সকাল



স্মৃতিকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে বহুদূরে পাঠিয়েও আমি এমন একটা সময় মনে করতে পারিনা যখন আমার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে অসুবিধে হত। বা এমন একটা সময় যখন আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাড়িশুদ্ধু লোক উঠে পড়ে হইচই জুড়ে দিতনা। ঠাকুমা ফুলচোর তাড়াচ্ছেন, বাবা দুমদাম করে জানালা খুলছেন পর্দা সরাচ্ছেন, বাথরুমে খালি বালতিতে ছড়ছড় করে মিউনিসিপ্যালিটির সকালের টাইমের জল দাপটে পড়ছে, আর আমি চোখ কচলাতে কচলাতে খাটের ওপর দাঁড়িয়ে মিহিস্বরে “মা, মা” বলে ডাকছি, যাতে চা করা মাঝপথে থামিয়ে এসে মা আমাকে কোলে করে খাট থেকে নামাতে পারেন।

পিসি রোজ ভেংচি কেটে বলত, “আহ্লাদ দেখে আর বাঁচি না”। আমি পাত্তা দিতাম না। মায়ের কোলে চেপে দিন শুরু করার মজা যে না বোঝে, লস তার।

ক’বছর পর যখন আর কোলে চেপে নামার ব্যাপারটা থাকল না, তখনও সকালগুলো একইরকম সুন্দর ছিল। আমাকে কোনোদিন মর্নিংস্কুলে যেতে হয়নি, তাই সকালটা বেশ গড়িমসি করে শুরু করা যেত। দাঁত মাজতে মাজতে আকাশপাতাল ভাবা যেত। রাতের হাফ দেখা স্বপ্নটার শেষটা কীরকম হলে বেশ হবে সেই নিয়ে জল্পনা করা যেত। সকাল দীর্ঘ হওয়ার খারাপ দিক ছিল বই খুলে বসার ব্যাপারটা। বিশ্রী ব্যাপার। স্রেফ পড়া থামানোর ছুতো পাওয়া যাবে বলে আমি অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কখন দুধের গ্লাস আর দুখানা মিল্ক বিকিস বিস্কুট আসবে। পড়ার পাট আর নেই, কিন্তু দুধ আর মিল্ক বিকিসের প্রতি ভালোবাসা আমার এখনও অটুট আছে।

কলেজ জীবনের বাকিটুকুর মতো আমার সকালগুলোরও কী যে হল, কোথায় যে গেল, সে এক ধোঁয়াশা। সকালের নাগাল ফের পেতে পেতে সেই JNU. কিন্তু সেসব কী সকাল, আহ। কাকভোরে উঠে কানে FM গুঁজে আমি হাঁটতে বেরোতাম। পুরো রিং রোডটা হনহনিয়ে হেঁটে আসতে পাক্কা এক ঘণ্টা লাগত। একটা গোটা ঘণ্টা, শুধু আমার একলার। ভাবা যায়? আমার আর পথের দুধারের হলুদ ফুলে ছাওয়া সারি সারি উঁচু উঁচু অমলতাসের। আর রাস্তা পেরিয়ে দৌড়ে যাওয়া কয়েকটা গর্বিত ময়ূরের। রোজ একই রাস্তা, একই সময়। হাঁটতে হাঁটতে টি পয়েন্টে পৌঁছলে আকাশে প্রথম রঙ ধরত, পশ্চিমাবাদের মোড়ের কাছে দূর থেকে দেখা যেত পেপারওয়ালা ভাইয়ার সাইকেল, আর ইস্টগেটের কাছাকাছি পৌঁছলেই কানে গান থেমে গিয়ে হঠাৎ ক্রিং ক্রিং ক্রিং। মায়ের ফোন। রোজ একই কথা, তুমি কেমন আছ, আমি ভালো আছি। এই ক’টা শব্দ এত বছর পরেও বাড়ি ছাড়ার পরের সেই প্রথম দিনটার মতো ঝকঝকে কী করে রয়ে গেল, সে এক রহস্য।

এখন আর সেরকম সকাল হয়না। যেরকম সকালে দাঁত মাজতে মাজতে মাথার ভেতর কবিতা ভাঁজা যায়। কিংবা আরাম করে বসে দুধে ডুবিয়ে বিস্কুট খাওয়া যায়। এখন সকাল হয় অফিস যাওয়ার জন্য। ছুটে ছুটে সবার আগে অফিসে পৌঁছে নিজের জন্য খানিকটা নিরিবিলি সময় চুরি করার জন্য এখন রোজ অ্যালার্ম বাজিয়ে ভোরে উঠি। উঠে বাড়ির ভেতর আলো জ্বেলে হাঁটিচলি আর রিং রোডের সকালগুলোর কথা ভাবি। ভাবি এখন কি অমলতাসের ফুল ধরার সিজন? কে জানে।

আর তখন আমার বাড়ির সামনের অজানা মহীরুহ ছাওয়া পথ দিয়ে কোনো কোনো লোকেরা কানে গান নিয়ে দৌড়য়। দৌড়য় আর খেয়াল করে কাঠবেড়ালিদের সাইড দেয়। আমার থেকে লক্ষকোটিগুণ বেশি বুদ্ধিমান লোকেরা।

রেসলিউশন নেওয়ার সিজন এটা নয়, তবু নিয়েছি। হারানো সকাল পুনরুদ্ধার করার রেসলিউশন। দেখা যাক পারি কিনা। 
   

Comments

  1. এই রেজোল্যুশনটা আমি মাসতিনেক আগে নিয়েছি। আগের থেকে অনেক হাল্কা আছি। অনেক বিদ্রূপ-ব্যঙ্গোক্তি হজম করতে হবে, কিন্তু একবার সেই সময়টা পেরিয়ে গেলে দেখবি, মনটা ঝকঝকে লাগছে।

    সবথেকে বড় কথা, খানিকটা হলেও নিজেকে আবার খুঁজে পেয়েছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ না সে টেনশন নেই। উৎসাহ দেওয়ার বা বিদ্রূপ করার লোক নেই। বাঁচা গেছে।


      Delete
  2. খুব ভাল রেজল্যুশন| আমারও ইচ্ছে হয় একেক সময়ে, আবার ভাবি হারানো রাতগুলোকে আগে পুনরুদ্ধার করি, তারপর হারানো সকালের কথা ভাবা যাবে| কম্পিউটারটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলে হয়ত হবে, আবার হয়ত তাহলেও হবেনা|

    ReplyDelete
  3. lekhata darun..jadio ami konodin sakale uthi na,parbo se ucchashao nei,tabu lekhata pore mon vore gelo:)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ তিন্নি। তোর মন্তব্য পড়ে আমারও খুব ভালো লাগছে।

      Delete
  4. khub bhalo laglo porte. aami morning school e jetam kina tai sakal mane aamar kachey ekta atanko....shei kaak bhore ute snan, toiri, school bus...uff! jaghonyo..aami bharat borsher siksha montri holey oi morning school aage tule debo!

    tai jei na chance pelam bhor e paat e tule dilam. ekhon berate na gele aar vista point theke sunrise dekhbar byapar na holey aami oi dikei nei :))))

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা তোমাকে শৈশবে মর্নিং স্কুলের যন্ত্রণা পেতে হয়েছে বুঝি শম্পা? আমার বিলেটেড সহানুভূতি রইল।

      Delete
  5. Amar 9+ hrs ghum na holey mone koshto hoy. Tai sokal e kak'er moto othbar ba raat e pancha'r moto jege thakbar ami kono karon dekhi na. Baki time ei amar nijer somoy, ranna-khaoa, Mota-Kedo-May-La, baje boka, boi pora, facebook sob edhar odhar guje dii.
    Majhe amader Ukraine er kichu public er sange kaj korte hoto bole sokal 6tay meeting thakto. Tai tokhon thekay pore uthte hoto taratari, kintu sedin 3tey bari ferot ashao jeto. Ar team lunch o hoto odin. Tai otota baje lagto na :) Sobai bolche jotodin na chhana pari totodin arame ghumono jabe, chhana-pona hoye gele naki dher jhamela...tai ekhon aro beshi kore ghumiye nichhi ami :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস্ট অর ওয়েস্ট, ঘুম ইজ দ্য বেস্ট। কাজেই যত পারো ঘুমোও রিয়া।

      Delete
  6. khub bhalo laglo lekhata pore..tobe sokal je amar jonye noy seta ami chotto thekei bujhe gechi tai resolution er dharekacheo gheshina..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ তুমিও নাইট পার্সন স্বাগতা? আমার দলে লোক খুবই কম দেখা যাচ্ছে।

      Delete
  7. amio riyar motoi... sokaleo uthi na, raat o jagi na. rat 10 tay chirokal ghumonor jonyo jothesto bodnam chhilo amar bondhu mohole. sudhre gealm khanikta hostel e giye, jokhon rat berat obdhi cinema cholto...ar ekhon.. heh heh sobi meyer routine er songe adjustable byapar.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সোহিনী এটা মাবাবার চেনা প্যাটার্ন দেখছি। হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাত ১০টায় ঘুমোনোর ব্যাপারটায় হাই ফাইভ।

      Delete

Post a Comment