দিল্লি, দার্জিলিং আর উটি



আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম দিল্লি হঠাৎ দার্জিলিং হয়ে গেছে।

শুধু আজই নয়, কালও দেখেছিলাম, পরশুও। লেপ ঠেলে বেরিয়ে, হাওয়াই চটির বদলে বরফঠাণ্ডা পাথরের মেঝেতে পা দিয়ে আঁতকে উঠে, জানালার পর্দা সরিয়ে, কাঁচভর্তি কুয়াশায় তর্জনী দিয়ে আঁক কেটে ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার বদলে কেবল পার্কের বটগাছ চোখে পড়ছে। আর কোনও তফাৎ নেই।

দিল্লিতে খেপেখেপে বেশ ক’বছর কাটিয়ে অবশেষে আমি শহরটার আবহাওয়ার একটা আন্দাজ করতে পেরেছি। ছ’মাস পাগলের মতো গরম, তিনমাস পাগলের মতো ঠাণ্ডা, আর বাকি তিনমাস বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্তের একটা জগাখিচুড়ি। ভয়ানক কনফিউসিং, কিন্তু আবার ভীষণ ভালোও। সারাদিন ধরে আমার সব প্রিয় ব্যাপারগুলো ঘটে চলেছে। সকালবেলা মুখ খুললেই গ্যালগেলিয়ে সাদা ধোঁয়া, দুপুরবেলায় কুয়াশাটুয়াশা কেটে গিয়ে মিষ্টি ঝলমলে পুজোপুজো রোদ্দুর---সেই রোদে গা সেঁকতে সেঁকতে কুড়কুড়ে খেতে যে কী মজা---সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথে কার্তিক মাসের মানানসই মনখারাপ আর জানালার ওপারে পার্কের কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ আর অমলতাসের শাখায় সারাদিনভর নির্ভেজাল বসন্ত।

কিন্তু এ রকম আবহাওয়ার খারাপ দিকটা হচ্ছে যে অফিসে যাওয়ার বদলে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে। বেশ একটা ছোট্ট হিলস্টেশন। এই ধরুন শিলং কিংবা কোডাইকানাল। প্যাঁচানো রাস্তা, রাস্তার পাশে পাইনের রেলিং। আকাশেবাতাসে সারাক্ষণই একটা বৃষ্টিবৃষ্টি ভাব। আবার মাঝেমাঝে হুড়মুড়িয়ে প্রবল বৃষ্টি। তখন দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের অখ্যাত চার্চের বারান্দায় আত্মগোপন। কোডাইকানালে হয়েছিল আমাদের এ রকম। ওই চার্চটা কোনও সাইটসিয়িং-এর পয়েন্ট লিস্টে ছিল না। সেই যে থাকে, সেভেন পয়েন্ট, নাইন পয়েন্ট? তার মধ্যে একটা সানরাইজ পয়েন্ট থাকে, যেটাই সন্ধ্যেবেলা গেলে সানসেট পয়েন্ট হয়ে যায়? বেচারা চার্চটা সে রকম একটাও পয়েন্টের গরিমা অর্জন করতে পারেনি। ভাগ্যিস। কারণ বাকি সব পয়েন্ট মিলেমিশে ধোঁয়া হয়ে গেলেও ওই চার্চটা এখনও মাথার ভেতর জ্বলজ্বল করছে।

আজ সকালে মেট্রোর লাইনের ওপর ঠাসবুনোট কুয়াশা দেখে অবশ্য যে জায়গাটার কথা সবার আগে মনে পড়েছিল সেটা শিলং-ও নয়, কোডাইকানালও নয়। সেটা হচ্ছে উটি। মাবাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। বিশেষ কিছু মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে জায়গাটা আমার একটুও ভালো লাগেনি। চারদিকে পয়েন্টে পয়েন্টে ছয়লাপ। শানবাঁধানো লেক, লেকে লালনীল বোটের ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে গেছে, কাতারেকাতারে লোক কোল্ডড্রিংকস খাচ্ছে, পালেপালে বেয়াদব বাচ্চারা দৌড়োদৌড়ি করছে। নরক গুলজার যাকে বলে।

জঘন্য।

কিন্তু আমি যে এ জীবনে আর কোনওদিন উটি যাব না তার কারণ বোটিং-ও নয়, বদমাশ বাচ্চাও নয়। তার কারণটা আমি এক্ষুনি আপনাদের বলব। বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন, আমার এই উটি-ফোবিয়া কতখানি যুক্তিসংগত।

আর পাঁচটা হিলস্টেশনের মতোই উটি পৌঁছতে হলেও দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। সে রাস্তার একপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে আর উল্টোপাশে সোজা নেমে গেছে খাদ। আর সেদিন এ সবের ওপর শাকের আঁটির মতো ছিল কুয়াশা। সামনে, পেছনে, অতলান্ত খাদের ভেতর থিকথিক করছে ঘন কুয়াশা। জানালার বাইরে তাকিয়ে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে খাদ দেখা গেলে কী হত জানি না, দেখা যে যাচ্ছিল না তাতেই আমার গলা শুকোচ্ছিল বেশি। জানার ঠেকে অজানার আতংক সবসময়েই বেশি। পড়লে কতখানি পড়ব, শুধু হাতপা ভেঙেই রক্ষা হবে নাকি সোজা পঞ্চত্বপ্রাপ্তি, সেটা আন্দাজ করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, আর মায়ের পাশে ফ্যাকাশে মুখে বসে মনে মনে ভাবছিলাম, এ যাত্রা রক্ষা কর ঠাকুর। আর সবথেকে বেশি ভয় লাগছিল এটা ভেবে যে ড্রাইভারও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, স্রেফ অভ্যেসে ওই বিরাট বাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় হঠাৎ বাসের সামনের সিট থেকে একটা গলা শোনা গেল। দেখি গাইড ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে কী সব বলতে শুরু করেছেন আর আঙুল দিয়ে বাইরে কুয়াশার দিকে নির্দেশ করছেন। কানখাড়া করে বুঝলাম, যদিও এখন দেখা যাচ্ছে না, তবুও ওই আদিগন্ত কুয়াশার মধ্যেই, ঠিক যেদিকে ওঁর তর্জনী তাক করা আছে, সেখানেই নাকি ম্যায়নে পেয়ার কিয়া-র শুটিং হয়েছিল। আরও ভালো করে বললে, “দিল দিওয়ানা” গানটার, যে গানটায় ভাগ্যশ্রী হলদে শাড়ি পড়ে লজ্জায় তরুণ সলমানের ঘাড়ে ক্ষণেক্ষণে এলিয়ে পড়ছিলেন, সেই গানটার।

তারপর যেটা হল, সেটা বর্ণনা করতে আমার, এই এত বছর পরেও বুক কাঁপছে। গাড়িশুদ্ধু লোক, “কই কই দেখি দেখি?” করে খাদের ধারের জানালার সারির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল, গাইড অনুনয় করে বলতে লাগলেন, “আহা নিজের সিটে বসুন, বাস ঝাঁকাবেন না”, কেউ পাত্তাই দিল না, দুয়েকজন উল্লাসে চিৎকার করে বললেন, “দেখেছি দেখেছি, ওই তো ঠিক ওইখানটায়, আঃ মনে নেই সিনটা?” বাকিরা দ্বিগুণ উৎসাহে “কোথায় কোথায়” বলে আরও বেশি করে জানালার ওপর ঝুঁকে পড়লেন, আর তাঁদের শরীরের ভারে স্পষ্টতই খাদের দিকে কাত হয়ে যাওয়া বাসের ভেতর বসে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি অনিবার্য মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগলাম।

উটি পৌঁছনো পর্যন্ত এ জিনিস চলতে লাগল। শুটিঙেরও অন্ত নেই, গাইডের জ্ঞানেরও অন্ত নেই, লোকের উত্তেজনারও না। বাস একএকটা করে মোড় ঘোরে, গাইড কুয়াশার মধ্যে কে জানে কীসের দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে ওঠেন, “এইবার সঙ্গম/এইবার পুকার/এইবার হ্যানা/এইবার ত্যানা” আর লোকেরা বুভুক্ষুর মতো হামলে পড়ে খাদের দিকে বাস কাত করে দেয়, আর আমার কলজে লাফ মেরে প্রায় শরীরের বাইরে চলে আসে।  

কী করে সেদিন অক্ষত দেহে বাস থেকে নেমেছিলাম জানি না। নেহাত মরা কপালে ছিল না, তাই। তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গিয়েছিল। স্পষ্ট মনে আছে উটি ট্রিপ থেকে ফেরার পরেই একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বিনুনি বাঁধতে গিয়ে মা আমার মাথার প্রথম পাকাচুলটি আবিষ্কার করে স্যাড হয়ে গিয়েছিলেন।

যে গোটাকয়েক চুল এখনও কাঁচা আছে মাথায়, সেগুলোকে আমি প্রাণে ধরে রক্ষা করতে চাই। আর সে জন্যই প্রাণ থাকতে আর উটিমুখো হচ্ছিনা। 

Comments

  1. এ লেখায় একটাই মন্তব্য হয় ভায়া, "জব্বর লিখেসো"!

    ReplyDelete
  2. কৌশিক, তিন্নি, থ্যাংক ইউ।

    ReplyDelete
  3. hah hah hah... amar ooti experience aro kharap.. college tour e ooti jawa aamar. thik modhumalai er jongoler majhe [kuasha chhilo na thik i] bus ta gelo kharap hoye. trishimanay keu nei help korar jonyo. bus bhorti oi 50-60 jon dakabuko chhatro chhatri ke kono passing tourist vehicle sthan dite parbe na. pray ghonta tinek orom boka boka bhabe jongole ghure ar sojaroor kanta collect kore beranor por obosheshe ekta truck firchhilo ooti theke, sei truck e sobai mile uthe b'lore pouchhechhilum ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলেছিলাম উটি অতি গোলমেলে জায়গা। তবে একটা স্মৃতি তো হল, কী বল সোহিনী?

      Delete
  4. Amar pishimoni south India'r kono hill station e gele khub dukkho paye ar raag o kore ki karone jano? Khali naak chepta lokjon khoje kintu dekhte paye na bole!
    Ami jekhane thaki setake puro darjeeling bola chole! Meghla weather, tar sange kuasha ar thanda to achei. Megh neme ashe naaker dogay. Charidhare pine, fir, birch gachher bhir, pyachano rasta ar akash porishkar thakle east e north bend er range, west e lake Washington er opare Olympic mountains, north e matha tule ache Mt. Baker ar or dui chyala chamunda ar south e praye half akash jure Mt. Rainier er volcanic peak! Sob borofe jhokjhok korche...

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসাধারণ রিয়া। জায়গাটাকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। খুব হিংসে করছি।

      Delete
  5. ooty gechhilam shei chhoto bela-y. maane shey oneeeeeeeeeeeeeeeeek din ager kotha. tokhon tourist-er bhiR chhilo na. lake-er chaarpashey shudhu dokan chhilo na. boating-e naamle shob miliye 5-6-tar beshi boat puro lake-e dekha jeto na. sheeeeeeei shomoyer kotha. durdanto legechhilo. tarpor ei ek bochhor agey gelam. maane ki aar bolbo? shokh kore bhalo smritigulo-ke borbaad korar moto ahammok aar amar moto duti nei :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যিই কিছু বলার নেই, সোমনাথ। ঠিক এই কারণেই আমি স্থির করেছি যে জীবনে আর যেখানেই যাই না কেন, মাইথন আর শিমুলতলায় কোনওদিন যাব না।

      Delete
  6. Replies
    1. থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।

      Delete
    2. আচ্ছা আমার আরও একটা কথা বলার আছে। আপনার ব্লগে আমি গোটাদুয়েক কমেন্ট করেছিলাম, কিছুদিন আগেকার পোস্টে। কিন্তু সেই কমেন্টগুলো দেখতে পাই না। একটু দেখবেন, ব্যাপারটা?

      Delete
    3. amito kono comment dekhini ? haire amar blog e comment mane to amar sampod, kothai galo tara? tumi ektu bolbe please chhobir blog na ankibunki? kontate? :-(

      Delete
    4. This comment has been removed by the author.

      Delete
    5. Kuntala, peyechhi, comment gulo spam e dhuke gechhilo. bhaggis bolle, ami konodin spam e kono comment jete pare bhebeo dekhini :-(.

      Delete
  7. Ei tourist er adikhyeta'r experience amaro ache... Periyar forest e haati dekhe ek porjotok dilo ceeti (keno jani na), r haati gelo paliye. ki raag j hoyechilo!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার কী মনে হয় জানো টিনা, জন্তুজানোয়ার দেখলে আমাদের মধ্যের সেই প্রাগৈতিহাসিক সত্তাটা নড়াচড়া করে ওঠে। অনেকদিন আগে তো ওদের সঙ্গেই ওঠাবসা খাওয়াদাওয়া গলাগলি করে বেড়াতাম, তাই এখনও হাতি দেখে সিটি দিই, শিম্পাঞ্জি দেখলে ঢিল ছুঁড়ি, বাঘ দেখলে গলায় মালা দিতে ইচ্ছে করে।

      Delete
  8. Bah, besh ekta chotto bhromon shere Elam.......

    ReplyDelete
  9. লেখাটা পড়ে আমার স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। তখনকার দার্জিলিং ছিল ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর। চারপাশে পাইনের জঙ্গল, তার মধ্যেকার শন্‌শন হাওয়া রাস্তায় বেরোলেই আমাদের সঙ্গে খেলা করতে ছুটে আসত। জানালা খুললেই ঝক্‌ঝকে কাঞ্চনজংঘা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন চেহারায় আমাদের অভিনন্দন জানাত। জীবন তখন কত স্বাধীন, কত ছলছলে ছিল। কিন্তু তখন দার্জিলিংকে আমার ভাল লাগত না। যেদিকে তাকাই, গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলিকে আমার জেলখানার গরাদ মনে হত।
    সে জীবনের মহিমা বুঝেছিলাম যখন সে জায়গা ছেড়ে যেতে হল। তাই কুড়ি বছর পর সুযোগ পেতেই ফিরে যেতে চাইলাম সেই দার্জিলিং-এ। কিন্তু হায়, আগে একজন তাঁর দ্বিতীয় উটিভ্রমনের যে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, আমারো তাই হয়েছিল। পাইনঢাকা জায়গার সৌন্দর্য ঢাকা পড়ে গেছে একগাদা highrise building-এর তলায়। অস্থায়ী কিন্তু রোজই বসে বাজারটার জায়গায় খুপ্‌রি খুপ্‌রি পাকা গাথনি। এখন আর কেউ হেঁটে স্টেশন থেকে যথা ইচ্ছে যায় না। রাস্তাঘাটে সরল সুন্দর নেপালি মুখগুলি দেখা না। আমার শুধু কান্না পাচ্ছিল। সেই দিনগুলির জন্য কষ্ট হচ্ছিল। আমি আর সেখানে ফিরে যেতে চাইনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরেব্বাস, আপনি দার্জিলিং-এর স্কুলে পড়েছিলেন? কী ভালো ব্যাপার। প্রথম প্যারাগ্রাফটা ভীষণ সুন্দর লিখেছেন। স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছিলাম।

      আর সত্যজিৎ রায়ের মতো বুদ্ধিমান মানুষই তো লিখে গেছেন, ছোটবেলার ভালোলাগার জায়গাগুলোয় কক্ষনও ফিরে যেতে নেই, গেলেই খারাপ লাগা, মনখারাপ। কাজেই আপনি মনখারাপ করবেন না। শুধু ভাবুন, একটা কী সুন্দর অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে আপনার সারাজীবনের মতো। কজনেরই বা হয়?

      Delete

Post a Comment