শনি রবির গল্প



কী খবর? কেমন কাটল উইকএন্ড? কোথায় কোথায় ঘুরলেন, কী সিনেমা দেখলেন, কী ভালোমন্দ খেলেন, কী জামাজুতো কিনলেন?

আমার এসপ্তাহান্তটা ভয়ানক ব্যস্ত কেটেছে। এক বন্ধু এসেছে দূর দেশ থেকে। তাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে গত ৪৮ ঘণ্টা, ৪৮ মিনিটের দ্রুততায় কেটে গেল। নতুন লোকদের নিয়ে এই এক মুশকিল। এই দেখাও সেই দেখাও, লোকাল নাইটলাইফ এক্সপ্লোর কর, চোখে সর্ষের তেল ঘষে হাতেনাতে প্রমাণ দাও যে দ্য সিটি সত্যি সত্যিই নেভার স্লিপস। শনিবার সকালে উঠে আরাম করে বসে পাউরুটিতে জ্যাম মাখাচ্ছি, বন্ধু হাই তুলে কান চুলকে বললেন, “আজকে তবে কী প্ল্যান?”

অনর্থক জেনেও আমি একটা মরিয়া শেষ চেষ্টা করলাম। মুখের পেশি যথাসম্ভব রিল্যাক্সড রেখে, চোখে চোখ না ফেলে বললাম, “প্ল্যান আবার কী। টিভি আছে দেখ, ফ্রিজ আছে খুলে খাও, বালিশ আছে জাপটে ঘুমোও।”

ব্রেকফাস্ট গুছিয়ে, গ্যাস নিভিয়েছি কিনা পরীক্ষা করে, বাড়ির প্রতিটি জানালা বন্ধ করে, দরজায় চাবি ঘুরিয়ে, ঘুরিয়েছি কিনা নিশ্চিত হতে আবার খুলে আবার ঘুরিয়ে বেরোতে বেরোতে মিনিট কুড়ি লেগে গেল। বন্ধু মাথার চুল হাত দিয়ে আঁচড়ে, শার্ট গলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে আকাশ বাতাস পরীক্ষা করছিলেন। বেরোতেই বললেন, “উফ মেয়েদের বেরোতে এত সময় লাগে কেন কে জানে...ঠিক কী কর বলতো বাড়ির ভেতর?”

সিগন্যাল থেকে ডানদিকে ঘুরলে অভ্রংলিহ শপিং মল, বাঁদিকে ঘুরলে নদীর ধারে বিরাট জায়গা জুড়ে শহরপালিকাদের তৈরি পার্ক। সে পার্কে উঁচু উঁচু গাছ, বিরাট বিরাট ঘাসে ঢাকা মাঠ, মাঠের মাঝে মাঝে দোলনা আর হালকা জঙ্গলের বুক চিরে মেঠো হাইকিং পথ। সে পথ দিয়ে তীরচিহ্ন দেখে দেখে অনেকটা হাঁটলে শেষমেশ একটা খোলা জায়গায় পৌঁছনো যায়। নদীর ওপর কাঠের ঝুলবারান্দা। বারান্দার রেলিং-এ বসে পাখির ডাক শোনো, পা দোলাও, সানগ্লাস পরে বেঁকা হাসি হেসে ছবি তোলো, তোমার খুশি।

বলাই বাহুল্য আমরা বাঁদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোলনাটা তো একটা কারণ বটেই কিন্তু তার থেকেও বড় কারণ হল যে আর দশটা লোক বেড়ানোর জায়গা বলতে শপিং মল বুঝতে পারে, আমরা বুঝি না। আমরা তাদের দেখে নাকমুখ কুঁচকে বলি, “এরা কারা বস”। ওদের মতো আমরা এখনও আমাদের কোমল প্রবৃত্তিগুলোকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিইনি। নির্লজ্জ পণ্যবাদের স্রোতে চোখ বন্ধ করে নিজেরাও ভাসিনি। আমাদের এখনও খোলা আকাশ ভালো লাগে, চুলের ভেতর দিয়ে বিলি কেটে বয়ে যাওয়া হাওয়া, আর প্রাচীন গাছের গম্ভীর ছায়ার পাহারা এড়িয়ে গালের ওপর লুকিয়েচুরিয়ে চুমু খাওয়া সূর্যের আলো। তুলনা কি হয়, আপনারাই বলুন?

হাঁটতে শুরু করলাম। বন্ধুর হাতে পায়ে ধরে দোলনার দিকে টেনে নিয়ে গেলাম। দিব্যি লাগছিল দুলতে কিন্তু বন্ধুর মুখের দিকে চোখ পড়লেই অর্ধেক আনন্দ মাটি হয়ে যাচ্ছিল। কী ভয়ানক ব্যাজার বাপরে। পাশের দোলনাটা খালি পড়ে ছিল। কত করে বললাম “একটু চড়ে দেখ, ভালো না লাগলে নেমে যেও’খন”। কিছুতেই শুনল না। মেল ইগো আর কাকে বলে। অগত্যা আমাকেও নেমে পড়তে হল। মেল ফিমেল ইগো নিয়ে খটামটি করতে করতে আবার হাঁটা শুরু করলাম। পাঁচ মিনিট পর পর বন্ধু জানতে চাইছিলেন, “আরও দূর?” আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। আগেরবার এসেছিলাম যখন রাস্তাটা এত লম্বা লাগেনি কিন্তু। ঠিক যাচ্ছি কিনা কে জানে। তাছাড়া আগেরবার এসেছিলাম অক্টোবরে। সে ঝিমন্ত সূর্যের জায়গায় এই জুলাইয়ের মধ্যগগনের চাঁদিফাটা রোদ। আরো বেরোও হুড়মুড় করে সাতসকালে। আমার মনে মনে রাগ ফুলেফেঁপে উঠছিল।

অনন্তকাল পরে অবশেষে নদীর ধারের ঝুলবারান্দার দেখা মিলল। বন্ধু দাঁত বার করে শুধরে দিলেন, “নদী নয় বল নালা।” সত্যি, জল শুকিয়ে কী চেহারা হয়েছে জায়গাটার। কালো কালো ভাঙাচোরা ডালপালা পড়ে আছে এদিকওদিক। পাখিটাখির চিহ্নমাত্র নেই। ক্যামেরাটা নিয়ে গিয়েছিলাম হাতে ঝুলিয়ে, কিন্তু দৃশ্য দেখে আর ছবি তোলার উৎসাহ উবে গেল। ঘামতে ঘামতে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। হয়ত ভাবছিলাম এই এক্ষুনি রোদ নেমে গিয়ে হাওয়া চলবে, গাছে গাছে পাখিরা ফিরে আসবে, নদীটাও মন্ত্রবলে কিছু একটা করে আরেকটু সুন্দরী হয়ে উঠবে। আমাদের কল্পনার মতো।

কিছুই হলনা। আমরা ধুর-টুর বলে আবার অতখানি রাস্তা হাঁকিয়ে ফেরত এলাম। ততক্ষণে খিদে পেয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার মুড নেই। কাজেই এবার সিগন্যাল থেকে বাঁদিকে টার্ন নেওয়া হল। দূর থেকে মল চোখে পড়ল আর পিঁপড়ের মতো কালো কালো মানুষ। কালো ভারি দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই...

এসি! কুলকুলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরের সাথে সাথে প্রাণটাও জুড়িয়ে গেল। কী ঝলমলে করে সাজিয়েছে চারদিকটা। কিছু আছেটাছে নিশ্চয়। সিলিং থেকে রঙবেরঙের বেলুন ঝুলছে, ফোয়ারায় ঝকমকে আলো। সবার মুখেও সেই আলো ঝলসাচ্ছে। বাচ্চারা ছুটছে, বাবামায়েরা গর্বিত মুখে তাকিয়ে আছেন। আমরা একটা ভয়ানক আঁতেল দেখতে কফির দোকান পছন্দ করে ঢুকে পড়লাম। ঢোকার মুখে বন্ধু ভুরু নাচিয়ে ইশারা করে দেখালেন। এই দোকানে কেবলমাত্র ফেয়ার ট্রেড কফি বিক্রি হয়। যাক পরিষ্কার বিবেকে কফি খাওয়া যাবে।

কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আমরা খুব হেসে হেসে গল্প করলাম। লোক দেখলাম। দেখালাম। পাবলিকের রুচির দৈন্য নিয়ে সখেদে মাথা নাড়লাম। কফি খেয়ে উঠে বইয়ের দোকানে গিয়ে ক্যালভিন আর হবসের দুটো কমিকস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, ডিসকাউন্ট শেলফ থেকে তিনটে চেনা বই কিনে বাড়ি চলে এলাম।

রবিবার সকালে যখন আবার “আজকের প্ল্যান”-এর প্রসঙ্গটা উঠল তখন একবাক্যে কোথায় যাওয়া ঠিক হল সেটা আপনাদের আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়? আমি ঠিক করে ফেলেছি, ছুটির দিনে এবার থেকে শপিং মলেই ঘুরতে যাব। বুদ্ধিজীবীরা ঘরে বসে চমস্কি পড়তে পারেন, কিসলোস্কি দেখতে পারেন, চাইলে এমনকি পার্কে গিয়ে ঘামতে ঘামতে প্রকৃতির শোভা অবলোকনও করতে পারেন, আমি আর ওর মধ্যে নেই।     

Comments

  1. Amar weekend ta khubi baje geche. Thursday bikel-e amar meye ke niye vet er kache gelam, giye emon hachlam je vet jigyesh korlo "are you sure you are not allergic to cats?" Tarpor raate gola byatha hoye sordi-jwor holo. Friday Tylenol (night time) kheye saradin ghumolam, office gelam na. Emon email korlam je "tomader sordi jwor hobe chhoach lege, tai office jacchi na" jeno na giye oder ke kritartho korlam!! Shonibar bikel theke ektu ga jhhara diye uthlam, golper boi porlam, chicken stew ar bhaat khelam, Arnab ke diye barir sob kaj koralam.. :D Ajke abar office pouche gechi :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. যা রিয়া উইকএন্ডটা বিছানায় শুয়ে কাটাতে হল? তবে এখন যে সুস্থ বোধ করছ এটা ভালো ব্যাপার।

      Delete

Post a Comment