখি
সামনে একটা তেঠ্যাঙা ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ক্যামেরার মাথায় ঘোমটা
দেওয়া। সে ঘোমটার নিচে টেলিপ্রিন্টারে কীসব লেখা ফুটে আছে। আর তার নিচে চৌকোমতো
একটা স্ক্রিন, আর সেই স্ক্রিনে...
ও মাগো, ওটা কে?
পিলে চমকে
একেবারে হাতে চলে আসার জোগাড়। টেলিপ্রিন্টারের নীচের টিভিতে আমাকে স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে। কী খারাপ দেখতে লাগছে ভাবা যায় না। যতই খারাপ দেখতে লাগুক, টিভিতে নিজেকে
দেখার উত্তেজনাই আলাদা। দলের সবাই ঠেলাঠেলি করে স্ক্রিনের ভেতর নিজেকে আঁটানোর
চেষ্টা করছিল। এদিক ওদিক থেকে খচাৎ খচাৎ করে আইপ্যাড আর আইফোনে ছবি উঠছিল। আর আমার
মতো সর্বহারা কিছু আছে, তারা বাকিদের হাতে পায়ে ধরে বলতে লাগল, প্লিজ সেন্ড মি দ্য
পিকচারস। প্লিইইইইজ। ডোন্ট ফরগেট, ওকে?
আগেও একবার কোথায় যেন শুনেছিলাম, কিন্তু কাল শুনে আবার নতুন করে চমক লাগল। ই-টিভিতে আমরা যে আবহাওয়ার খবর
দেখি, কোটপ্যান্ট পরা মহিলা সামনের টেবিলে লেনোভো রেখে পশ্চিমবঙ্গের একটা বিরাট
ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মৌসুমি বায়ুর গতিপথ দেখাচ্ছেন, ওখানে আসলে
ম্যাপট্যাপ কিচ্ছু নেই, আছে শুধু একটা কুটকুটে সবুজ রঙের দেওয়াল। সবুজের বদলে নীল
হলুদও হতে পারে, সেটা কথা নয়। কথাটা হচ্ছে ম্যাপটা ওখানে নেই। মহিলার হাত খাঁ খাঁ
দেওয়ালের ওপর ঘুরছে, মৌসুমি বায়ু মালদা পেরিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে ঢুকল বলে। এইবার
মহিলা এগিয়ে এসে কুচবিহারের ওপর হাত রেখেছেন, সেখানে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে, আরও হবার
সম্ভাবনা। আসলে কুচবিহার-টিহার সব ভোঁভাঁ, স্রেফ ফাঁকা দেওয়াল। পশ্চিমবঙ্গের
ম্যাপ হয়তো ফুটে উঠেছে মহিলার পায়ের তলায়, কিংবা সামনের দেওয়ালে। সেই দেখে দেখে
ওঁকে হাত ঘোরাতে হচ্ছে।
ঝামেলার শুধু
এখানেই শেষ নয়। এই পুরো ঘটনাটা আবার ব্যাকট্রান্সমিশন হয়ে আসছে সামনের টিভিতে,
যেখানে আমরা নিজেদের ছায়া দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। মহিলাকে সেই টিভির দিকেও নজর
রাখতে হচ্ছে অবিরত। হাঁটতে হাঁটতে ফ্রেমের বাইরে চলে যাচ্ছেন কি না, মুখ বেশি হাঁ
করে ফেলছেন কি না, শার্টের বোতাম ভুলভাল খোপে লাগিয়ে ফেলেছেন কি না।
দেখেশুনে
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। আচ্ছা শিক্ষা হয়ে গেল। এবার থেকে গা এলিয়ে রুটি বাঁধাকপি খেতে
খেতে আবহাওয়ার খবর শুনতে শুনতে যদি দেখি ঘোষক তুতলে ফেলছেন, কিংবা মালদা দেখাতে
গিয়ে মুর্শিদাবাদের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন, তাহলে আর কোনওদিন “এদের কোত্থেকে ধরে এনেছে বস্?” বলে
মুখ ঝামটে উঠব না।
আমার দূরদর্শন কলকাতা থুড়ি কোলকাতায় করা ট্রেনিং টার কথা মনে পড়ে গেল। তবে সব থেকে আকর্ষনীয় ব্যপারটা ছিল দুপুরের খাবার। ১৫ টাকায় মাছ, ভাত আর মাছের ডিমের বড়া খেতে ছাত্র শিক্ষক সবাই দৌড়, আমাদের দাপটে কয়েকদিন ক্যান্টিন এ খাবার এর অভাব দেখা দিয়েছিল...ডয়েশ ভেলে এর ক্যান্টিন কিরকম কে জানে ?
ReplyDeleteঅ্যাকচুয়ালি, আমরা শুনেছি ডয়েশ ভেলের ক্যান্টিন তল্লাটে বেশ নামকরা। আর দু'সপ্তাহ পর থেকেই আমাদের অফিস বদলে ডয়েশ ভেলের পাড়ায় চলে আসবে। তখন আমরা এখানেই লাঞ্চ খেতে আসব।
Deleteডয়চে ভেলে-র ক্যান্টিন ভাল, কিন্তু আরও ভাল তার পাশে ডয়চে পোস্ট-এর ক্যান্টিন৷ একেবারে রাইন-এর পাশে৷ নদী দেখতে দেখতে লাঞ্চ খাওয়া যায়৷ :)
ReplyDeleteঠিক ঠিক শীর্ষ। ওটাও আমাদের দেখানো হয়েছে, ক্যান্টিনের অপশন হিসেবে। তবে শুনেছি ডয়েশ পোস্টের ক্যান্টিনে খুব লাইন পড়ে। সকলেই নদী দেখতে দেখতে খেতে চায় আরকি।
Deleteকদিন এট্টু ঘুরতে গেসলাম। তাই কমেন্ট করতে পারিনি, তবে পড়েছি সব পোস্টই। যথারীতি দুর্দান্ত সব লেখা। আচ্ছা, এই রেডিওতেই কি কবীর সুমন (তদানীন্তন সুমন চাটুজ্জে) চাকুরী করতেন? শুনেছিলাম যেন উনি জার্মান দেশে ছিলেন।
ReplyDeleteহুম্ হতে পারে আবির। উইকি কী বলছে?
Deleteসুমন চাটুজ্জে ওখানেই কাজ করতেন৷ তবে তখন আপিস ছিল কোলন শহরে৷
Deleteআমার দাদুর একটা ছোট্ট মারফি বেবি ডিলাক্স ট্রানজিস্টর রেডিও ছিল যেটায় দাদু খেলার কমেন্ট্রি শুনত। পরে সেটা একটু খারাপ হয়, আর আমিও সেটা চেয়ে এলাহাবাদে নিয়ে যাই। সেটা সারিয়ে নিয়ে আমি শুনতাম। ওতে শর্ট ওয়েভও ধরত। সেই সময়ে আনন্দমেলায় শর্ট ওয়েভ শোনার হবি নিয়ে একটা প্রচ্ছদকাহিনী বেরয়, আর আমিও খুব উত্সাহ পেয়ে যাই। আমার একটা ছোট্ট ডায়েরি ছিল, তাতে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্টেশন আর তাদের ফ্রিকোয়েন্সি লেখা থাকত। তখনই ডয়েশ ভেলের সঙ্গে আমার পরিচয়।ওদের বাংলা অনুষ্ঠানটা আমি নিয়মিত শুনতাম। ভয়েস অফ রাশিয়া, ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি, রেডিও জাপান ইত্যাদির সিগনেচার টিউনও মুখস্থ হয়ে গেছিল। তারপর যা হয়, অন্যান্য হবির মতন এক সময়ে এটাও কেটে গেল।
ReplyDeleteওই আনন্দমেলার লেখাটা আমার ধারণা আমিও পড়েছিলাম আর আমারও শখ হয়েছিল দেশবিদেশের রেডিও শোনার। কিন্তু আর হয়নি। ডয়েশ ভেলে ঘোরার সময় খুব আপনার কথা মনে পড়ছিল।
Delete