বোনের বিয়ে
নাম নিয়ে ঝামেলাটা অনেক বাড়িতেই একটা কমন
ব্যাপার। অনেক বাড়িতেই নামের সঙ্গে নাথ, শঙ্কর, শেখর, কিশোর ইত্যাদি সাফিক্স থাকে যেটাকে
বংশপরম্পরায় বয়ে নিয়ে যেতে হয়। তবে এ ঝামেলাটা মূলত ছেলেদেরই পোয়াতে হয়। মেয়ে হয়ে
জন্মানোর গুটিকয়েক সুবিধের মধ্যে এটা অন্যতম বলে আমি মনে করি। তবে কিছু কিছু
বাবামা থাকেন যাঁরা মেয়েদের রেহাই দেওয়ার পক্ষপাতী নন। সীতার সঙ্গে গীতা মেলাবেন,
গীতার সঙ্গে নমিতা, অর্চনার সঙ্গে আলপনা, আলপনার সঙ্গে কল্পনা, এই সব যতক্ষণ পারেন
চালিয়ে যাবেন। সব উদাহরণই আমার নিজের বাড়ি থেকে দিলাম। ভাগ্যিস কল্পনার পরে আর
মেয়ে হয়নি, তাহলে হয়তো তার নাম জল্পনা রাখা হত। কিছুই বলা যায় না।
তবে সেরকমটা যে একেবারে হয় না তা নয়। সে-ও
দেখেছি। আমার সঙ্গে গান শিখত দুই বোন। সোনামণি সরকার আর খুকুমণি সরকার। যখনকার কথা
বলছি তখন সোনামণি কলেজে আর খুকুমণি ক্লাস টুয়েলভে পড়ে।
এক্ষেত্রে বাঁচার একমাত্র রাস্তা হল প্রথম
সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করা। যত ঝড়ঝাপটা বোনেদের ওপর দিয়ে যাবে। আমার অবশ্য নিজের
ভাইবোন নেই, কিন্তু তুতো বোন আছে খানদুয়েক। বড় জনের ডাকনাম মনা। তারপরের জন হচ্ছি
আমি, সোনা। ইন ফ্যাক্ট আমার নাম রাখার সময় কারও মনার সঙ্গে ছন্দ মেলানোর কথা মাথায়
আসেনি। রাখার পর খেয়াল হয়েছিল যে আরে, মনাসোনা বেশ শুনতে লাগছে তো!
আমার জ্যাঠতুতো ছোটবোনের ভাগ্য তখনই নির্ধারিত
হয়ে গিয়েছিল। জেঠি যখন হাসপাতাল থেকে মেয়ে কোলে বাড়ি ফিরলেন, সবাই ঢাকঢোল পিটিয়ে
কন্যার নাম রাখল টুনা।
*****
সেই টুনার বিয়ে হবে সামনের সপ্তাহে। বাড়িতে
উত্তেজনার আর অন্ত নেই। ফোন করলেই শুনি আজ এর জন্য সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ি কেনা হয়েছে
তো কাল ওর জন্য গিলে করা পাঞ্জাবি। প্যান্ডেল, পুরোহিত, ক্যাটারার নিয়ে জেঠু
নাকানিচোবানি খাচ্ছেন, আদি ঢাকেশ্বরীতে জেঠি প্রায় তাঁবু গেড়ে ফেলেছেন। মা-ও লকার
থেকে গয়নাটয়না এনে রেডি। ঠাকুমার বিশেষ সাড়াশব্দ নেই, শরীরটা বিশেষরকম খারাপ
হয়েছে। তবু যখনই পারছেন বিছানায় শুয়ে শুয়েই মায়ের কাছে ছোট নাতনির বিয়ের গল্প
শুনছেন। আর ক্ষীণকণ্ঠে জানতে চাইছেন,
“সোনার বিয়া হইব না?”
আমারও নেমন্তন্ন হয়েছে বিয়েতে। জেঠুজেঠি,
মনাদিদি, টুনা, সবাই মিলে একশোবার করে ফোনে বলেছে, “আসতেই হবে, না হলে কথা বলব না।”
কাজেই আমি বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে বোনের বিয়ে খেতে বাড়ি যাচ্ছি।
কোথাও যাওয়ার এই অংশটুকুই আমার সবথেকে খারাপ
লাগে। বাক্সপ্যাঁটরা বাঁধার অংশটা। আমি নিজে মিনিম্যালিস্ট প্যাকিং-এ বিশ্বাসী।
একটা ব্যাকপ্যাকে যে যে জিনিস না ধরে, সে সে জিনিসের আসলে জীবনে কোনওই দরকার নেই,
এটাই আমার মোটো। কিন্তু আমার মা সেটা মানেন না। তিনি আইবুড়োভাতে আমাকে একসেট
শাড়িব্লাউজ পরে দেখতে চান, বিয়েতে আরেক সেট। সেটের সঙ্গে ম্যাচিং করে পাথর
বসানো চুড়ি আর চন্দ্রাণী পার্লসের দুল। এর ওপর ওষুধবিষুধ, গামছারুমাল, চার্জার
ল্যাপটপ তো আছেই।
আজ সকালে অফিসে বেরোবার আগে সে সব গুছোতে গিয়ে
আমার যে অবস্থাটা হয়েছিল, সেটাকে ল্যাজেগোবরে বললে কিছুই বলা হয় না।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছি, কোথায়
কী কী গোলযোগ ঘটতে পারে সে সম্পর্কে আগেভাগে জানার একটা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে আমার
মায়ের। আপনার মায়েরও আছে নাকি এ রকম? আমি যখন নিশ্চিন্ত ছিলাম যে সবকিছু
আন্ডার কন্ট্রোল আছে, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্যাগের জিপ খুলব আর দুমদাম করে জিনিসপত্র ভেতরে ফেলব, তখন
মা পরশু থেকে ক্রমাগত বলে চলেছিলেন, “সোনা এইবেলা ব্যাগ গুছিয়ে রাখো বলছি।” আজ
সকালে উঠে আরাম করে আড়মোড়া ভেঙে ব্যাগের জিপ খুলতে গিয়ে দেখি জিপ নেই। ইন ফ্যাক্ট
ব্যাগটাই নেই।
সেটা আছে পাশের পাড়ায় বন্ধুর বাড়িতে।
তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে যেটা ঘটল সেটা ভাষায়
ব্যাখ্যা করা আমার কর্ম নয়। ফোন, চিৎকার, হুড়োহুড়ি। শাড়ি খুঁজতে বিছানার গদি উলটে
ফেলে, বক্সখাটের ডালা খুলে খাটের ভেতর নেমে পড়ে দুই হাতে সুটকেস হাঁটকানো। ফ্রিজ
খুলে একদা বিশালকায় এক পেঁপের সিকি অংশ আবিষ্কার এবং পাছে ফিরতে ফিরতে পচে যায় এই আশংকায়
সেই পেঁপের কিয়দংশ ভক্ষণ। রান্নাঘরের ট্র্যাশ বার করা। এ ছাড়া কিছু কিছু কাজ
যেগুলো কোনও পরিস্থিতিতেই বাদ দেওয়া যায় না, যেমন চুল আঁচড়ানো, স্নান করা, দাঁত
মাজা, অফিস যাওয়ার মতো সভ্যভব্য জামাকাপড় পরা, সেগুলো তো করতেই হল।
এবং এই সবক’টা কাজ করার সময় এই কথাটা মাথার ভেতর
ক্রমাগত হাতুড়ি পিটে গেল যে অফিসে গিয়ে আমাকে আড়াইখানা রিপোর্ট, শুরু থেকে শেষ
পর্যন্ত লিখে, বেলা বারোটার মধ্যে জমা দিতে হবে।
কিন্তু সময় তো বসে থাকে না। ব্যাগও
ফাইন্যালি গোছানো হল, দরজার তালায় চাবিও অবশেষে ঘোরানো হল। ঘোরানো মাত্র আবার খুলে
ছুটে ভেতরে গিয়ে গ্যাস আর লাইটের সুইচ অফ করা আছে কিনা চেকও করা হয়ে গেল। সব সেরে
যখন পিঠে ল্যাপটপ আর কাঁধে বিরাট ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম, আমি সত্যিই নিজের
চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
যদি না এদিকওদিক থেকে সবাই সন্দেহজনকভাবে আমার
দিকে তাকাত। বাড়ির দারোয়ান, বাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে ওঠা বাড়ির মালিক, বাড়ি বানানো মিস্ত্রির
দল, বাড়ির পোষা কুকুর। আমার একটু একটু গর্বই হচ্ছিল। শুক্রবার এত লটবহর নিয়ে অফিস
যাওয়া মানেই, উইকএন্ডে বেড়াতে যাওয়ার ঘোষণা। সবাই আমাকে দেখে দেখে কী রকম হিংসেয়
জ্বলেপুড়ে মরছে, ভেবে ভেবে আমি ক্রমশ খুশি হয়ে উঠছিলাম।
এমনকি একটা অটোর পেছন পেছন ছুটে যখন তাকে থামিয়ে
জিজ্ঞাসা করলাম মেট্রো স্টেশন যানা হ্যায় কে নেহি, সেও হাঁ করে আমার মুখের দিকে
তাকিয়ে রইল। মুখ হাঁ করেই মাথা ওপরনিচে হেলিয়ে হ্যাঁ বলল।
ভীষণ খুশি হয়ে অটোতে উঠে গুছিয়ে বসে সামনের দিকে
তাকাতেই অবশ্য আমার গর্বটর্ব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দেখলাম অটোওয়ালার কানের পাশের
আয়নাটায় আমার থালার মতো গোল মুখ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, আর সেই গোলমুখ ঘিরে জ্বলজ্বল করছে
ভিকো টারমারিকের হলদে ফোঁটা। আঙুলের ডগায় নিয়ে অভ্যেস মতো লাগিয়েছি, মেশানোর আর
সময় হয়নি।
*****
যাই হোক। এসব ছোটখাট ব্যাপারে আমি ঘাবড়াই না।
যেটাতে ঘাবড়াচ্ছি সেটা হচ্ছে, আগামী বেশ কয়েকদিন আমার আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
নিজেকে যতটুকু চিনি তাতে জানি বিয়ের হট্টগোল আর মাংসপোলাও মণ্ডামিঠাই থেকে দু’দণ্ড
ছুটি পেলে আমি প্রথমে অবান্তরটাই লিখতে বসব, কিন্তু ছুটি আদৌ পাব কি না সে
ব্যাপারে শিওর হতে পারছি না।
কাজেই এই পোস্টটা লিখে চার-পাঁচদিনের মতো হাওয়া
হচ্ছি। চাইছি না মোটেই, তবুও হতে হচ্ছে। আপনারা সবাই খুব ভালো হয়ে থাকবেন।
অবান্তরকে চোখেচোখে রাখবেন। আমাকে ভুলে যাবেন না।
দেখা হবে। টা টা।
Khub bhalo kore biebarir moja kore esho. Bie-bari manei darun darun sob galpo, ar abantor-er malik er haat e pore sei sob galpo aro akorshonio hobe jani :-). tomar boner jonye roilo onek subhechha.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা। সে তো ঠিকই, গল্প জমবেই, আর সেই গল্প আপনাদের না বলতে পারলে আমার ভাতও হজম হবে না।
Deleteমন দিয়ে ভোজ বাড়ির মন্ডা মিঠাই সাঁটানোর সময় খেয়াল রাখবেন লোকজন কেমন ভাবে তাকাচ্ছে। দিল্লীর অটোওলা স্টাইলে তাকালে বুঝবেন আবার "ভিক্কো" কেস - তাই আয়না দেখার আগে মুখটা মুছে নেবেন। আর এই পোস্টটা যদি মায়ের চোখে পড়ে তাহলে কিন্তু "সোনা" নয় "সোনা আ আ আ আ" ডাকটা (যেটা সবাইই কম বেশি শুনেছে মায়ের মুখে) শুনতে হবে মনে রাখবেন।
ReplyDeleteহাহাহা কৌশিক, খুব ভালো কথা মনে করিয়েছেন, নিশ্চয় মনে রাখব। আর মায়ের এইসব ব্লগ-ফাজলামিতে রুচি নেই, সেই ভরসাতেই তো লিখি।
DeleteKi maja! Khub ananda kore eso. Ei eki ananda amar jeeboneo mash tinek bade aste cholechhe Atoeb vico termuric samorke sabdhane thakbo. Khub haslam!
ReplyDeleteআরে তোমারও বোনের বিয়ে রুচিরা! দারুণ ব্যাপার তো। হ্যাঁ ভিকো অতি ভয়ংকর বস্তু। সাবধানে থাকাই উচিত।
DeleteKUNTALA DI TOMAR LEKHA PORE AMIO VICO MAKHA SURU KORECHI....BESH AKTA INSTANT FORSA VAB ASE AR TUMI BOLECHILE NA J TOMAR BRONO GULO MILIYE GACHE,AMAR O KAJ DICHCHE.APATOTO CHOTO TUBE TA CHOLCHE,KHUB SIGGIR BOROTA KINBO.TOMAR VICOR PHOTA R JAIGA TA PORE KHUB HESECHI.
ReplyDeleteআরিব্বাস্, তুমিও ভিকো মেখে উপকার পেয়েছ কুহেলি? গুড গুড।
Deleteবোনের বিয়েতে খুব আনন্দ করুন কুন্তলা। ফিরে গল্প শোনাবেন, আর ছবি দেখাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব।
ReplyDeleteএই মেরেছে, ক্যামেরা তো বাড়িতে রেখে যাচ্ছি। যদি ফাউ কিছু ছবি বাগাতে পারি, তবে নিশ্চয় দেখাব।
Deletepore khub maja pelam!!biebarir galpo sonar janyo mukhie achi :-)
ReplyDeleteবিয়েবাড়ি থেকে খানিকটা সময় চুরি করেছি। গল্পের সন্ধানে আছি, দেখলেই ধরব।
DeleteEnjoy korun...ta kothay chollen? Kolkata? dekhben...Salman Rushdi-r moto ekhane dhukte na dile kintu hoye gelo...se o lekhe apnio lekhen... :P
ReplyDeleteহ্যাঁ, আর মিলটা ওইখানেই শেষ। কাজেই চিন্তা নেই সৌমেশ। আমি এলাম না গেলাম, কলকাতা ফিরেও তাকাবে না।
Deletemona-r por tomar naam "khona" hotei parto. aar taholey ei blog-ta holo "khonar bochon". ghyam hoto na?
ReplyDeleteদেখেছ! এটা আমার মাথাতেই আসেনি। কী বাঁচা বেঁচেছি বল দেখি সোমনাথ?
Deleteurribaas...daroon byapar! abantor er malkin biye bari jachhen mane tow phire eshe abantor e horir loot hobe!!!
ReplyDeletekhub moja kore esho. aamra goppo shonar apeekay roilam :)
আমিও গল্প বলার জন্য মুখিয়ে আছি শম্পা। শিগগিরই দেখা হবে।
DeleteCamera nile na ? Kottdin biyebarir bhoj er chobi dekhini :( Bon er jonyo roilo onek shubhechcha
ReplyDeleteইস, সরি সরি বং মম। বোনকে আপনার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেব নিশ্চয়।
Deleteতুই একটা বই লিখবি, ভাই? আমি দায়িত্ব নিয়ে ছাপানর হ্যাপা সামলাবো। আর ভিকোর মতো জিনিস হয় না, অনেক ঘাটের অনেক ক্রিম মেখে সার সত্য বুঝেছি। বিয়েবাড়ির নানা গল্প শুনবো শীগগির :)
ReplyDeleteসে আর লিখতে কী। কিন্তু তারপর সেই বই হাতে নিয়ে "কিনুন কিনুন, কেন্ রে কেন্ রে" করে তোমাদের পেছন পেছন তাড়া করে বেড়াবো সেটা কী ভালো হবে?
Deleteবাঃ ভিকোর এত ফ্যান দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। গুড গুড।
araisho copy to ami nijei kinbo. amar ekta adda group ache tader shob member der gift debo. plus barir lokjjon. Likhe phel, lokhhiti.
Deleteসর্বনাশ করেছে। এর পর তো আর না লিখে থাকা যায় না। দাঁড়াও দেখছি।
DeleteDurdanta......mukher Vicco meshate bhule gecho Kintu lekhatay Je rate humor mishiyecho.....just lajawab....shei khubsoorat cinemay Rekhar style e bolte icche korche" nirmal anand" er jonno thank youuuu.
ReplyDeleteআর তোমাকে অবান্তর পড়ার জন্য আর ভালো লাগা কষ্ট করে কমেন্টে এসে লিখে যাওয়ার জন্য অনেক অনেক থ্যাংক ইউ রণিতা।
Deletekhuub khuub enjoy koro kuntaladi...boner jonyo roilo onek onek suvecha r ovinandon..tobe agami koyekdin abantor chara vabata ektu kostokor..ok no problem chaliye nebo...onek chobi r golper ashay bose roilam.
ReplyDeleteতবেই ভাবো রাখী, আমার কত কষ্ট হচ্ছে? ছবি তো হবে না বোধহয়, কিন্তু গল্পের অভাব হবে না বলেই ধরে নিচ্ছি।
Deletenijeke niye koutuk kora ekta bejay shokto gun.Apni egiyei achhen.
ReplyDeleteঅন্যে আমাকে নিয়ে কৌতুক করার থেকে আগেভাগে নিজেই নিজেকে নিয়ে কৌতুক করে রাখা বেটার কি না বলুন?
Delete