প্রত্যাবর্তন পোস্টঃ বন্ধুত্বের রহস্য



হ্যালো হ্যালো হ্যালো। কেমন আছেন সবাই? এতদিন কেমন ছিলেন? মন শরীর সব ভালো আছে তো? এ’কদিনের অদর্শনে রোগা হয়ে যাননি তো আমার মতো? আমার অনুপস্থিতিতে অবান্তরের খেয়াল রাখার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ আর বুকভরা ভালোবাসা জানাই। মন থেকে। আপনাদের ভালো ভালো মন্তব্য এখন আরাম করে রয়েসয়ে পড়ছি। জুতসই প্রত্যুত্তর ভাঁজছি মাথার ভেতর। ভাঁজা হয়ে গেলেই টাইপ করে ফেলব।

*****

বন্ধুত্ব করার সবথেকে সোজা আর চটজলদি রাস্তা কী বলুন তো? একজন ‘কমন শত্রু’ চিহ্নিত করে ফেলা। কোনো একজন বিশেষ মানুষকে দেখলেই যদি চারপাঁচজন লোকের রাগ, দ্বেষ বা গা-জ্বলুনির ভাব হয় তাহলে সেটা সমমনস্কতা, সমবয়স্কতা, কবীর সুমন বা ফরাসি সিনেমাপ্রীতি ইত্যাদির থেকে বন্ধুত্ব পাতানোর পক্ষে অনেক বেশি কাজ দেয়। যে ক্লাসের শিক্ষকের হোমওয়ার্ক যত নির্মম সে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য তত বেশি। যে অফিসের বস যত বিরক্তিকর, সে অফিসের কর্মীরা একে অপরের প্রতি তত নিবেদিতপ্রাণ।

ভর সন্ধ্যেবেলা এয়ারপোর্টে আটকা পড়ে বসেছিলাম। প্লেন ছাড়ার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায়। দক্ষিণের কোনো এক শহরের আকাশে বজ্রবিদ্যুৎ সহযোগে বৃষ্টি নেমে ফিরতি প্লেন না আসায় আপাতত কখন ছাড়বে বলা যাচ্ছিল না। ভিড় বাড়ছিল, এসির ঝাঁঝ কমছিল, মানুষের মেজাজ চড়ছিল। অনির্দিষ্টকাল পাশাপাশি মুখ বুজে বসে থাকতে হবে জেনেও কেউ কারো সঙ্গে আলাপ করার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নিচ্ছিল না। জাপানি পুতুলের মতো মিষ্টি ঘুমন্ত বাচ্চাকে স্ট্রোলারে শুইয়ে তরুণী মা ক্লান্তমুখে অপেক্ষা করছিলেন কেউ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে বলছিলনা, “হোয়াট আ সুইইইইট বেবিইইই”।

রাগের আরও একটা কারণ ছিল অবশ্য। এদিকের আকাশে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই বহুদিন, মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা যা ঝরেছে, মাটি ভেজানর আগেই ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেছে। জ্বলে যাচ্ছে চারদিক। এর মধ্যে অন্য কোথাও অঝোরে বর্ষা নেমেছে, আকণ্ঠ ভেজাচ্ছে সেখানকার মাটি বাতাস গাছপালা আর তারই ফলস্বরূপ আমরা হাঁ করে মাঝপথে বসে আছি---রাগ না হলেই আশ্চর্য।

বসে বসে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, এমন সময় ভদ্রলোকের আবির্ভাব ঘটল। ভদ্রলোক না বলে ছোকরা বলাই উচিত অবশ্য। মুখটার দিকে ভালো করে তাকালে শেষকৈশোরের আভা এখনও ধরা পড়ে যায়, কিন্তু বাকিটুকু পেরিয়ে মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পেলে তো। হাতকাটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের গেঞ্জির ভেতর থেকে স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে। শরীর জুড়ে মাংসপেশির বন্যা। চকচকে ন্যাড়ামাথা থেকে থাকথাক পেশি পিঠের দিকে নেমে গেছে, বাইসেপ ট্রাইসেপ কোনটা কাকে বলে জানিনা কিন্তু সবকটাই যে এনার আছে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। “এদিকে চারশো, এদিকে চারশো”র ফুল সেট। ফুলে ওঠা দশাসই বুকের নিচে হাতের মুঠোয় ধরা যায় সিংহকটি, কটিতটের খাটো হাফপ্যান্টের ফোকর গলে মাটি ছুঁয়েছে দুটো বলিষ্ঠ পা। সে পায়ে সবল টেংরি, পুরুষ্টু গুলি আরও নানারকম মাংসপেশি ঠাসাঠাসি।

তবে মাংসপেশিটা আজকাল আর নতুন কথা নয়। অনেকেরই থাকে। ভদ্রলোকের বৈশিষ্ট্যটা হল উনি ওনার শরীর ভর্তি মাংসকে পরমযত্নে চিত্রিত করেছেন। বহুবর্ণে। ডান বাঁ দুই বাহুকে বেষ্টন করে উঠেছে দুই আগুনখেকো ড্র্যাগন। তাদের মুখ থেকে হলকা বেরোচ্ছে। মণিবন্ধে কে জানে কোন লুপ্ত কাল্টের সিলমোহর। কপালের ওপর দু’ভুরু ঘিরে শুয়ে আছে লালনীল খোলসওয়ালা দুটো হিংস্র সাপ। পিঠের ছবিটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা তবে বাজি রাখতে পারি সেটা কোনো পিশাচের হাঁ-করা হাসিমুখ। সামনে গেঞ্জির গলার ওপর দিয়ে উঁচিয়ে আছে একটা বেয়নেট। আর সে বেয়নেটের মুখ আলো করে ফুটে আছে একগুচ্ছ রক্তলাল বুনো গোলাপ।

ঠিক ভদ্রলোকের কণ্ঠনালীর ওপর।

তখনও কোনো চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছিল না কোথাও। বড়রা তালিমপ্রাপ্ত চোখ স্মার্টফোনে নিবদ্ধ রেখেছিলেন, বুড়োরা চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছিলেন আর পাঁচ কিংবা তার কম বছর বয়সিরা-যাদের এখনও যন্ত্রের থেকে মানুষে আগ্রহ বেশি-তারা মায়েদের গা ঘেঁষটে ড্যাবড্যাব করে ড্র্যাগন আর গোলাপফুলের দিকে তাকিয়েছিল।

ঠিক তক্ষুনি চারদিকের গুনগুন ছাপিয়ে তীব্র আর্তনাদে একটা ফোন বেজে উঠলো। বুড়োরা বুক চেপে ধরে নিদ্রা ভেঙে লাফিয়ে উঠলেন, বড়দের চোখ স্মার্টফোন থেকে ছিটকে সরে এল। শিশুরা আরও উদগ্রীব হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, কার ফোন, কী ব্যাপার।

ব্যাপার তারপর যা ঘটল সে লিখতে গেলেও “কলমের কালি শুকাইয়া যায়।” আমাদের চিত্রবিচিত্র ছোটভাই কান থেকে গান টেনে নামিয়ে ফোন মুখের কাছে নিয়ে রেগে আগুন হয়ে ওপারের লোকটাকে তুলো ধুনতে লাগলেন। রাগের চোটে তাঁর চোখ ভাঁটার মতো জ্বলতে লাগল, কেঁদো গলার শিরা ফুলেফেঁপে উঠলো, মুখ দিয়ে সুবচনীর স্রোত ছুটতে লাগল আর সেই স্রোতের সাথে নুড়ির মতো থুতুবিন্দু ছিটকে ছিটকে আশেপাশের লোকের গায়ে এসে বিঁধতে লাগল।

ততক্ষণে উপস্থিত জনতার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সবাই কয়েক পা করে পিছিয়ে গেছেন। তাতে ভিড়ের মাঝে পাড়াগেঁয়ে রঙ্গমঞ্চের মতো একটা গোলাকৃতি ফাঁক তৈরি হয়েছে। সেই তাৎক্ষণিক স্টেজের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রঙচঙে ছোটভাইয়ের তাণ্ডবলীলা চলতে লাগল। কতক্ষণ চলল মনে নেই। অনন্তের কাছাকাছি হবে।

শুধু মনে আছে ছোটভাই তাঁর কথার চাবুক থামিয়ে কানে ফের ইয়ারপ্লাগ গুঁজে দুমদাম করে এয়ারপোর্টের মাটি কাঁপিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর চারদিকটা কীরকম অস্বাভাবিক নিঃস্তব্ধ লাগছিল। মিনিটখানেক পর ধাতস্থ হয়ে সবাই নড়াচড়া শুরু করল। জোড়া জোড়া সমব্যথী চোখ একে অপরকে প্রথমবার হাই বলল। ঠোঁট থেকে ঠোঁটে স্বস্তির হাসি ছুঁয়ে গেল। চেয়ার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অবিবেচক লটবহর মেঝেতে নামিয়ে প্রথমবার কেউ বলল, “সিট সিট।” তরুণী মায়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাজ্ঞ বৃদ্ধা জানতে চাইলেন, বাচ্চার বয়স কত? রাত্তিরে ঘুমোয়? প্রাপ্তবয়স্করা দেশের হাল নিয়ে সখেদে মাথা নাড়লেন। হিপিরা এয়ারপোর্টে কোথায় ভিগ্যান স্যান্ডউইচ পাওয়া যাচ্ছে সেই তথ্য চালাচালি করল। পাঁচের নিচেরা আগের মতো সবাইকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে কাঁচের দেওয়ালের ওপারের বিরাট খোলা আকাশটার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চিরে দিয়ে ছুরির মতো ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। বৃষ্টি। আঃ।

তার আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই যে কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য একখানা ঝড়তিপড়তি স্পেয়ার এয়ারক্র্যাফটের ব্যবস্থা করে বোর্ডিং-এর ঘোষণা করতে শুরু করে দেবেন সেটা নিয়ে আপনাদের সন্দেহ ছিল কি? আমার তো ছিল না।   

Comments

  1. Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ রুচিরা।

      Delete
  2. Bhurur opor hinsro saap? Amar maa jodi ei loktar maa hoto, mathay halka chNaati mere bolto, mukhta dhuye esho babu. Parar lokey dekhle ki bolbe? :/

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভাগ্যিস মা আর মায়ের চাঁটি আর পাড়ার লোকের বেঁকা কথা ছিল বিম্ববতী। কত বোকামো থেকে যে ওরা আমাকে রক্ষা করেছে।

      Delete
  3. বেশ লেগেছে পড়তে। বিশেষ করে শেষটা... :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ ঐকিক।

      Delete
  4. আরে, এ তো "লগান"এর শেষটার মত। ম্যাচও জিতল, বৃষ্টিও নামল, বৃটিশও চলে গেল, বিয়েও হয়ে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ আমার এরকম মিলনান্তক শেষই পছন্দ।

      Delete
  5. bancha gelo je fire eshechho... kemon berale? kothay ghurle, ki dekhle?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে ধুর বুড়োবয়সের আবার বেড়ানো সোহিনী। বোঝই তো। কর্তব্য সারতে গিয়েছিলাম। তবে কর্তব্যটা ভালোয় ভালোয় সমাধা হয়েছে বলেই তো মনে হয়েছে। কেউ চটেনি, রাগ করেনি, বকেনি। আবার কী চাই বল?

      Delete
  6. Hehe...mojar byapar! Ar common shotru'r byapar tao khub sotyi. 2 din agei amader manager ekta meeting e bolchilo je kono project e jodi khub beshi chap thake, sondhye obdi kaj korte hoy, tahole sei team er spirit bhalo thake, closeness toiri hoy. Eta ami nijei dekhechi amader team e. Ar paji-teacher der class e to hoyei, gota India tei to nationality ta asholey hochhe negative nationality. Common shotru jotodin chhilo, sob region gulo besh jege uthechilo. Shotru chole jetei ekhon east-west-north-south e or against e lorai shuru korlo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Negative nationality র ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং বলেছ রিয়া। কথাটায় যুক্তি আছে।

      Delete
  7. Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ তিন্নি।

      Delete

Post a Comment