সাজা-সাজা খেলা

আপনার কি ছোটবেলায় অনে-এ-এ-ক খেলনা ছিল? পুতুলের সংসার, পেঙ্গুইনের ভেতর পেঙ্গুইনের ভেতর পেঙ্গুইন, মাথা নাড়া বুড়ো, দম দেওয়া লালহলুদ রোবট, দড়ি টানা খটখটে গাড়ি, ছোট্ট সলতেয় আগুন জ্বালিয়ে গামলার জলে ছেড়ে দিলে ভটভটিয়ে চলা স্টিমার? আমার এগুলো সব ছিল। তা বলে ভাববেননা আমি বাজারে গিয়ে মাবাবাকে এই কিনে দাও ওই কিনে দাও বলে জ্বালিয়ে খেতাম, না দিলে রাস্তায় বসে পড়ে চেঁচাতাম। আমি ভয়ানক শান্ত আর মুখচোরা বাচ্চা ছিলাম, এখনকার আমি-র থেকে অনেক বেশি। সুবিধেটা ছিল বাড়িতে আমি একা বাচ্চা ছিলাম, আর কাকা মামা জেঠু পিসির অভাব ছিল না। প্রত্যেকে মাঝেসাঝে একটা করে খেলনা উপহার দিলেও খেলনার ঝুড়ি উপচে পড়ত।

কিন্তু এত খেলনা আমার কোনোটাই কাজে লাগত না। খেলতে ভালো লাগত আমার কিন্তু খেলনা ভালো লাগত না। মনে হত কী সব শিশুসুলভ ব্যাপার। আমার সবথেকে ভালো লাগত সাজা-সাজা খেলা, যেটা খেলতে খেলনা বিশেষ লাগত না। যেমন ধরুন বাবার শার্ট পরে ডাক্তার সাজা, কিংবা বালিশ-ছেলে কোলে নিয়ে মা। এসব খেলার মুখ্য উপাদান কল্পনা হলেও জিনিসপত্র বা প্রপস ব্যবহার করলে খেলাটা বেশ রিয়্যালিস্টিক হয়ে উঠত। সেরকম কয়েকটা খেলা আর প্রপস-এর গল্প বলব আজ।

ছবি গুগল ইমেজেস থেকে

যতদূর মনে পড়ছে আমার খেলার প্রথম প্রপস ছিল এক-বালিশ, দুই-গামছা। বালিশ উঠত কোলে, আর গামছা চড়ত মাথায়। গামছা দিয়ে লম্বা চুল বানায়নি এরকম শিশুকন্যা আমাদের প্রজন্মে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যেত না। তখনও ববছাঁট মায়েদের অত প্রচলন হয়নি, কাজেই বালিশ-কোলে এঘর ওঘর ঘুরতে গেলে লম্বা চুলের প্রয়োজন হত। আমি তার সঙ্গে কাঁধে একটা ব্যাগ নিতাম। হাই ফাই ডিজাইনার ব্যাপার কিছু নয়, মায়ের পরিত্যক্ত অফিস যাওয়ার ব্যাগ হলেই হত। তার মধ্যে থাকত ছেঁড়া কাগজের টাকা আর একটা পেন। আমি বালিশ ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে গালে চুমু খেয়ে বলতাম, “তুমি লক্ষ্মী হয়ে থাকো, আমি অফিস গিয়ে সইটা করেই চলে আসব।” বলে ঘরের কোণায় গিয়ে ব্যাগ থেকে পেন বার করে গামছা পেঁচানো মাথা ঝুঁকিয়ে হিজিবিজি সই করার ভঙ্গি করে, “এই তো এসে গেছি!” বলে ছুটে এসে মহাসমারোহে বালিশকে কোলে তুলে নিয়ে একগাদা চুমু খেতাম।

ডিসক্লেমারঃ পুরো ব্যাপারটা মাকে টুকে করতাম বুঝতেই পারছেন, কিন্তু আমার মা কোনোদিন অফিস গিয়ে “সই করেই” চলে আসেননি। ওটা বেসিক্যালি আমাকে ভুজুং দেওয়ার জন্য।

দ্বিতীয় যে খেলাটার কথা মনে পড়ছে সেটা খেলা হত বুচিদিদিদের ছাদে। এ খেলায় প্রপস লাগতনা, কিন্তু একজন সঙ্গী লাগত। বুচিদিদিদের ছাদ ছিল বিশাল আর আশপাশের সব বাড়ির থেকে উঁচু। সে ছাদের চারদিকে পাঁচিল দেওয়া ছিল, যেটার ওপর আমার মাথা যেত না। কিন্তু পাঁচিলের গায়ে গায়ে ডিজাইন করা ফাঁকফোঁকর ছিল, সেখান দিয়ে আমি দিব্যি দেখতে পেতাম। লাখ লাখ নারকেল গাছ, দীপুকাকুদের জাহাজবাড়ির ছাদ আর অনেক দূরে তিন-নম্বর জলট্যাঙ্কের মাথা।

যাই হোক, খেলাটার কথায় আসি এবার। খেলাটার জন্য প্রথমেই ছাদের ওপর একটা গভীর বন কল্পনা করে নিতে হত। আমি আর বুচিদিদি একটা পালকি বয়ে বয়ে বহুদূর থেকে মাঠঘাট গাঁগঞ্জ পেরিয়ে আসছি, আসতে আসতে পথের মাঝে পড়েছে এই জঙ্গল, আর জঙ্গলে যেই না ঢোকা অমনি সূর্য গেছে ডুবে। আমরাও ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পালকি নামিয়ে...কী বললেন? পালকির ভেতর কে আছে? দাঁড়ান না, সব বেরোবে ধীরে ধীরে...হ্যাঁ, পালকি নামিয়ে আমরা হাত পা ছড়িয়ে কাল্পনিক গামছাটামছা দিয়ে মুখটুখ মুছতাম। চকমকি কাঠ (চকমকি কাঠ জীবনে চোখে দেখিনি, কিন্তু ব্যাপারটার প্রতি অসীম আকর্ষণ বোধ করতাম তাই চকমকি কাঠ ব্যবহার করা যাবে এমন স্ক্রিপ্টই লেখা হত খেলার জন্য) ঠুকে আগুন জ্বালা হত। আগুন জ্বালার গরিমা অবশ্য আমার কপালে জুটত না। আগুন জ্বালত বুচিদিদি, আমি কাঠ কুড়োতে যেতাম। যেগুলো গুঁজে গুঁজে আগুন জিইয়ে রাখা হবে সারারাত। খেলার সবথেকে রোমহর্ষক জায়গাটা আসত ডিনারের সময়। মানে পালকিবাহকদের ডিনার। কী বলুন দেখি? চেষ্টা করে লাভ নেই, পারবেন না।

জ্যান্ত সাপ। বনবাদাড় ভেঙে বুচিদিদি জ্যান্ত সাপ ধরে আনত। ঢোঁড়া-মোড়া না, একেবারে অজগর। কী করে সাপ ধরে জানেন তো? কায়দা করে সাপের মাথাটা চেপে ধরতে হয় যাতে বিষদাঁতটা ভেঙে যায়। তারপর সেই সাপ মেরে, আগুনে সেঁকে আমরা আরাম করে খেতাম। খেয়ে দেয়ে আগুনের পাশে শুয়ে গামছায় মাথা রেখে নিশ্চিন্ত ঘুম। সাপের গা থেকে যে চর্বি বেরত, সেটা দিয়ে আগুন সারারাত আপনি জ্বলত ধিকিধিকি।

বাচ্চা ছেলেরা কি সাজা-সাজা খেলে? সত্যি বলছি আমার আইডিয়া নেই। বান্টিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাটাচ্ছেলে প্রথমে এমন ভাব করল যেন এসব খেলা আবার মানুষে খেলে? ও নাকি জন্ম থেকেই দাবাড়ু। তারপর বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার মামাতো দাদা যখন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত তখন এসব বোকামো করতাম মনে আছে। ডাকাত ডাকাত খেলা হত। স্বাভাবিক যুক্তি মানলে একজন ডাকাত হলে আরেকজনের পুলিশ হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ হওয়ায় কারো রুচি নেই। সকলেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে থাকতে চায়। কাজেই দুজনেই ডাকাত হত নাকি। আমি বলতাম, তাহলে গল্পটা কী দাঁড়াত? বান্টি বলল, দূর গল্প আবার কী? ধাঁইধপাধপ এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি। যতক্ষণ না কেউ এসে কান প্যাঁচাচ্ছে।

বলতে গিয়ে মনে পড়ল, JNU তে আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল শ। একবার ছেলে আর মেয়েদের মিল-অমিল নিয়ে কথা ওঠাতে শ বলেছিল, ও নাকি ছোটবেলাতেই বুঝে গেছে মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার হেবি অদ্ভুত। বলেছিলাম, কীরকম শুনি? তাতে শ বলেছিল পিসির বাড়ি গেলে নাকি ওকে পিসতুতো বোনের সাথে খেলতে হত। বোন ওকে নদী থেকে জল আনতে পাঠাত, আর নিজে কুঁড়েঘরে বসে উনুনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে রান্না করত। শ জল তুলে, কাঠ কেটে, বাঘ শিকার করে শেষমেষ ভয়ানক রেগে গিয়ে বলেছিল, তুই থাকগে কুঁড়েঘরে, আমি স্যুটবুট পরে অফিস চললাম।

ছবি গুগল ইমেজেস থেকে

আপনি কী সাজতেন ছোটবেলায়?