জিনের খেলা
জিনের খেলা, যতবারই দেখি
না কেন, নতুন করে চমকে যাই। ওই লিকপিকে ডি এন এ-র প্যাঁচেপ্যাঁচে যে অতখানি শয়তানি
আঁটা থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
কিন্তু আজ সকালে অফিসের
গেটের মুখে এসে যখন ট্যাক্সিটা ঘ্যাঁচ করে থামল, আর আমি ব্যাগের ভেতর এদিকওদিক
হাতড়ে বুঝলাম যে মানিব্যাগটা চুপটি করে বাড়িতে টেবিলের ওপরেই শুয়ে আছে, আমি তাড়াহুড়ো
করে ওকে ফেলে রেখে বেরিয়ে যাচ্ছি দেখেও স্রেফ শত্রুতা করেই আমার পিছু ডাকেনি, তখন
বিশ্বাস করতেই হল।
বিশ্বাস করতে হল যে সময়
তিরিশ বছর এগোলেও, রিকশার জায়গায় ট্যাক্সি, রিষড়ার জায়গায় দিল্লি এমনকি শাড়ির
জায়গায় স্কিনি জিন্স এসে ঘাড়ে চাপলেও---আমি হুবহু আমার মায়ের মেয়ে রয়ে গেছি।
আমার মা, নিয়মিত পার্স
ভুলে বাড়ি থেকে বেরোতেন, তারপর স্টেশনের পাশে কেষ্টদা’র দোকান থেকে বাসভাড়া ধার
নিয়ে অফিস যেতেন। অফিস থেকে ফেরার সময় আবার যোগমায়ামাসির থেকে ফিরতি বাসভাড়া ধার
নিতে হত।
আমি তো মরমে ট্যাক্সির
সিটের সঙ্গে মিশে গেলাম। ট্যাক্সিওয়ালা একে ভীষণ ভদ্র, তার ওপর মুখচেনা। তিনি আমার
থেকেও বেশি লজ্জা পেয়ে বললেন, “আরে কোই বাত নেহি ম্যাডাম, শামকো লে লেঙ্গে।”
কেষ্টদাও মা’কে ঠিক এভাবেই
বলতেন। কাঠের ড্রয়ার টেনে টাকা বার করে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বলতেন, “তাড়াতাড়ি
যান গিয়া, তারকেশ্বর অ্যানাউন্স কইর্যা দিসে।”
আশ্চর্য কি না বলুন?
যত বুড়ো হচ্ছি, আশ্চর্য
হওয়ার পরিমাণও তত বাড়ছে। এই সেদিন বান্টির সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে একটা চরম
পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট মন্তব্য করে ফেলেই থতমত খেয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। বান্টি
ভীষণ খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “ছি ছি কুন্তলাদি, এত করে শেষে কি না এই? অ্যাঁ?”
আমি বান্টির কথায় যত না লজ্জা পেলাম, অবাক হলাম তার থেকে একশোগুণ বেশি। মনে পড়ে
গেল, আজ থেকে বছর পনেরো আগে যখন আমার রক্তে আইডিয়ালিজমের ঢেউ খেলত, তখন ঠিক এই
গোত্রের একটা আলটপকা মন্তব্য করার জন্য আমি আমার বাবার সঙ্গে তিনদিন কথা বলিনি।
বাবামায়ের আরও কত ছায়া যে
নিজের মধ্যে দেখতে পাই আজকাল। সত্যজিৎ রায় বা মাদাম কুরির সন্তান হয়ে না জন্মালে
তো কারওরই নিজের পিতামাতা রোল মডেল হয় না, আমারও হয়নি। বরং ওই ছাঁচটা থেকে বেরোনোর
একটা সক্রিয় চেষ্টা সবসময় ছিল। আমার বাবামা কিন্তু নিজেদের নিয়ে মোটেই দুঃখী ছিলেন
না। তাঁরা খোশমেজাজে লোকাল ট্রেনেবাসে ধাক্কাধাক্কি করে অফিস যেতেন, অফিস থেকে এসে
দূরদর্শনে নিউজ শুনতেন, শনিরবিবার আমাকে ট্যাঁকে গুঁজে সোদপুর কিংবা বেলঘরিয়ায়
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে লৌকিকতা সারতে যেতেন।
কিন্তু আমি ওই জীবনটাকে
দেখে মনে মনে নাক কোঁচকাতাম। নিজের কাছে শপথ নিতাম, ওঁরা দশটা-পাঁচটা টেবিলে বসে কলম
পিষছেন, আমি মরে গেলেও পিষব না। আমি হাতির পিঠে চেপে রেনফরেস্টে ঘুরব। ওঁরা রুটি বাঁধাকপি
খেতে খেতে খবর শোনেন, আমাকে নিয়ে খবর তৈরি হবে। ওঁরা বোরিং, নন-ইন্টেলেকচুয়াল
স্বজনবন্ধুর সঙ্গে সপ্তাহের পর সপ্তাহ নিম্নচাপ আর মুদ্রাস্ফীতির লেবু কচলে
চলেছেন, আমার আশেপাশে কেবল সেসব লোকই থাকবে যারা পোস্টমডার্নিজমটা জাস্ট বোঝে।
এখন পোস্টমডার্ন
লোকজনের নাম শুনলেই আমার হৃৎকম্প হয়। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারা তো দূরের কথা।
পার্স ভুলে যাওয়ার ঘটনাটা
ঘটার পর মা’কে ফোন করে এই কথাগুলো বলছিলাম। ভয়ভয় করছিল, শুনে হয়তো মায়ের মনখারাপ
হবে, ওঁর মধ্যবিত্ত ছাপোষা জীবনটাকে আমি একসময় হেলাছেদ্দা করতাম জেনে হয়তো আঘাত
পাবেন।
মা সেসবের ধার দিয়ে গেলেন
না। প্রথমেই মানিব্যাগ ফেলে অফিস চলে যাওয়ার জন্য একচোট বকলেন। বললেন, “ধীরস্থির
হও সোনা। না হলে কিছুই হবে না।”
আমি বললাম, “সে না হয় হব।
কিন্তু বিশ্বাস কর মা, আমি এখন তোমাদের জীবনটাকে আর একটুও করুণা করি না। কারণ
ছোটখাট ডিটেল্স্ বাদ দিলে, আমার জীবনটাও ধীরেধীরে অবিকল তোমাদের মতোই হয়ে
যাচ্ছে। আর তাতে আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং একটা অদ্ভুত স্বস্তি পাচ্ছি।”
মা হেসেই উড়িয়ে দিলেন।
বললেন, এটাই নাকি জগতের নিয়ম। ষোল বছর বয়সে প্রথমবার ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ পড়ে নাকি
মায়েরও দিদিমার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। দিদিমা যে কলেজে পড়েননি, তাঁর মাথায় যে
নারীবাদের এমন কঠিন কথা কস্মিনকালেও ঢুকবে না। দিদিমার যে বেঁচে থাকা ষোলআনাই
ফাঁকি।
শুনে আমার একটু শান্তি
হল। মা-ও দিদিমাকে মানুষ মনে করতেন না, আমিও আমার মা’কে করি না। অথচ আমাদের
জীবনগুলো কি অদ্ভুতভাবে হাঁসের ছানার মতো একে অপরের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে লাইন
বেঁধে দুলে দুলে এগিয়ে চলেছে।
ভেবে হঠাৎ আমার খুব মজা
লাগল, আর একটুও অপরাধবোধ রইল না।
উৎস গুগল ইমেজেস
khub bhalo legeche lekhata. katha gulo amar kjhetreo sotyi. amar majhe-majhei khub aporadh bodh hoy j maa ke thikmoto appreciate korlam na konodin, othocho tar por din e keno skype e ekhono char initiate korte pare na, sei niye jhogra kori.
ReplyDelete* chat
ReplyDeleteমায়েরা সব এক গোয়ালের গরু টিনা। আমার মা সারাজীবন হাইড্রোজেন কে হাইড্রোZন বলে গেলেন, শুধরোলেন না যে শুধরোলেনই না। ভগবানই জানে কেন।
Deleteপরিতোষ বাবু আজ সকালে মারা গেলেন। শ্মশান থেকে ফিরে দুই ছেলে শান্তই ছিল। সন্ধ্যের দিকে বড়ো ছেলে খুকখুক করে কেশে বললো, “বাবার উইলটা এবার দেখলে হয় না? আমার আবার পরশু বস্টন যাওয়ার টিকিট কাটা আছে।”
ReplyDeleteছোটো ছেলে অতোটা ব্রিলিয়ান্ট নয়। মাঝারি সওদাগরী অফিসে কম মাইনের চাকরি। সে বললে, “দাদা, মৎস্যমুখের পরে যাস। মা খুশী হবে।”
পরদিন উকিল বাবু এসেছেন। উইল খোলা হল। কলকাতায় ২টি বাড়ি মৃতের স্ত্রী পেয়েছেন। ৩ টি ফিক্সড ডিপোজিটের ২টি ছোটো ছেলে, ১ টি ছোটো নাতনীর নামে।
বড়োজন কিঞ্চিৎ অধৈর্য। “উকিল বাবু, আমি?”
উকিল বাবু চশমাটা ভালো করে এঁটে উইলের শেষ বাক্যটি পড়লেন, “বড়ো সন্তানকে বহুপূর্বেই সফল জিনগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে।”
saadhu saadhu
Deleteবাঃ, গল্পটা কার, তোমার নাকি?
Deletebah eta besh :)
Deletedarun golpo ta!!! Eta kintu ami manush jon ke bolbo :)
Deleteহ্যাঁ, হপ্তাখানেক আগে লিখেছি।
DeleteEi jonyei ki bola hoi "by the time a man realizes that his father was right, he has a son who thinks he is wrong".
ReplyDeletehawk kotha!
Deleteএই প্রবাদটা জানতাম না তো! কী সত্যি কথা!
Deletesubarnalata y jekhantay satyabatir chithi pore subarna prothom maa k bujhte pare sei ongshota mone pore gelo.. sudor likhecho..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ স্বাগতা। আমার প্রিয় দুটো বইয়ের কথা মনে পড়িয়ে দিলে।
DeleteHmm... chinta bhabna korchilam eta pore je amar life ta er modhye kothay match korche. Bhebe bhebe dekhlam, amar baba-ma'r life er sange apato drishti te kichu mil to thakbei - biye tha kore songsar korchi, office kachhari jachhi, segulo to songsari sobai kore. Tate dekhe hasharo kichu nei, abar "ki honu re" bhabaro kichu nei. Tobe aro je byapar tay mil ashe seta khanikta holo gene, definitely ar baki ta holo bringing up. Baba-ma i to manush koreche, tai generally tader jegulo amar modhye pora ichhe chilo seguloi pureche.
ReplyDeleteAmi jokhon anti-commmunist boktrita jhari seta kotota Baba'r theke paoya gene e ar kotota 23 years er shikkhay seta bhabte hoy. Similarly, ma-er ar amar boi ar cinema'r byapare onek common likings ache. Ami teenage boyesh e kichu byapar niye khub jhamela kortam barite, kintu amar baba-mao jodio "modhyobitto bangali" bolte ja bojhay thik tai amar mone hoy na ami kokhonoi tader "issh ora ki ar janlo" mone korechi. Tar khub boro karon holo amar modhye jemon ora ja chaye tai ache, oder modhyeo kintu ami baba-ma der modhye ja dekhte chai taii ache. Ar sob theke boro byapar holo amar ja kichu porashuno, gyan ar moral values esheche, sobii oder theke. Sadhe ki ar ora ekhon amay dekhe dekhe khushi hoy??
এই তো তুমি তোমার বাবামায়ের জীবন নিয়ে তৃপ্ত ছিলে। এটা খুব বড় জিনিস রিয়া।
DeleteThe apple does not fall far from the tree!!!
ReplyDeleteসেটাই। দীর্ঘশ্বাস।
DeleteDaruun...tomar ma er kotha pore mone hoy thik jeno nijer ma er kotha porchi.....shotti amio ekshomoy bhabtam ki boring eder jibon... Shudhu office ,Bari, ranna khawoa... Kintu joto buro hocchi...kothai jeno onader jotilota beheen jibon take khub hingshe hoy....amader Internet ache, Skype ache, YouTube ache , iphone ache, ipad ache,deshbideshe bhromon ache...Kintu kothai jeno " contentment" nei....khub olpe shobai ke niye Khushi thakar montro ta kothai jeno hariye felechi amra.
ReplyDeleteকী জানি রণিতা, আমি আজকাল ভাবি, এতই যখন মিল, তখন হয়তো আমাদের বাবামায়েরাও অতৃপ্তিতে ভুগতেন। আমরা সেটা বুঝতে পারিনি কখনও। হয়তো না-পাওয়া স্বপ্ন তাঁদেরও ছিল। পাওয়াগুলো দিয়ে সেগুলো চাপা দিয়ে রাখতেন।
Deleteতবে এসব ভেবে মাথা ভারি করার কোনও মানে হয় না, এ কথা সত্যি।
Arey durr!!! Eto keno bhabo? Manush matrei to kichu paoya ar kichu na paoya thakbe. Sob pele ki bhalo na ki? Keu ta paye? Ar khushi thaka na thaka ekkebare nijer byapar. Khao-dao, ghumao, berao, golpo koro ar baje boke hee hee kore hasho dekhbe ar kono chap nei :D
Deleteএবার তো ডবল পাওনা - চরম দুটো লেখার জন্যে কুন্তলা আর অনির্বাণ দুনোকেই আন্তরিক ______ (যা যা জানানো সম্ভব বসিয়ে নিয়ো) জানাই।
ReplyDeleteখাসা লেখা দুটো। একদম মাপমতো কেটে আমাদের জন্যে প্লেটে সাজিয়ে পরিবেশন আর কি! ধন্যবাদ।
থ্যাংক ইউ কৌশিক।
Deletechabita anabadyo :-)
ReplyDeleteগুড।
Delete