সিরিয়াল মোনোগ্যামিস্ট #৪ পাসওয়ার্ড পাসওয়ার্ড

আমাদের আড্ডা খুবই “সদস্য ছাড়া প্রবেশ নিষেধ” গোছের হলেও মুখে যেহেতু সে কথা বলা যায়না, কাগজে লিখে দরজার বাইরে সাঁটাও যায়না, তাই মাঝে মাঝেই কিছু লোক ঘুরতে ঘুরতে আড্ডায় চলে আসে। সত্যি বলছি খারাপ লাগে না। নিজেদের মধ্যে তো বলার মতো কথা আর বেশি বাকি নেই, নতুন লোক এলে খানিকটা মুখ বদলায়; খাওয়াদাওয়া, তর্কাতর্কি, নরক গুলজার হয়। অতিথিরা পছন্দসই হলে তাঁরা বিদায় নেওয়ার সময় আমরা খুব করে বলি, “আবার সময় পেলেই চলে আসবেন/এস...আমরা তো প্রতি সপ্তাহে আড্ডা দিই...খুব মজা হবে” আর অপছন্দ হলে তারা দরজার বাইরে পা দেওয়া মাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে তুমুল নিন্দেমন্দ শুরু করে দিই। উইন-উইন পরিস্থিতি।

সেদিন একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা এসেছিল। আমাদের সবারই দুজনকে পছন্দ হয়েছে বেশ। মিষ্টি মতো। নতুন প্রেমের আলো এখনও দুজনের মুখেই ঝলসাচ্ছে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে থেমে একে অপরের চোখে চোখ রাখছে, হাত ধরছে। দেখলেও ভালো লাগে।

ঘুরতে ঘুরতে কথা PC ভালো না Mac ভালো থেকে কম্পিউটার ভাইরাসের স্রোত বেয়ে অনলাইন প্রাইভেসির জেটিতে এসে ভিড়ল। পাসওয়ার্ডের ব্যাপারে আমার কল্পনার দৈন্যের কথা আগেও বলেছি। নামে বেনামে যত ইমেল অ্যাকাউন্ট আছে সবের জন্য আমার একটাই পাসওয়ার্ড। আর অফিসকাছারি ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে যেখানে অ্যালফা-নিউম্যারিক পাসওয়ার্ড রাখার বাধ্যবাধকতা আছে সেখানে আমি আমার সেই সবেধন পাসওয়ার্ডটির আগে বা পিছে একখানা 1 বসিয়ে দায়মুক্ত হই। চোরের তো দায় পড়েনি যে চারদিকে এত এত গেটস, বুফে, আম্বানিরা থাকতে আমার কানাকড়ি হাতাতে চাইবে।

কথা উঠতে সবাই বলল কে কীভাবে পাসওয়ার্ড সেট করে। নিজের পাসওয়ার্ডটা বলে দেওয়া বাঁচিয়ে অবশ্যই। জন্মদিন, ফোননম্বর, বাবামায়ের নাম, পার্টনারের জন্মদিন এবং এসবের বিভিন্ন পারমুটেশন লোকের পছন্দের পাসওয়ার্ডের তালিকায় বেশ ওপরের দিকে আছে বোঝা গেল। আরও একটা কথা বোঝা গেল সবাই সবার পার্টনারের পাসওয়ার্ড জানে।

নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল ছাড়া।

তারা সেকথা আমাদের বলেনি অফ কোর্স। কিন্তু আমার চোখ এড়িয়ে যাবে কোথায়। দুজনেই সামান্য গম্ভীর হয়ে গেল। হালকা উশখুশ করতে লাগল যেন আলোচনাটা শেষ হলে বাঁচে। হুহাঁ করল, ও’পায়ের ওপর থেকে এ’পা নামিয়ে এ’পায়ের ওপর ও’পা তুলল।

আমি নিশ্চিত ওরা একে ওপরের পাসওয়ার্ড জানেনা। এবং এই না জানাটা নিয়ে খুব একটা স্বস্তিতেও নেই। ইন ফ্যাক্ট আমি বাজি রাখতে পারি এ বিষয়টা নিয়ে ওদের সামান্য মনকষাকষিও হয়েছে।

বান্টি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তো অন্তর্যামী, প্রেমের ব্যাপারে শেষ কথা।”

সে আমি প্রেমের ব্যাপারে শেষ কথা নাই হতে পারি, অন্তর্যামী তো নইই, নিজের মনেরই তল পেলাম না অন্যদের মন তো ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ওদের সমস্যাটা চিনতে আমার ভুল হয়নি। কারণ ওটা একসময় আমারও সমস্যা ছিল।

তখনকার কুন্তলার সমস্যাঃ

আমি যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম তখন আমার দেহের বয়স খুব কম না হলেও মনের বয়স অত্যন্ত কাঁচা ছিল। আনকোরা একটা প্রেম পেয়ে এমন খুশি হয়েছিলাম যে সদ্য কেনা পুতুলের মতো সেটাকে কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরতাম সারাক্ষণ। আর অন্যদের পুতুলের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতাম। চোখটা অন্য পুতুলদের মতো চকচকে কিনা, গালটা অতখানিই লাল টুকটুকে কিনা, বিছানার ওপর শুইয়ে দিলে ওই ওর পুতুলটার মতো নিজে থেকেই চোখ বন্ধ করে কিনা।

এই করতে গিয়ে একদিন একটা অমিল বেরিয়ে পড়ল। আমরা কেউ কারো পাসওয়ার্ড জানিনা। কেউ কাউকে নিজে থেকে জানানোর প্রস্তাবও দিইনি। সেদিনের আগে সত্যি বলছি সেটা জানতে চাওয়ার কথা আমার মাথাতেও আসেনি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মাথার ভেতর অস্বস্তিটা পাকাপাকি বাসা বেঁধে ফেলল।

একদিন বলেই ফেললাম। “আমি তোকে আমার পাসওয়ার্ড বলে দিই?” উল্টোদিকের মুখটা সামান্য সতর্ক হয়ে গেল, “কেন?” “না এমনিই। আমি না থাকলে তুই আমার মেলটেল চেক করতে পারবি।” উল্টোদিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, “কী দরকার, যেমন আছে থাক না।”

তখনকার আমার প্রতিক্রিয়া এখন আমার নিজেরই কল্পনা করতে অসুবিধে হচ্ছে কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছিলাম। তার মানে প্রেমটা এখনও সিকিওরড নয়! আমাকে না জানানোর মতো তার মানে এখনও ওর কিছু আছে! কী হবে! আমি কি ভুল করলাম?!

এখনকার কুন্তলার মতেঃ

ভুল আমি করেছিলাম নিঃসন্দেহে কিন্তু সে ভুলের সাথে পাসওয়ার্ড জানা না জানার কোন সম্পর্ক নেই। আর আমার লক্ষ লক্ষ ভুলের একটা ছিল ওই প্রেম মিলিয়ে দেখতে যাওয়াটা। সবার প্রেম সত্যিই একরকম হয় না। একেবারে আকাশপাতাল আলাদাও হয় না, তাহলে আমার এই সিরিয়াল মোনোগ্যামিস্টের ওস্তাদি চলত না, কিন্তু ছোটখাটো জায়গায় পার্থক্য থেকেই যায়। পাসওয়ার্ড জানলেই প্রেমের ভিত শক্ত হল আর না জানলে হল না এটা ভুল ধারণা। পাসওয়ার্ড বলে দিয়েও অনেককিছু লুকনো যায়, না বলেও সবকিছু উজাড় করে দেওয়া যায়।

প্রেমিক-প্রেমিকাযুগলের কেউ যদি এ বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসে, যদিও আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তাহলে আমি তাদের এই কথাটাই বলব। এখন পাসওয়ার্ড জানাটা খুব জরুরি মনে হচ্ছে, জানার পর দেখবে আর সেটা খুলে অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখার উৎসাহ থাকবে না। আর যদি সত্যি সত্যি পাহারা দেওয়ার জন্য পাসওয়ার্ডটা নেওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে সেটা গভীর গোলমালের সূচক। যে গোলমাল থেকে উদ্ধারের পরামর্শ দেওয়া এমনকি আমার পক্ষেও সম্ভব না।

আমি তো মনে করি পাসওয়ার্ড দিয়ে ইমেল খুলে ভয়ানক কিছু আবিষ্কার করার থেকে ‘ব্লিসফুলি ইগনোর‍্যান্ট’ থাকা ভালো। যদিও এ বিষয়ে সবার মত মিলবে না জানি।

কাজেই যদি একে ওপরের ওপর বিশ্বাস থাকে তাহলে পাসওয়ার্ড নিয়ে বিলকুল মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আর অত পাসওয়ার্ড মনে রাখাও তো ঝামেলা, যেচে সে ঝামেলা ঘাড়ে নিয়ে লাভ আছে?