আমাদের পার্ক
দিল্লি শহরের একটা অন্যতম ভালো জিনিস হচ্ছে
পার্ক। পাড়ায়পাড়ায়, ডি ডি এ ফ্ল্যাট ক্যাম্পাসের আনাচেকানাচে, অলিতেগলিতে পার্ক।
কলকাতার পার্কের সঙ্গে দিল্লির পার্কের মুখ্য তফাত হচ্ছে এই পার্কগুলোতে
প্রেমিকপ্রেমিকা ছাড়াও নানা বয়সের নানা আকৃতির লোক নিয়মিত আসাযাওয়া করে। বুড়োরা
আড্ডা মারে, মাঝারিরা দৌড়োয়, বাচ্চারা খেলে।
আমিও যাই আমার বাড়ির সামনের পার্কটাতে। ভোরবেলা
যেতেই ভালোলাগে সবথেকে বেশি, যেদিন ভোরে যাওয়া হয় না, সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে
একবার ঢুঁ মেরে যাই।
কতরকম যে গাছ আছে আমাদের পার্কটাতে। মাটির সঙ্গে
কথা বলা ফুলের চারা থেকে ডালপালা মেলা বিশাল বটবৃক্ষ। প্রতিটি গাছের গায়ে সাঁটা
প্লেটে স্পষ্ট করে ল্যাটিন, বাংলা, হিন্দিতে নাম লেখা। বেশ শিক্ষামূলক। ওই প্লেট
পড়েই আমি এই সেদিন জানতে পারলাম যে বাংলায় যেটা কৃষ্ণচূড়া হিন্দিতে সেটাই গুলমোহর।
রোজ দেখে দেখে পার্কের গাছগুলোর ক্রম মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। গেট দিয়ে ঢুকেই
ডানদিকে বটগাছ। বটের পাশে গুলমোহর, গুলমোহরের পাশে একটা ইয়াব্বড় ছাতিম। ওপারের
পাঁচিল ঘেঁষে সারি দেওয়া কয়েকখানা অমলতাসও আছে। অমলতাস আমি প্রথম দেখি জে এন ইউ-তে
এসে। সোনালি ফুলে ছাওয়া গাছগুলো দেখি, আর তক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিই যে যদি কোনওদিনও
নিজের বাড়ি হয় আমার তাহলে বাড়ির নাম রাখব অমলতাস।
গাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আছে পাখি। শহরের আকাশ
আর ইলেকট্রিক তারের দোলনা থেকে পাখি উধাও হয়ে গেছে কবেই। যে ক’টা শালিখচড়ুই
বেঁচেবর্তে আছে তারা সব এই পার্কগুলোয় এসে বাসা বেঁধেছে। আমাদের পার্কটাতে
কাকচড়াইের পাশাপাশি আমি দোয়েল ইত্যাদি মহার্ঘ পাখিও দেখেছি।
কিন্তু পৃথিবীর সব পার্কের মতোই আমাদের পার্কেরও
মুখ্য আকর্ষণ গাছপাখি নয়, মানুষ। কতরকমের যে মানুষ আসে পার্কটায়। আমি ফাঁক পেলেই
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানোর ভান করে তাঁদের দেখি।
সকালে আসেন স্বাস্থ্যোদ্ধারকারীর দল। পালে পালে।
এই স্বাস্থ্যোদ্ধারকারীদের নিয়ে তারাপদ রায়ের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ
আছে। তিনি লিখেছেন যে লেকের মাঠে গত তিরিশ বছর ধরে কলকাতার বিখ্যাত মোটারা হনহনিয়ে
হেঁটে আসছেন, এবং এই তিরিশ বছরে কেউ এক ইঞ্চিও রোগা হননি।
আমি অবশ্য তিরিশ বছর ধরে ডেটা কালেকশনের সুযোগ
পাইনি, কিন্তু এই ক’দিন দেখেই আমি তাঁদের মোটামুটি একটা শ্রেণীবিভাগ করেছি।
আপনাদের সেগুলো বলি, দাঁড়ান।
এক নম্বর শ্রেণী হচ্ছে যাঁরা রোগামোটা কিছু হতে
চান না, সামগ্রিক স্বাস্থ্যবিকাশই তাঁদের লক্ষ্য। এঁরা পার্কে এসে উঠন্ত সূর্যের
দিকে তাকিয়ে প্রাণায়াম করেন কিংবা জোরে জোরে হাসেন। রক্ত জল করা হাসি। স্লো মোশনে।
ইন ফ্যাক্ট, আমার মা যখন এসেছিলেন, সে হাসি শুনে আমাকে “সোনা, সোনা?” বলে প্রচণ্ড
ধাক্কা দিয়ে তুলে বলেছিলেন, “পার্কে কেউ একজন খুব চেঁচিয়ে কাঁদছে, দেখতে যাবি নাকি
কী হল?” আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে, “উফ্ মা, হঠাৎ কেউ পার্কে এসে কাঁদতে যাবে কেন,
হাসছে। লাফিং ক্লাবের নাম শোনোনি?” বলে উল্টোদিকে ফিরে লেপমুড়ি দিলাম। কিন্তু সে
কথা শুনে মা এমন গড়িয়ে পড়ে হাসতে লাগলেন যে আমার ঘুমটা মাটি হয়ে গেল।
এই স্বাস্থ্যওয়ালাদের মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং
সাবক্যাটেগরি আছে। এঁরা নিজেরাই নানারকম ব্যায়াম বানান। চটাস চটাস করে হাততালি
দেন, সোজা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ উল্টে গিয়ে পেছনদিকে হাঁটতে শুরু করেন। একজনকে দুই
হাত প্লেনের মতো দুদিকে ছড়িয়ে বোঁবোঁ করে ঘুরতেও দেখেছি। কে জানে, এসবে কিছু হয় কি
না।
দ্বিতীয় গ্রুপের লোকেরা চান রোগা হতে, আর এঁদের
সংখ্যাই পার্কে সবথেকে বেশি। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইংরিজি মতে, দৌড়ে বা হেঁটে রোগা
হতে চান, আবার কেউ কেউ ভেষজ পন্থায় বিশ্বাসী। পার্কে এসেই যোগা-ম্যাট বিছিয়ে
হঠযোগে লেগে যান। এই দুই দলকেই আবার দুটো করে দলে বিভক্ত করা যায়। এক নম্বর দল
হল, যাঁরা সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবেন, আর যাঁরা করবেন না। তিরিশ বছর ধরে সাধনা করলেও
না।
আমাকে ভয়ংকর মিন-মাইন্ডেড আর নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে
তো? কিন্তু আমি একেবারেই সে রকম নই। ওপরের সিদ্ধান্তে আসার পেছনে আমার অকাট্য
যুক্তি আছে। আপনারা অনুমতি দিলে আমি সেগুলো বলতে পারি।
যাঁরা সত্যিসত্যি রোগা হতে পারবেন, তাঁরা অসম্ভব
পরিশ্রমী। কানে গান গুঁজে রকেটের বেগে পার্কের চারদিকে দৌড়োন কিংবা ব্রিস্ক ওয়াকিং
করেন। কারোর দিকে তাকানই না, মিষ্টি হাসা তো দূরের কথা। ডিটারমিনেশনে তাঁদের ভুরু
সর্বদা সেকেন্ড ব্র্যাকেট আর চোয়ালের পেশি পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে। দূর থেকে
তাঁদের আসতে দেখলেই সবাই রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর নেমে গিয়ে পথ খালি করে দেয়। কাঠবেড়ালিরা
ভীষণ ভয় পেয়ে ল্যাজ তুলে গাছের ওপর উঠে পড়ে।
অন্যদলের খালি ফাঁকি মারার মতলব। হাঁটেন আর
চারিদিকে চোখ চালান, চেনা লোক দেখা যাচ্ছে কিনা। চেনা, আধচেনা, প্রায় অচেনা যে
কাউকে দেখতে পেলেই দৌড়ে গিয়ে গপ্প জুড়ে দেন। শাশুড়িরা বউয়ের নিন্দে করেন, বউয়েরা
শাশুড়ির নিন্দে করেন, বুড়োরা আজকালকার ছেলেদের পিণ্ডি চটকান, আজকালকার ছেলেরা দৌড়
থামিয়ে মোবাইলে শেয়ারবাজারের খবর নেন। বেসিক্যালি ঘামঝরানো ছাড়া সবরকম কাজকর্মই
চলতে থাকে। ফাঁকিবাজি হঠযোগীরও অভাব নেই। তাঁরা একমিনিট পদ্মাসন করেন তো
দশমিনিট শবাসনের নাম করে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকেন।
আপনারাই বলুন, এভাবে কী ওজন কমানো সম্ভব?
কিন্তু যে যাই করুন না কেন, আমার তাতে উপকারই
হয়। টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে সময়নষ্ট করার থেকে পার্কে হেঁটে, ঘুরে, লোক দেখে টাইমপাস
করা লক্ষকোটিগুণ ভালো। আর আমার বিশ্বাস, পার্কটাও সেটাই চায়। যে সবাই আসুক, গাছের
গায়ে হেলান দিয়ে আড্ডা মারুক, চলতেচলতে হঠাৎ থেমে ঝুঁকে পড়ে একটা ভীষণ রূপসী ঘাসফুলকে মন দিয়ে দেখুক।
ধাঁইধাঁই করে সরু বাঁধানো রাস্তাটার ওপর দৌড়োক, না হয় শবাসনের নাম করে সবুজ ঘাসের
মাদুরের ওপর কিছুক্ষণ আরাম করে শুয়েই থাকুক। শুয়ে শুয়ে দেখুক আকাশের গায়ে অমলতাসের
পাতাগুলো কীরকম দোল খাচ্ছে। দুলে দুলে বলছে, দেখ দেখ আমি কী সুন্দর ফুল ফুটিয়েছি।
কেউ যদি দেখার নাই থাকে, তাহলে আর সুন্দর হয়ে
লাভ কি, বলুন?
amaltash-er kothay mone holo. amar barir shobcheye boro asset holo ekta swarnochapa gaach. amader chhoto gate-er ga beye uthey chaad chhaRiye, taar ek hajar haar chhoRiye ekdom baritake agle rekhechhey. shei grihoprobesh-er din theke shey achhey amader sathey, aar baritar sathey ekatwo hoye gechhey. jokhon jhnepe phul ashey gaachtaye, mone hoy, ei to, barita sheje uthlo.
ReplyDeleteলাক্কি সোমনাথ। সত্যি, গাছ থাকা আর না থাকা, একটা বাড়ির চেহারায় যে কী আকাশপাতাল তফাত করে দিতে পারে, ভাবা যায় না। তোমার স্বর্ণচাঁপা দীর্ঘজীবন লাভ করুক, আরও অনেক ফুল ফোটাক, সেই কামনা করি।
Deletethik bolecho..amader barir samne akta shirish gachh chhilo, baranday jhuke pora daal ar baranda amonki pachtolar chhad o chhariye jawa matha; goto bochor setake kete feleche--ebare giye dekhi barir samne ta nyara nyara lagche sudhu kata guri ta bibhotso khoter moto pore ache..
Deleteamaltash naam ta jana chilo na, ei gach tar naam janar khub i ichhe chilo, thanku :)
নামটা জানার পর থেকে গাছটা আমার আরও বেশি প্রিয় হয়ে গেছে স্বাগতা।
DeleteAs usual bhalo lekha..pore bhalo laglo..
ReplyDeleteঅমলতাস...prothom sunlam shobdo ta..besh kan-e lege thaka nam..koutuholboshoto google korlam ektu..besh sundor holud pata bhorti ekta gach..bhalo besh..
হ্যাঁ সৌমেশ, এই একটামাত্র গাছ, যেটার আমার ফুলের থেকে নাম বেশি পছন্দ।
Deleteamaltash er kta bod naam o ache janish to,bandarlathi...kono manei hoy na bol?lekhata jathariti bhalo,kathberalider voy paoata sotti..:-),eidharaner lokder sange hantte gele nijeke kirakam byartho bole mone hoy
ReplyDeleteমানে তো হয়ই না তিন্নি। তবে তোর ব্যর্থ মনে হওয়ার ব্যাপারটা পড়ে একা একাই হাসছি।
Deleteঅমলতাস মনে হয় সোনা ঝুরির মতো । সোনা ঝুরির আরেকটা নাম আকাশমণি । কি সুন্দর না ? লেখা টা খুব ভালো ।
ReplyDeleteআকাশমণিরই আরেক নাম সোনাঝুরি? কী সাংঘাতিক, আমি এটাও জানতাম না।
Deletemonta bhalo hoye gelo......
ReplyDeleteবলছ রণিতা? থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
DeleteAmadero to paray paray park...agey jetam majhe majhe dolna chorte, ekhon regular jayi Bebe ke hatate. Chhoto chhoto onek bachha ashe ar lakh lakh kukur ashe hatte :) Kedo-o hete hete beray park e majhe majhe ar kukur der tara kore bhagiye daye.
ReplyDeleteLaughing club ami Kolkatay lake er mathe dekhechilam. Ora joto na hashe, oder dekhe manushe beshi hashe setao ami dekhechi :)
issh aamio etai bolte jachhilam! amader parateo laughing club achey....lokjon oder dekhei heshe kutipati hoye jay!!!
Deleteএইবার আমিও একটা গল্প বল্ব। উত্তরপাড়ায় সি এ মাঠ বলে একটা বিখ্যাত মাঠ আছে, সেখানে অনেককাল আগে একটা লাফিং ক্লাব ছিল। যখন আমরা এই ধরো ক্লাস সেভেন-টেভেনে পড়ি। আমার এক বন্ধু ছিল তনুলীনা। ভীষণ মজার মেয়ে। ও রোজ স্কুলে আসার পথে পার্কের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে লাফিং ক্লাবের ব্যাপারস্যাপার দেখে হিহি করে হাসত। একদিন মেম্বাররা সবাই মিলে, "এই যে খুকি, এটা কী নাট্যশালা পেয়েছ?" বলে খুব জোরে বকে দিয়েছিল। সেই থেকে আমি লাফিং ক্লাব দেখলেই দৌড়ে পালাই।
Deleteরিয়া, তোমার বেবের স্বাস্থ্যচর্চা খুব ভালো হচ্ছে দেখছি। চালিয়ে যাও।
খুব ভাল লাগল ... অমলতাসের কথায় 'চন্দ্রবিন্দু'র সাম্প্রতিক ওই গানটা মনে পড়ে গেল ...
ReplyDelete"সে গিয়েছে বনে ... গোপনে আনমনে ... সে লিখেছে গাছের গায়ে নাম ... অমলতাস ...
সে দিয়েছে পাড়ি ... আসমানী রেলগাড়ি ... সে দিয়েছে বুকের ছেঁড়া মেঘ, বোবা বাতাস ..."
লেখাটা লেখার সময় ওই গানটা আমারও মাথায় ঘুরছিল পিয়াস।
Deletetomader paray paray park ar protyek park ei laughing club? bahh, sara parar to besh free entertainment er byabostha korechhen sheela-di !!
ReplyDeletelaughing club somporke na janle kintu hothat kore oder hashte sunle pile chomke jabe, kakima ke ekdom dosh dewa jay na..
এই রে সোহিনী, সব পার্কে লাফিং ক্লাব আছে কি না সেটা জানি না। তবে হাসি শুনে পিলে চমকানোর কথাটা একেবারে ঠিক বলেছ।
Deleteখুব, খুব ভালো লাগলো। অমলতাস নামটা খুব শোনা, আজ প্রথম গুগল করে চেহারাটা দেখে বুঝলাম গাছটাও চিনি।
ReplyDeleteএখানে মোটা ব্যায়াম করিয়েদের নিয়ে ঠাট্টার একটু প্রতিবাদ জানাতে চাই। তারাপদবাবুর পর্যবেক্ষণ ভুল না, কিন্তু তার মানে হলো, যে ওই মোটারা লেকের মাঠে না হাঁটলে আরো মোটা হয়ে যেতেন। এবং আমি নিজেকে দিয়ে এটা দেখেছি যে খাওয়া এবং ব্যায়াম দুটো সবাইকে সমান ভাবে প্রভাবিত করেনা।(সীমিত সময়) ব্যায়াম করলে কেউ কেউ রোগা নাও হতে পারেন, কিন্তু ওই হাঁটাটুকুর দরুন তাদের ফিটনেস বাড়ে।
অবশ্য যারা গল্পগাছা আর শবাসনে বেশি উত্সাহী তাদের বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
সে তো বটেই, কার কী কাজে দেবে, আদৌ দেবে কিনা সে সব গুরুতর রহস্যের ব্যাপার।
Deleteha ha ha, amader barir samner park er galpotao obikol prai ekirakom, tobe oi 'অমলতাস' er badole ekhane achhe Krishnachura ar Radhachura. ekta sundor bokul phuler gachh o achhe.
ReplyDelete'অমলতাস' namta khub khub bhalo laglo. gachhta chena ar khubi bhalo lage dekhte kintu oi namta aro beshi bhalo laglo.
ইস বকুলগাছ নেই আমাদের পার্কে। হিংসে হিংসে।
Delete