ত্রিফলা
দুপুরবেলা টুনার আইবুড়োভাতের নেমন্তন্ন খেতে বসে সবে লালশাকভাজা দিয়ে চাট্টি ভাত মুখে তুলেছি, অমনি পাশ থেকে কেউ জিজ্ঞাসা করল,
“তোমার পাওয়ার কত?”
তাকিয়ে দেখি একটি বছর দশেকের মেয়ে, মোটা মোটা
চশমার কাঁচের ওপার থেকে গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বুঝলাম আমার দলের লোক।
আমার চোখের পাওয়ার বললাম। শুনি এই বয়সেই সে
মেয়ের চোখের পাওয়ার আমার থেকে বেশি। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে “ওহ্” বলে চুপ করে থাকাতে
সে আবার প্রশ্ন করল,
“তুমি ল্যাসিক করাবে না?”
এইটুকু মেয়ের জেনারেল নলেজ দেখে অভিভূত হয়ে আমি ঘাড়
নেড়ে না বললাম।
এইবার সে মেয়ের মুখের বাঁধ খুলে গেল। ও নাকি
আঠেরো বছর বয়স হলেই ল্যাসিক করাবে। সব ঠিক
হয়ে আছে। আমি বললাম, “সে তোমার চোখের পাওয়ার এত বেশি, করলেই ভালো তো। আমার
এই চশমাতেই বেশ চলে যাচ্ছে। কিচ্ছু অসুবিধা হচ্ছে না।”
শুনে সে বিশেষ খুশি হল না। তারপর সেই শাক থেকে
শুরু করে পায়েস পর্যন্ত সে প্রাণপণে আমার কানের কাছে ল্যাসিকের মহিমাবর্ণন করে গেল
যাতে আমার চক্ষুরুন্মীলন ঘটে এবং আমি সত্বর ল্যাসিকের দ্বারস্থ হই।
এ মেয়ের চল্লিশ বছর বয়স হলে কী হবে, ভেবে আমার
এখনই হৃৎকম্প হচ্ছে।
বিয়েবাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি আর যেটা
বিনামূল্যে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে উপদেশ। আমার কী কী করা উচিত আর কী
কী করা উচিত নয়, সে নিয়ে সকলেরই বক্তব্যের সীমা নেই। এমনকি আমাকে যারা চেনেনই না
তাঁদেরও।
এই যেমন ধরুন আমার গালে ব্রণর দাগের ব্যাপারটা।
আমার নিজের সত্যি বলছি কিচ্ছু অসুবিধে হচ্ছে না। গালভর্তি এই দাগ নিয়েই পড়াশুনো,
চাকরিবাকরি, এমনকি একাধিক প্রেম পর্যন্ত আমি নামিয়ে ফেলেছি, কিন্তু সেটা কে কাকে
বোঝাবে। সকলের দাবি অবিলম্বে এই দাগগুলোর বিষয়ে আমার কিছু করা উচিত।
“আজকাল এত কিছু বেরিয়েছে, আমাদের পাড়ার ওই
মেয়েটার গালেও তো কী বিচ্ছিরি দাগ ছিল, মনে নেই? ম্যাগো...কিন্তু ও-ও তো ডাক্তার
দেখিয়ে অপারেশন করিয়ে মুখ কীরকম চকচকে করে ফেলেছে। আতসকাঁচ নিয়ে খুঁজলেও একটা দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে
না।”
আগে থেকে ঠিকই করে রেখেছিলাম যে সব কথা শুনে আমি
ভীষণ ইমপ্রেসড হওয়ার ভঙ্গি করব আর ডাক্তারের ঠিকানাটাও জানতে চাইব। কিন্তু একটা
কথা মগজে এমন আটকে গেল যে সব প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে গেল।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “অপারেশন! কীসের
অপারেশন!?”
হিতৈষী ভদ্রমহিলা আরাম করে একখানা সাজা পান
গালের ভেতরদিকে ঠুসে দিয়ে বললেন, “অতসব ডাক্তারি শব্দ জানি না বাবা, মেয়েটাকে
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বলল সোজা কথায় বললে নাকি মুখের চামড়ার ওপরের স্তরটা দাগটাগশুদ্ধু
চেঁছে তুলে দিয়েছে।”
বলে তিনি গণ্ডারের মতো একটা হাই তুলে ওপাশ ফিরে
নাক ডাকতে লাগলেন। আমি সিলিঙের দিকে তাকিয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলাম। গলা শুকিয়ে মাথা
ভোঁভোঁ করতে লাগল।
মা শুনে চোখ গোলগোল করে বললেন, “তবে? এত যে বলি শরীরের
যত্ন কর, কাঁচাহলুদ খাও, তেল মেখে স্নান কর, রোজ সকালে হালকা পি.টি. কর, গ্যালন
গ্যালন জল খাও---কিছু তো কানে নাও না। দেখছ তো ডাক্তারের হাতে পড়লে কী অবস্থা হবে।
চামড়া ছাড়িয়ে নেবে একেবারে।
কাজেই আমি ঠিক করেছি ভেষজ পদ্ধতিতে শরীরের যত্ন
নেব। সবাই বাড়ি থেকে নলেনগুড়ের জলভরা আনে, আমি প্যাকেট ভরে ভরে কাঁচাহলুদ এনেছি।
রিষড়ার বাড়িতে পিঠেপায়েস বানানোর পরও একটু পাটালিগুড় পড়েছিল, মা সেটাও দিয়ে
দিয়েছেন। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে গুড়হলুদ চিবিয়ে খাচ্ছি। কাঁচাহলুদ যখন ব্যাগে পোরা হচ্ছিল তখন মীরামাসি
দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন।
“মুখের জন্য নেওয়া হচ্ছে বুঝি?”
তারপর আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, “যাই
কর না কেন, পেট পরিষ্কার না থাকলে কিস্যু হবে না, আর পেট পরিষ্কার করতে হলে
ত্রিফলা ছাড়া গতি নেই।”
মায়ের হাত থেমে গেল।
“ত্রিফলা কোথায় পাব?”
“আরে বৌদি, আজকাল আবার পাওয়ার অসুবিধে? ডাবরের
ত্রিফলাচূর্ণ শিশি করে দোকানেদোকানে বিক্কিরি হচ্ছে দেখেননি? দাদাকে পাঠিয়ে দিন
না, গোপালের দোকানে পেয়ে যাবে।”
আমাকে হস্তক্ষেপের কোনও সুযোগ না দিয়ে মা বাবাকে
ফোন লাগালেন। বাবা তার একটু আগেই বাজারে বেরিয়েছেন।
“শুনছ, তুমি কি গোপালের দোকান ছাড়িয়ে চলে গেছ?
যাওনি! কী ভাগ্যিস। শোনো না, আসবার সময় একশিশি ত্রিফলা নিয়ে এস তো। সোনাকে দিয়ে
দেব।”
নিতান্ত দরকার না পড়লে আমার বাবা প্রশ্ন করায়
বিশ্বাসী নন। কাজেই তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে গোপালের দোকান থেকে একের বদলে দু’শিশি
ত্রিফলা কিনে বাড়ি ফিরলেন। কাঁচাহলুদের প্যাকেটের তলায় সে দুটো শিশি আরামসে ঢুকে
গেল।
“সকালে উঠে খালিপেটে জলে গুলে খেয়ে নিয়ো সোনা।
লক্ষ্মী মেয়ে।”
“সকালে কাঁচাহলুদ খাওয়ার কথা হল যে?” আমি অনেক
চেষ্টাতেও গলা থেকে বিরক্তির আভাস সরিয়ে রাখতে পারি না।
“কেন ত্রিফলাটা খাওয়ার পর খাবি? কিংবা ত্রিফলার
আগে?” মা নিমেষে সমস্যার সমাধান করে দেন।
বাড়ি থেকে ফিরে আসা ইস্তক চলছে। কাঁচাহলুদ তবু চলে
যায়, ত্রিফলাচূর্ণ আপনারা কেউ খেয়েছেন কি? এত খারাপ খেতে জিনিস আমি কেন আমার বাবাও
খাননি। প্রথম দিকে তো নিঃশ্বাস বন্ধ করে গ্লাসের জল ঢকঢক করে গলার ভেতর উপুড় করে
আক্ষরিক অর্থেই মুখ চেপে বসে থাকতাম, পাছে সবকিছু ফোয়ারার মতো আবার ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসে। ইদানীং দেখছি একটু সয়ে গেছে।
একবার ভেবেছিলাম হলুদের প্যাকেট আর ত্রিফলার
শিশি দুটোকেই ট্র্যাশের সঙ্গে বার করে দিই, কিন্তু ওই কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে
সঙ্গেই ডাক্তারের টেনে মুখের চামড়া তুলে ফেলার দৃশ্যটাও মাথায় এসেছে, আর আমি
ত্রিফলার শিশিটাকে জাপটে ধরেছি।
কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেল।
আজ সকালে উঠে এক গ্লাস জল দিয়ে গুড় আর
কাঁচাহলুদ, আরেক গ্লাস জল দিয়ে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ (মা পইপই করে বলে দিয়েছেন,
আয়ুর্বেদের অছিলায় অ্যালোপ্যাথি যেন বাদ না পড়ে), আরেক গ্লাস জল দিয়ে ত্রিফলাচূর্ণ
খাওয়ার পর আমার পেট এমন ভরে গেল যে আমি আমার সকালের চা-টা পুরোটা শেষই করতে পারলাম
না।
আমার এত সাধের, প্রাণপ্রিয় চা! কামড় বসানো
ক্রিমক্র্যাকার প্লেটের পাশে অনাদরে পড়ে রইল, অতি যত্নে বানানো টাটা গোল্ড আমার
অপেক্ষায় থেকে থেকে অবশেষে জুড়িয়ে গেল, শেষে আমি গিয়ে তাকে সিংকে বিসর্জন দিয়ে
এলাম।
মা শুনে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “দিয়েছে দিয়েছে,
ত্রিফলাচূর্ণ আর কাঁচাহলুদ কাজে দিয়েছে। চা ছাড়িয়েছে, এবার দেখবি সোনা, ব্রণর দাগ
ছাড়াবে, অম্বল সারাবে, অনিদ্রা সারাবে, ফাঁকিবাজি সারাবে, বাচালতা, ইনডিসিপ্লিন...”
মা আর থামতেই চান না। সবকিছু সেরে গিয়ে তাঁর
সোনা কী রকম সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠবে সেই ভেবে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ফোনের ওপার
থেকেই প্রায় হাতেপায়ে ধরতে থাকেন যেন আমি ফস্ করে ত্রিফলাকে ছেড়ে না দিই।
মা’কে দেওয়া অনেক কথাই রাখিনি, আর তার দামও
চুকিয়েছি দেদার। তাই এই কথাটা রাখব ভাবছি। ত্রিফলাচূর্ণ থাকুক, তবে তাকে চা ছাড়াতে
অ্যালাউ করছি না। বাড়িতে চা খেতে পারিনি তো কী হয়েছে, অফিসে এসেই চিকুকে ঘণ্টায় ঘণ্টায়
মনে করে চা পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। যদিও সে কথাটা আর মা’কে বলছি না।
ত্রিফলার সাথে মা-মাটি-মানুষের সম্পর্ক বরাবরই জোরালো। দিদি বলেছেন।
ReplyDeleteসত্যি নাকি?
Deleteha ha ha ha... eta darun comment kintu...
Deleteহে হে! এটা এ মাসের সেরা কমেন্ট। :)
DeleteTriphala prankibaji, bachalata saray? Anandabazarer mohimay amar to shudhu dharona chhilo purosabhar taka soray! Lekhata besh! Amio Baree theke holud rosun ityadi khaoar suggestion peye thaki. Ar bondhuder theke LASIK. Amader ek professor-er bhashay sab-i this kan enter that kan bullet-er mato out kore di!
ReplyDeleteও হরি, তোমরা সবাই সেই আলোর কথা বলছ, আমি তাই ভাবছি হঠাৎ সবাই দিদি দিদি করছে কেন। তোমার প্রফেসরকে দূর থেকেই একটা হাই ফাইভ দিলাম রুচিরা।
Deleteআমিও হেডিংটা পড়ে দিদির ত্রিফলার কথাই ভেবেছিলাম। যাক, এবার পোয়ারোর মত চা ছেড়ে tisane ধরেছেন, আর বয়েসের ছাপ পড়বেনা। দেখবেন little grey cells রাও ক্রমশ ধারালো হয়ে উঠবে।
ReplyDeleteবলছেন? তাহলে কী ভালোই না হবে।
DeleteTrifola khuje na pele kolkatar foothpath theke ek/du khan upre nia chole jaben...amader tax er takay onek trifola kolkaty pota ache..tate obosso didi apnar galer bodole 'chabkia' pither chamra tule nile ami kichu jani na.. :-D
ReplyDeleter 'চক্ষুরুন্মীলন' mane ki! :P
চক্ষুঃ + উন্মীলন। বিসর্গসন্ধি।
DeleteSathe sample চক্ষুঃ.. ekdom hate gorom bojano... :D
Deleteসৌমেশ, উত্তর পেয়ে গেছেন দেখছি।
Deleteআমার ত্রিফলা কালমেঘ চিরেতা ইত্যাদি বেশ সুস্বাদু লাগে। দিব্যি খেতে। আমি আবার কাঁচা নিমপাতা চিবিয়ে খাই (মাইরি বলছি)।
ReplyDeleteআমিও তেতো ভালোবাসি তবে কাঁচার বদলে নিমপাতাটাকে একটু বেশি তেলে বেগুনের সঙ্গে ভেজে দিলে খুশি হই।
Deletetor ashim khamota....ত্রিফলা ar কাঁচাহলুদ aksonge ....babare....!sunei bhoy korche
ReplyDeleteআরে কাজ দিচ্ছে রে। তুইও খা বলছি।
DeleteOrey baba Lasik ekkebare korio na. Jader choshmar power kom, tara jodio ba korate pare, jader beshi (ar tar sange astigmatism ache) tara jeno kokhono na koray. Amar bangali doctor (je amake 6 yrs theke, mane amar first choshma hoya theke dekhche) ar amar chiney -dadu doctor dujonei poi-poi kore baron koreche. Amaro to choshma porei dibbi cholche ei 22 years.. oshubidhe ki?
ReplyDeleteRecently "Whole living" magazine e porlam kacha holud, honey ar bodhoy lebur rosh mishiye gorm jol khele naki matha theke pa obdi nanan rog shaare :) Tumi dekhi oi line ei jachho...
এই পোস্টটায় যে কতগুলো হাই ফাইভ দিতে হবে তোমার সঙ্গে রিয়া। আমারও ছ'বছর বয়সে চশমা হয়, আমাকেও একজন বুড়ো দাদু ডাক্তার দেখেছিলেন। তিনিও কনট্যাক্ট লেন্সের কথা শুনেই চুপ করে হাসতেন, কাজেই ল্যাসিক শুনলে যে মোটেই রাজি হতেন না সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
DeleteAmio 5 bachhor theke chashma nie ghurchhi. Majhe majhe lens dhokai bote kintu chashmar aram tai alada!
Deleteহ্যাঁ ভাই, যখন খুশি খোলো, যখন খুশি পরো, পরে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোও---চশমার জবাব নেই।
Deletechosma porar ektai subidhe, aram kore chokh chulkono jai, jeta lens e jai na..:)
Deleteইয়েস, এটাও সত্যি।
Deleteeksange kancha halud, triphala aar chaa banao, shob mishiye ek bare dhok dhok kore kheye felo :)
ReplyDeleteএইটা একেবারে জিনিনিয়াসের মতো বুদ্ধি দিয়েছ শম্পা। টু গুড। করে দেখব নিশ্চয়।
DeleteAR VICO SETAO ACHE TO?
ReplyDeleteহ্যাঁ, সেটা কি না থাকলে চলে বল কুহেলি? অফিস লেট হয়ে গেলেও আমি ভিকো না মেখে বাড়ি থেকে বেরোই না।
Deletevicco ta external application aar kancha halud internal...ebar tomar gaal hema malini (with puru make up) er moto na hoye jabe na!!!
Deleteaami aboshho kancha halud gale lagiye ekta phal peyechilam. charpashe sabai chintito hoye porechilo je amar jaundice holo kina! ek markini colleague to ritimoto blood test korbar upodesh dilo :)
হাহাহাহা শম্পা, আমার এখনও সে রকম কিছু হচ্ছে না। তবে সবে শুরু করেছি তো, আর ক'সপ্তাহ যাক, দেখা যাক কী হয়। আর হেমা মালিনীকে আমার একটুও সুবিধার লাগে না, কাজেই সে রকম হয়ে গেলে খুব স্যাড ব্যাপার হবে।
Deleteami trifala,kacha holud shob khete shuru korbo jodi ekadhik" premer golper " modhye koyekta shonao....darun golper gondhe puro trifala hojom hoye jabe....
ReplyDeleteHaan..onek bia bari/park/trifola/heddahua holo...ebar public demand e premer golpo hok...:P
Deleteসর্বনাশ করেছে। আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।
Delete