ভাবা যায়?
মাসখানেক আগে একবার হয়েছিল, পাত্তা দিইনি। গত সপ্তাহে আবার হল। রাতের দিকে
অল্প অল্প শীত করে। সকালে ঘুম ভাঙার পর ঘাড় মাথা অসম্ভব ভারি লাগে, ঢোঁক গিলতে
কষ্ট হয়, কান-নাক-গলা তিনটেকে যোগ করে যে রাস্তাটা গেছে মাথার ভেতর দিয়ে, সেটা
জলবিছুটি লাগার মত জ্বলতে থাকে।
এই পর্যন্ত শুনে সোমা লাফিয়ে পড়ে বলল, “কুন্তলা বেশি কায়দা না করে
এইবেলা ডাক্তারের কাছে যা বলছি।” বান্টি বলল, “আহা
এখনি ডাক্তার কীসের। আগে গার্গল করে দেখো, হয়ত নিরীহ ইনফেকশন।”
সোমা জ্বলন্ত চোখে বান্টির দিকে তাকিয়ে বলল, “নিরীহ
ইনফেকশন? তুই কি ডাক্তার? কী থেকে কী হয় জানিস তুই?”
একটা ঝামেলা বাধে বাধে দেখে আমি বললাম, “আহা
তোমরা আমার কথাটা শোনো আগে। আমার সমস্যাটা এটা নয়।”
“তবে কোনটা?”
“সমস্যাটা হল যে যে দুদিন এরকম হয়েছিল, দুদিনই আমার কোনো ডেডলাইন ছিল না,
এমনকি পরেরদিনও, তার পরেরদিনও না, তার তার পরেরদিনও...”
বান্টি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি আগে বাঢ়ো।”
আমি বললাম, “ব্যাপারটা হচ্ছে যে দুদিনই আমার অফিস
না গেলেও চলত, আমিও দুদিনই সকালে উঠে ডিসাইড করে ফেলেছিলাম যে ডুব মারব। কিন্তু যত
ঘড়ি এগোতে লাগল আমার মনের জোর কমতে লাগল, সাড়ে সাতটা নাগাদ সেটা কমতে কমতে তলানিতে
ঠেকল, আটটার সময় আমি আর থাকতে না পেরে দু’মিনিটে কাকের মতো ঝপঝপ স্নান সেরে,
ভেজা চুলে, কোনোমতে
মিসম্যাচ জামাপ্যান্ট অ্যাঁকাব্যাকা করে গলিয়ে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প’নে নটার মধ্যে অফিসের চেয়ারে
বডি ফেলে হাঁসফাঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম।”
জোড়া জোড়া চোখ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
“ইয়ে, আমার মনে হচ্ছে আমার...মানে আমি বোধহয় অফিস-যাওয়া ব্যাপারটার প্রেমে পড়ে
গেছি।”
জোড়া জোড়া চোখে কৌতূহলের বদলে অবিশ্বাস, অবিশ্বাসের বদলে যন্ত্রণা ফুটে উঠল।
প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা।
মিনিট দুয়েক পর একমাত্র বান্টি কথা বলল।
“ক্যাপিটালিজম শেষটায় ধরে ফেলল তো?”
সিরিয়াসলি। নিজের মনকে চোখ ঠারাবার অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত আমি মেনে নিতে
বাধ্য হয়েছি যে অফিস যেতে আমার ভালো লাগে। কোথায় গেল দশটা-পাঁচটার প্রতি আমার সেই
অসীম তাচ্ছিল্য, ডেস্কজবের প্রতি সেই অগাধ অনীহা, নিজেই নিজের মালিক হওয়ার সেই
অদম্য আকাঙ্ক্ষা---আমি ভেবে পাই না।
সত্যি বলছি, এখন যদি কেউ আমাকে বলে এই চাকরিটা ছেড়ে উটের পিঠে চেপে মিশরের
মরুভূমি এক্সপ্লোর (অল-এক্সপেন্স-পেড) করতে যাবে নাকি, আমি এককথায় হ্যাঁ বলতে
পারবনা। মাথা চুলকে, "ভেবে দেখছি" বলে এড়িয়ে যাব।
অবিশ্বাস্য।
আমি ভেবে দেখেছি আমার এই ১৮০ ডিগ্রি পালটি খাওয়ার রহস্যটা কী। মিশরই হোক কি
রেনফরেস্টই হোক কি অ্যান্টার্কটিকা, আসল কথা তো পালানো? এই বাড়িটা, বিছানাটা,
রান্নাঘরটা থেকে? অফিস আমাকে সেই পালানোর জায়গাটা অলরেডি করে দিয়েছে। পালানোও যায়
আবার পথে পথে ঘুরতেও হয় না। একটা জায়গায় একটা চেয়ার টেবিলে আমার নাম লেখা আছে।
সেখানে গিয়ে বসে থাকা যায় সারাদিন।
বুড়ো যে হয়েছি এটা তার আরও একটা প্রমাণ। অনির্দেশ্য অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানির
থেকে চেনা আশ্বাস অনেক বেশি প্রিয় লাগে এখন। অবস্থা এমন হয়েছে যে অফিস যাওয়ার চেনা
রাস্তাটা, চেনা চেনা মোড়গুলো, চেনা সিগন্যালে আটকা পড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের গাড়ির
বেগুনি-চুলো ড্রাইভারের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যতক্ষণ না সে আমার দিকে ভুরু
কুঁচকে ফিরে তাকাচ্ছে---সব ভালোলাগছে আমার আজকাল।
তাছাড়া আমার ডেস্কটা তো আছেই। L-শেপড শক্তপোক্ত উডফিনিশ ডেস্ক। একগাদা
কাগজপত্র, পেনস্ট্যান্ড, চায়ের কাপ, জলের গ্লাস রাখার পরেও, লাঞ্চের পর চট করে হেড
ডাউন করার মতো অনেক জায়গা বাকি থাকে সেটায়। আমার মাথার পেছনের বড় জানালাটা দিয়ে
অনেক গাছ আর গাছের ওপারে অনেক দূরে উঁচু উঁচু বাড়ি দেখা যায়। মনিটরের দিকে তাকিয়ে
তাকিয়ে চোখে ব্যথা হয়ে গেলে আমি চেয়ারশুদ্ধু ঘুরে গিয়ে সেই বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে
থাকি। কোনটা কীসের বিল্ডিং সেটা চেনার খেলা খেলি নিজের সাথে আর তপ্ত আর্ল গ্রে-র
কাপে চুমুক দিতে দিতে চেয়ারটা নিয়ে অল্প অল্প এদিক ওদিক দোল খাই।
কাজেই হ্যাঁ, আমার ইদানিং অফিস যেতে খুব ভালোলাগছে। ডেডলাইন না থাকলেও,
থাকলেও। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম না থাকলেও, থাকলেও। আর্ল গ্রে-টা না থাকলে অবশ্য
কী হবে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা যতদিন আছে ততদিন সে নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
bojho!
ReplyDeleteসিরিয়াসলি।
Deleteseki!!emon holo keno?
ReplyDeleteহয়ে গেল তো। আমি কী করব? (যথাসাধ্য বেচারা মুখ)
Deleteসেরে ওঠ্। তাড়াতাড়ি।
ReplyDeleteহ্যাঁ সেই।
Deleteঅনেকদিন ধরেই এই ব্লগটা পড়ি, এইটা পড়ে আর নীরব পাঠক থাকা গ্যালো না :)
ReplyDeleteএকবার দুম করে বেরিয়ে পড়ুন, ভোরের লোকাল ট্রেন ধরে, এমন একটা স্টেশন খুঁজে নিন যেখানে এখনো কার্ডের টিকিট পাওয়া যায়, ঘটাং ঘট করে পাঞ্চ করার আওয়াজ শুনুন কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে, স্টেশনের সামনের দোকানে ঠান্ডা তেলেভাজা খান, পাশের রাস্তা ধরে সোওওওওওওজা হাঁটুন, গাছের ছায়ায় থেবড়ে বসে একটা বই পড়ুন, প্যাকেট খুলে বিস্কুট খান, সন্ধ্যে হলে কিচিরমিচির শুনতে শুনতে ফিরে আসুন :)
আহা বড় ভালো পরামর্শ দিয়েছেন সুমন্ত। এইটা একবার করে দেখতেই হবে। বিস্কুটটাও ঠিক করে ফেলেছি কী খাব। পার্লে জি নয়তো টাইগার। বইটা এখনও মাথায় আসছে না। দেখি আরেকটু ভাবি।
Deleteসরব হওয়ার জন্য, আর এইরকম ভালো কমেন্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
arey first para ta pore vablum tomar bujhi viral fever hoyeche :/
ReplyDeleteআহা কুহেলি, ভাইরাল ফিভারের থেকে অফিস ফিভার এমন কিছু কম কঠিন অসুখ নাকি?
Deleteget well soon, mamuuu !!
ReplyDeleteথ্যাঙ্ক ইউ ভাগ্নে। পুরী কেমন ঘোরা হল? খুব স্নান করলে নাকি?
Deletepuri trip bhaloi chhilo, tobe oi kucho bachha niye snan-tan kora jay na sebhabe...
Deleteহুম সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ।
Delete“Whenever I feel the need to exercise, I lie down until it goes away.”
ReplyDelete― Robert Maynard Hutchins
আপনি অফিসের ক্ষেত্রেও এটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন| তবে মনে হয়না এতে চিন্তার কিছু আছে| এই ধরুন আমার বাড়িতে এসি নেই| আমি তাই গরমের ছুটিতে রোজ কলেজ গেছি, একটু আরামে সময় কাটাব বলে| শীতে বাড়িতে হিটিং থাকবে, আর এক ফুট বরফ ঠেঙিয়ে যেতে হবে, তাই যাবনা| আপনার ক্ষেত্রেও অফিসটা বাড়ির থেকে বেশি আরামদায়ক হয়ে গিয়েছে হয়ত| এটা সারাতে হয় বাড়িটা কে বেশি আরামদায়ক বানান, নয়তো এমন একটা জায়গায় মুভ করুন যেখান থেকে অফিস যাতায়াত ভয়ানক কষ্টকর, আর নাহলে এমন একটা হবি তৈরী করুন (যেমন ক্যামেরা ঘাড়ে করে বেরিয়ে যাওয়া) যেটা অফিস যাওয়ার থেকে বেশি আনন্দ দেবে|
হাহাহাহা সুগত, আমাকে অফিস যাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে সবার এত উৎসাহ দেখে ভালো লাগছে। সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। অফিসটা বাড়ির থেকে বেশি আরামদায়ক না হলেও খুব একটা কমও নয়। স্রেফ একটা বিছানার জন্য হেরে গেছে।
DeleteAmar kintu office jete byapok lage! Keno je sobar kharap lagey ta ami bujhi na. Aro jeta bujhina seta holo "office/kaj e jete kharap laga" byapar tai jeno normal. Keno baba? Mash gele je mutho mutho taka ghore ashe seta te to karur apotti nei, to kaj korbar bela apotti keno? No faakibaji allowed, office jaoyay sumoti hoyeche tomar, sei sumoti barte thakuk. Tomay ashirbad korlam! :D :D
ReplyDeleteঅ্যাবসলিউটলি রিয়া। তোমার আশীর্বাদ মাথা পেতে নিলাম।
Deleteche, chee ar tomar opor abar amar bhorsha chilo. Dobale. Office er boro babu abar tomar blog porche naki?
ReplyDeleteধুর বস আবার পড়বে কি। তাঁর কাছে এসব আঁকাবাঁকা দুর্বোধ্য অক্ষর ছাড়া আর কিছু নয়।
Deletemaa ke abar kota din ghure jete bolo dekhbe bari office ke bole bole ak dojon goal e harachhe :)
ReplyDeleteএটা ভালো বুদ্ধি দিয়েছ স্বাগতা।
Delete