অ্যাডাপটর খুঁজতে গিয়ে
এত কিছুর গ্লোবালাইজেশন হয়ে গেল, প্লাগ পয়েন্টের কবে হবে কে জানে। ঘরে ঢোকার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে আবিষ্কার করলাম গুচ্ছের অদরকারি জিনিস ব্যাগ বোঝাই করে এনেছি, যেমন হ্যাঙ্গার, আর কিছু মস্ত জরুরি জিনিস আনিনি, যেমন অ্যাডাপটর।
বিপদটা বুঝেছেন? কম্পিউটার
আছে, নেট কনেকশন আছে, বুদ্ধি করে ল্যাপটপ ভর্তি করে চার্জ দিয়েও এনেছি, কিন্তু সে
কতক্ষণ? আট ঘণ্টা? দশ ঘণ্টা? তার মধ্যে আমাকে একটা অ্যাডাপটর জোগাড় করতে হবে।
ভেবেছিলাম ভিসা পেতেই সব
টেনশন খরচ হয়ে গিয়েছে, আরও যে বাকি ছিল কে জানত।
সেদিন অ্যাডাপটর খুঁজতে বেরোনোর শক্তি আমার ছিল না। দাঁতে দাঁত চেপে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। টিমো আরও নানারকম আবোলতাবোল জিনিসের সঙ্গে ব্যাগে পুরে একটা নোটপ্যাডও দিয়ে গিয়েছিল, ভোরভোর উঠে সেইটা খুলে বসলাম। অন্যদিন যে এম এস ওয়ার্ড খুলে অবান্তর লিখতে বসি, এক মিনিট লিখি, দু মিনিট হাঁ করে সিলিং দেখি, তিন মিনিট জল খাই, চার মিনিট ইউটিউব দেখি---ওসব বিলাসিতার দিন নয় আজ। খাতা পেনসিলে লিখব, তারপর কম্পিউটার খুলে যত জোরে পারি টাইপ করে, পাবলিশ করেই দুম করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেব। সেইটাই ছিল আমার প্ল্যান।
প্ল্যান মতই সবকিছু হল।
প্ল্যানের বাইরেও নানারকম জিনিস হল। নিজের হাতের লেখা দেখে নিজেরই ডুবে মরতে ইচ্ছে
হল, টাইপ করতে গিয়ে একগাদা ভুল হল। পাবলিশ করতে গিয়ে নানারকম ফরম্যাটিং-এর গোলমাল
হল। অন্যদিন কিন্তু হয় না। আর স্ক্রিনের নিচের ডানদিকের ছোট্ট ব্যাটারির সাদা
রং-টা পি. টি. ঊষার থেকে জোরে নিচের দিকে দৌড়ল। হার্ট অ্যাটাকটা যে হয়নি, সেইটাই
ভাগ্যের কথা।
অফিস যাওয়া ভীষণ সোজা। ট্রামে চড়। ট্রাম থেকে নেমে মাটির তলায় গিয়ে ট্রেনে চাপ। আমাদের মতো একশো কুড়ি কোটিকে জায়গা দিতে হয় না এদের, কাজেই সিট খালিই থাকে। প্রথম দু’দিন আমি সহযাত্রীদের জ্বালিয়ে খেয়েছিলাম। কোথায় নামব, কখন সেই স্টপ আসবে, আপনি কি সেই স্টপের আগেই নেমে যাবেন, অ্যাঁ কী বিপদ, আজকের মত একটু নিজের স্টপে না নেমে আমার স্টপ অব্দি চলুন দিদি আপনার দুটি পায়ে পড়ি...এইসব করেছিলাম। এখন আর করি না। এখন চুপ করে জানালার পাশে বসে শহর দেখতে দেখতে চলি। পিঠে ব্যাগ নেওয়া ছোট্ট ছেলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেলবক্স থেকে চিঠির বান্ডিল বার করছে। ঝোলা হাতে দিদিমা ছাতা ঠুকঠুকিয়ে ধীরে ধীরে চলেছেন। দোকানের সামনে চিলতে রোদ্দুরে শুয়ে মালিকের পোষা কুকুর হাই তুলছে।
অফিস থেকে ফিরে সেদিন আমার
একটাই কাজ ছিল, অ্যাডাপটর জোগাড়। সেন্ট্রাল স্টেশনটাই হচ্ছে বনের চৌরঙ্গী।
ডাউনটাউন। সেখানে দু’চারজনকে জিজ্ঞাসা করতে তারা আমাকে সোজা ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন
সেন্টার দেখিয়ে দিল। গুটিগুটি সেখানে গিয়ে দেখি মোটামুটি ফাঁকা অফিসে এক ভদ্রলোক
আর এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ছোটবেলায় মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, রাস্তা হারিয়ে গেলে
সবসময় পুলিশকে জিজ্ঞাসা করবে। হাতের কাছে পুলিশ না পেলে ওষুধের দোকান। মা বিশ্বাস
করতেন ওষুধের সঙ্গে যেহেতু সেবার একটা ডিরেক্ট সম্পর্ক আছে, ওষুধের দোকানের
লোকজনের পাজিবদমাশ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বড় হয়ে আমি নিজের জন্য নিয়ম বার করেছি,
ঝামেলায় পড়লে মা-মা দেখতে লোকজনের দ্বারস্থ হই। ঘুটঘুটে স্টেশন, দূরে একদল চ্যাংড়া
ছেলে গজল্লা করছে, আমার চোখ দ্রুত মাঝবয়সী মহিলা খুঁজতে থাকে। একজন না একজন থাকেনই
হাতের কাছে, আমি সোজা গিয়ে তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ি। এখনও পর্যন্ত একশো শতাংশ
সময় এই স্ট্র্যাটেজি কাজে দিয়েছে।
আমি ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে
গেলাম। ব্যাগের ভেতর থেকে সাপের ফণার মত পাওয়ার কর্ডের মুণ্ডু বার করে দেখাতেই
তিনি হাততালি দিয়ে “আহ্হা” বলে উঠলেন। তারপর শুনলাম তিনি নাকি গতবছর গোয়া বেড়াতে
গিয়েছিলেন, যাওয়ার আগে বুদ্ধি করে অ্যাডাপটর কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই তো সামনেই
দোকান, মোড় ঘুরেই ডানদিকে।
গোয়া কেমন লেগেছিল? দারুণ।
চান্স পেলেই আবার যাবেন।
তারপরের অংশটুকু তো
স্বপ্নের মত। দোকানে গেলাম। আবার ব্যাগের ভেতর থেকে পাওয়ার কর্ড ফণা বার করল। “আহ্,
ইন্ডিয়া” বলে দোকানের ভদ্রলোক মুহূর্তের মধ্যে অ্যাডাপটর বার করে দিলেন। থ্যাংক ইউ
ট্যাংক ইউ দিয়ে দোকান থেকে বেরোনোর সময় দেখি আরেক ছোকরা হাতে একটা ল্যাপটপ পাওয়ার
কর্ড নিয়ে ভেবলুর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি ফেরার পথে আবার ইনফরমেশন
সেন্টারে ঢুঁ মেরে বলে এসেছিলাম যে অ্যাডাপটর জোগাড় হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা খুব খুশি
হয়ে ভেরি গুড ইত্যাদি বলে তারপর মাথা টিপে ধরে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবতে লাগলেন। পাঁচ
সেকেন্ড পরে লাফিয়ে উঠে একগাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ন-ম-স্টে-এ-এ”, আমিও “নমস্তে”
বলে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।
সেদিন বিকেলে হালকা মনে আরেকবার ক্যামেরা ঘাড়ে সেন্ট্রাল স্টেশনে গিয়েছিলাম। কয়েকটা ছবি দেখাই আপনাদের দাঁড়ান।
বিঠোভেন। বনের বিখ্যাততম পুত্র।
এখানে এসে সাইকেল কেনার
ইচ্ছেটা আমার আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। এখানে নয়, দিল্লি ফিরে গিয়ে। ইকো-ফ্রেন্ডলি, হালকাফুলকা,
স্বাধীন। দিল্লিতেও বড় রাস্তার পাশে পাশে সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তা বানানো আছে,
হ্যাঁ মেনরোড জ্যাম হলে সে রাস্তা দিয়ে বি এম ডবলিউও যায় মানছি। কিন্তু আমি তো
হেলমেট পরে চালাব। যে যতই হাসুক না কেন। কাজেই কোনও চিন্তা নেই।
besh lekha!khub mojar... :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ মনস্বিতা।
Deletekhub bhalo laglo :-) ei backgrounde tor akta chobi chai
ReplyDeleteদাঁড়া, একটা ছবি তুলে দেওয়ার লোক জোগাড় করতে হবে তাহলে। আরেকটু আলাপ হোক, এখনই ছবি তুলে দাও ছবি তুলে দাও করলে ক্রেজি উওম্যান নাম পড়ে যাবে যে।
Deleteখুব সুইট লাগল লেখাটা । এই সত্যি, অ্যাডাপটর ব্যাপারটা খুব গোলমেলে । জানো কুন্তলা,আমার না ইউরোপ বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন ইউরোপ প্রচন্ড ভাবে ঘুরতে ইচ্ছে করে।
ReplyDeleteতাই তোমার এই পোষ্টগুলো খুব এনজয় করছি।
মিঠু
থ্যাংক ইউ মিঠু। আমারও লিখতে খুব ভালো লাগছে।
Deleteamar camerar bag e ekta universal adapter thake sob somoy..eksomoy amio ek rater jonnyo bhugechilam...
ReplyDeleteআমিও এবার থেকে রাখব সুমনা। আচ্ছা শিক্ষা হল।
Deleteসকাল থেকে উশ্খুশ্, একটু পরপর নেটে খোঁজ করা। উফ্, অবান্তর আসে না কেন?খানিক পর মনে পড়ল, ও, তিনি তো বিদেশে। একটু লজ্জাও হল, মেয়েটা কি আমাদের জন্য একটু ঘুমোতেও পাবে না? কাজকর্মও তো আছে। তবুও আবার, দুপুর তো এসে গেল। আজ বোধহয় ওর সময় হল না। এক পাক রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে এবার যেই খুলেছি, ওফ্ কি আনন্দ। মজাদার লেখা, ঝক্ঝকে ছবি একেবারে সেই জায়গাটাকেই আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ধন্যবাদ কুন্তলা।
ReplyDeleteআহা, আমি কেবল আপনাদের পথ চেয়ে থাকি, আপনারাও আমার পথ একটুখানি না চাইলে কি ভালো দেখায় মালবিকা? তবে ভ্রমণবৃত্তান্ত ভালো লাগছে জেনে খুশি হলাম। ডবল উৎসাহে লিখব এবার থেকে।
Deleteবাঃ, বেড়ে লিখেছেন। দিল্লি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে একটা দোকান আছে, যেখানে সব দেশের অ্যাডাপটর পাওয়া যায়। নেক্সট টাইম বেড়াতে গেলে এয়ারপোর্ট থেকেই কিনে নিয়ে যাবেন।
ReplyDeleteএখনও কি ম্যাকডোনাল্ডেই খেয়ে চলেছেন? হোটেল থেকে আপিসের রাস্তা খুঁজতে হলে গুগল ম্যাপ ভরসা করবেন, ঠকবেন না। কোন স্টেশনে নামতে হবে, সেই স্টেশনের আগের স্টেশনের কোনটা, সব খবর দেওয়া থাকে।
না না দেবাশিস, ইউরোপে এসে এক্সোটিক দোকানপাটে না খেলে যে ভদ্রসমাজে মুখ দেখানো যাবে না সে আমার বিলক্ষণ খেয়াল আছে। আজ রীতিমত রাইন নদীর ধারে বসে ব্রুস্কেটা খেয়ে লাঞ্চ সেরেছি। গুগল ম্যাপের কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এবার থেকে দেখেশুনে পথে নামব।
Deleteএটা কী ল্যাপটপ, যাতে আট-দশ ঘণ্টা চার্জ থাকে? :O
ReplyDeleteএকটু বাড়িয়ে লিখেছি আরকি।
Delete"এত কিছুর গ্লোবালাইজেশন হয়ে গেল, প্লাগ পয়েন্টের কবে হবে কে জানে" .. ekebare moner kotha bolechho. eta jato taratari hobe tato mongol.
ReplyDeleteChhobi dekhe khub bhalo laglo. tomar lekhar songe chhobi ekta bhalo prapti. :-) Sahorta ke jano ektu ektu kore chine jachhi. ki bhalo je lagchhe. asole knadhe jhola nie berie porte parlei ami bnachi, kintu seto ar chailei hoe othena. :-) .
হ্যাঁ, বেরোনোর উপায় বার করাই শক্ত ইচ্ছাডানা। এই কাজের ছুতোয় হল তাই, না হলে আমার কপালেও তিন বছরে একটি শিলং জুটেছে। দুঃখের কথা আর কী বলব।
Deleteওখানেও ত্রিফলা আলো আছে তার মানে?
ReplyDeleteহাহা, আছে আছে।
Deleteokhaneo tow didi (mane amago arek didi, angela merker didi) azchen :)
ReplyDeleteদাদাগিরির দিন শেষ শম্পা, এবার থেকে শুধু দিদিগিরি।
DeleteBonn er opera miss koro na....ekhon ki hochhe janina, tobe OperBonn e bhalo bhalo performance hoy
ReplyDeleteআচ্ছা শম্পা। আমি আজ রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে একগোছা ভাউচার মাউচার দিয়েছে। অপেরা, বোট রাইড। ভালো করে বেছে দেখতে হবে কোনটা কোনটায় যাওয়া যায়। আমি এমনি টিমোকেও লাগিয়ে রেখেছি, খবরাখবর দেওয়ার জন্য।
Deleteo hyan hyan anmeldung! bhulei gechilam :) phirbar samay abar ota cancel kore dio. na holey next trip o khub hyapa hobe!!!
ReplyDeleteওঁরাও পইপই করে সেটাই বলে দিয়েছেন শম্পা। মনে রাখব।
Deleteএটা দেখ্। http://tinyurl.com/n5qe53k
ReplyDeleteহাহা, ট্রু।
Delete