মণির মেয়েবেলা

সেদিনের অবান্তর পোস্টে আপনাদের প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমি ধন্য। আপনারা অবান্তরকে যতটা ভালোবাসেন, অবান্তরও আপনাদের ততখানিই ভালোবাসে। অবান্তরের বাড়িওয়ালাও।

অনেকেই বলেছেন আমার ছোটবেলার গল্প পড়তে আপনাদের সবথেকে বেশি ভালোলাগে। উইন উইন সিচুয়েশন, কারণ ছোটবেলার গল্প লিখতে আমারও দারুণ লাগে। সে আমার নিজেরই হোক কিংবা অন্য কারো। আজ যেমন অন্য একজনের ছোটবেলার গল্প শোনাব আপনাদের। মণির। অর্থাৎ কিনা আমার মায়ের।

আমার মায়ের সাথে আমার ছোটবেলার মিলও অনেক, অমিলও। আমরা দুজনেই ক্যাবলা ছিলাম, দুজনেই খেলার দলে পার্মানেন্ট দুধ-ভাত ছিলাম, আমাদের দুজনকেই যে যার মায়েরা বারো মাসের মধ্যে দশ মাস ন্যাড়া করে রাখতেন। পাছে মেয়ের গরম লাগে। অমিলের মধ্যে আমি ছিলাম একাবোকা আর ষষ্ঠীঠাকরুনের দয়ায় মায়ের খেলার সঙ্গীর অভাব ছিল না।

ছবি গুগল ইমেজেস থেকে

এই ছবিটা মায়ের ছোটবেলা নিখুঁত ফুটিয়ে তোলে। শুধু দিদিমাকে পটের বিবি সাজিয়ে রেডিওসেটের সামনে বসিয়ে না রেখে, কালিঝুলি মাখা রান্নাঘরে তপ্ত উনুনের সামনে ঘর্মাক্ত কলেবরে কল্পনা করে নিলে সত্যের প্রতি সুবিচার হবে।

মা সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে শুয়েই ছোটবোনের সাথে ‘বিয়েবাড়ি বিয়েবাড়ি’ খেলতেন---“ওরে কে কোথায় আছিস, মাছের ঝুড়িটা রাখার ব্যবস্থা কর”, “হ্যাঁ বাবু করছি”---নাক টিপে ধরে “প্যাঁ-অ্যা-অ্যা” সানাইও বাজত সে বিয়েবাড়িতে যতক্ষণ না সেজমাসি এসে কান ধরে দুই বোনকে বিছানা থেকে টেনে নামাচ্ছেন, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে সারাদিন খেলতেন, স্কুল থেকে ফেরার পথে সাদা ইউনিফর্ম পরে রাস্তার ধারের ছাইয়ের গাদায় স্লিপ খেতেন, বাড়িতে এসে মামাদের ফুটবল খেলায় অংশ নিতেন, আর আটটা বাজতে না বাজতে ভূগোল বইয়ের খোলা পাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অঘোরে ঘুমোতেন।

দিদিমা মাটির মানুষ ছিলেন, বকতে মারতে পারতেন না। কিংবা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেনও হতে পারে। প্রায় মায়ের বয়সী দিদিদের বকুনি খেয়ে, একটামাত্র নাকভাঙা পুতুল কিংবা কাঠের টুকরো দিয়ে বানানো একটাই মাত্র মোটর গাড়ির মালিকানা নিয়ে প্রবল সংগ্রাম করে মায়েদের ছোটবেলা মহাসুখে কেটে যেত।

তবে দুঃখ ছাড়া সুখ তো হয়না। ইহজগতের দেবতাদের খাওয়ানো পরানো স্কুলে অফিসে পাঠানো নিয়ে দিদিমার গলা পর্যন্ত ডুবে থাকত, স্বর্গের দেবতাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়েছিল মায়েদের ছোট ছোট হাতে। জল ভরে, ফুল তুলে, চন্দন বেটে, ছোট ছোট থালায় নকুলদানা আর বাতাসা বেড়ে, তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে তাঁদের তুষ্ট রাখতে হত। রোটেশন সিস্টেমে পুজোর পালা পড়ত ভাইবোনদের ভাগে।

আমার ছোটমামা মায়ের থেকে বয়সে দুবছরের আর বুদ্ধিতে অন্তত কুড়ি বছরের বড় ছিলেন। একবার যখন তাঁর পুজোর পালা এল, মামা এসে মা’কে বললেন, “মণি, তুই যদি একটানা একমাস পুজো করিস তাহলে আকাশের দিকে তাকালেই মাকালীর মুখ দেখতে পাবি।” ভগবানের সাক্ষাৎ পাওয়ার এমন চমৎকার অফার কোনো পাগলেই পায়ে ঠেলে না, আমার মা তো কোন ছার। একমাস গেল, দু’মাস গেল, ছোটমামার পালা শেষ হয়ে, মায়ের নিজের পালা শেষ হয়ে, বাকি সব ভাইবোনদের পালা এসে চলে গেল, শেষে মা দিনের হিসেব রাখাই ছেড়ে দিলেন---তবু মাকালীর মন গলল না।

অগত্যা মা সেজদিকে গিয়ে নালিশ করলেন। ছোড়দার নামে নয়, মাকালীর নামে। তখন সবাই বেচারা মা’কে দেখেই হাতে তালি দিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসল, “হেব্বি দিয়েছিস” বলে ছোটমামার পিঠ চাপড়ে দিল। মাকালী বেমালুম পার পেয়ে গেলেন। চিরকাল যেমন পান।

মায়েদের পূজ্য দেবতাদের দলে একজোড়া তামার বিষ্ণুপাদপদ্ম ছিল। গালভরা নাম, কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে ইঞ্চিচারেক লম্বা পাতলা ফিনফিনে দুটো তামার পাত। একটা ডান পা, একটা বাঁ পা। পায়েরা সাইজে ছোট হলে কী হবে বাকি কোথাও তাদের খামতি ছিল না। নিটোল গোড়ালি, নিখুঁত দশ আঙুল।

এদেশ ওদেশ করতে গিয়েই বোধহয় বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলটা একটু চোট পেয়ে গিয়েছিল। মায়েরা সবাই পুজো করতে গিয়ে সেই আঙুলটা নিয়ে খুটুরখুটুর করে খেলা করতেন। ভক্তিভরে নম করার আগেপরে আঙুলটা ধরে এদিকওদিক নাড়তেন-চাড়তেন। অচিরেই বিষ্ণুর পা থেকে আঙুল খুলে বেরিয়ে এল। সেজমাসি যথাসম্ভব মোটা গলায় “কে করেছে?” জানতে চাইলেন। সবাই চুপ করে মেঝের দিকে চেয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন সেই একলা কড়ে আঙুলটাকে কাগজে মুড়ে পাদপদ্মের পাশে রেখে দেওয়া হল। ঠাকুরের আঙুল বলে কথা, ছুঁড়ে ফেলে তো দেওয়া যায় না।

শিবপুরের ভাড়াবাড়ি থেকে কসবায় মামাদের নতুন বাড়িতে শিফট হওয়ার সময় সেই কাগজে মোড়া আঙুলটা শেষমেষ হারিয়েই গেল। পাদপদ্ম অবশ্য এখনও আছে। মেজমামি দুবেলা সেই ন’টা আঙুলকেই ভক্তিভরে জলবাতাসা দিচ্ছেন।