পায়ে হেঁটে বনে
হাঁটা
শুরু করার কথা ছিল দুপুর দুটোয়। সকলকে ঝেঁটিয়ে একজায়গায় করে শুরু করতে করতে
সওয়াদুটো হয়েই গেল। আমি শুরুতেই একজনকে সহকর্মীকে ধরে আমার একখানা ছবি তুলিয়ে
নিলাম, পাছে আর সুযোগ না হয়।
ছবিতে
আমার ঠিক পেছনের বাড়িটাই হচ্ছে বনের সেন্ট্রাল স্টেশন। হাওড়ার বড়ঘড়ির তলাও যা,
বনের সেন্ট্রাল স্টেশনও তা। সকালে যান, বিকেলে যান, ভরদুপুরে যান, দেখবেন গুটিকতক
লোক বিল্ডিং-এর ভেতরে ব্যাজার মুখে কারও অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
সেন্ট্রাল
স্টেশনে আমাদের অফিসের অ্যালফন্সের সঙ্গে এক বুড়োদাদু দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুনলাম উনি
আমাদের আজকের গাইড। দাদু বেশ হাসিখুশি, মিষ্টভাষী। বাকি বনবাসীর তুলনায় ইংরিজি
বলায় রীতিমত তুখোড়। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে দু’পা এগিয়ে এসে একটা বড় ফাঁকা চত্বরে
দাঁড়িয়ে দাদু আমাদের বন শহরের ইতিহাস বলতে শুরু করলেন।
আজ
থেকে অনেক অনেক বছর আগে, যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় এগারো বছর আগে, রোমান সম্রাট
অগাস্টাসের সৎছেলে কম্যান্ডার ড্রুসাস রাইন নদীর বামপার্শ্বে অবস্থিত ‘বনা’ এবং
ডানপার্শ্বে অবস্থিত ‘জেসোনিয়া’র মধ্যে একটি সেতুস্থাপনা করেছিলেন। বনের গল্পের
শুরু এই সেতু থেকেই। তারপর রোমান, ফ্রেঞ্চ, প্রাশিয়ান ইত্যাদি বহু হাত ঘুরে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর বন পশ্চিম জার্মানির রাজধানীর মর্যাদা পেল। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন
বনের কপালে সয়নি। বার্লিন দেওয়াল ভেঙে দুই জার্মানি এক হতেই রাজধানী বন থেকে সরে
গিয়ে বসল বার্লিনে।
তাতে
বনের খুব যে কিছু এসে গেছে তেমন নয়। শুনলাম বাকি জার্মানির থেকে বন শহরের গড়
বার্ষিক আয় অনেক বেশি, অভিবাসীর সংখ্যাও। বাকি জার্মানিতে যখন হু হু করে লোক কমছে,
তখন বনের বাসিন্দাদের জন্মহার এখনও মৃত্যুহারকে পেছনে ফেলে রেখেছে। তবে এগুলো সব
গাইডদাদুর মুখের কথা। আমি শুনেছি এবং অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছি। ভুল হলে ধরিয়ে
দেবেন, কেনা হয়ে থাকব।
গল্পের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা সমান তালে চলছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে পৌঁছলাম ইউনিভার্সিটির সামনে।
গল্পের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা সমান তালে চলছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এসে পৌঁছলাম ইউনিভার্সিটির সামনে।
ইউনিভার্সিটির
চেহারা দেখেই বুঝতে পারছেন, এককালে এটা ছিল রাজার বাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সে
বাড়ি গুঁড়িয়ে যায়। যুদ্ধ থামার পর পুরনো নকশা দেখে দেখে আবার সেই বাড়ি অবিকল
বানানো হয়েছে। অবশ্য শুধু বাইরেটাই আগের মত আছে, ভেতরটা নতুন যুগের চাহিদা অনুযায়ী
বদলে নেওয়া হয়েছে। সেটাই যুক্তিযুক্ত। সত্যিমিথ্যে জানি না, গাইডদাদুর কথা অনুযায়ী
এ বাড়ির দোতলাটা নাকি একটানা একটাই ঘর ছিল একসময়। সম্রাট ঘরের একপ্রান্তের সিংহাসনে
বসে থাকতেন আর ওঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীরা অন্য দরজা দিয়ে ঢুকে পুরো ঘর হেঁটে হেঁটে
পেরিয়ে তবে সম্রাটের কাছে পৌঁছতেন। অর্থাৎ ভিজিটর শত্রুই হন বা মিত্র, সম্রাটের
চোখে পড়ার প্রথম মুহূর্তে তিনি লিলিপুট। দাদু বললেন, দ্য গুড ওল্ড সাইকোলজিক্যাল
ওয়ারফেয়ার।
ভাবছি
এই ওয়ারফেয়ারে সড়গড় হব। কেমন হবে?
ইউনিভার্সিটির
মাঠ। যথারীতি কিছু ফাঁকিবাজ ছেলেমেয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পড়াশুনোর নামে রোদ পোয়াচ্ছে। পরীক্ষার
সময় যখন কেঁদে কূল পাবে না, বুঝবে মজা।
হাঁটতে
হাঁটতে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম রাইন নদীর ধারে। নদীর ধারে উঁচু তারের রেলিং দেওয়া।
রেলিং-এর পাশে কাঠের বেঞ্চ। কেউ বেঞ্চে বসল, কেউ বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে তারজালির ওপর
ডিঙি মেরে নদীর ছবি তুলল। নদীর ধারটি অতি মনোরম। গাছের ছায়ায় পাঁচের বেশি ছ’মিনিট
একা বসে থাকলেই ঘুম এসে যাবে, গ্যারান্টি।
কিন্তু
একটু যে আরাম করব তার জো নেই। তাড়া খেয়ে আবার চললাম। এবার আমাদের গন্তব্য সিটি হল।
সিটি হলের সামনে গিয়ে দেখি মেলা বসে গেছে। শনিবারের বাজার, তার ওপর ঝকঝকে রোদ্দুর
উঠেছে। শুনলাম তিনমাস পরপর একটি বিশেষ শনিবারে সিটি হলে গিয়ে বিয়ে করা যায়। কাল
সেই শনিবার ছিল। খুব নাচাগানা হচ্ছিল। আমি যে নববধূ, এ খবরটা আমার সহকর্মীরা পেয়ে
গেছে। তারা ধরে পড়ল আমি যেন অবিলম্বে অর্চিষ্মানকে আসতে লিখে দিই আর তারপর একখানা
শুভ শনিবার দেখে আবার একখানা বিয়ে করে ফেলি।
আমি
তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করে বললাম, নিশ্চয়, সেইটাই বাকি আছে।
তবে
জায়গাটায় গেলে সত্যিই শরীরমন চাঙ্গা হয়ে যায়। ছাউনি বেঁধে গান হচ্ছে, শিশুরা বেলুন
হাতে লাফাচ্ছে, অদূরে শাকসবজিফলমূলের বাজার বসেছে। দিন শেষ হয়ে আসছে দেখে দোকানিরা
মাল শস্তায় ছেড়ে দিচ্ছেন, বেজায় চেঁচামেচি হচ্ছে। আমি একটু বাজারের দিকটায় গিয়ে
ক্যামেরা নিয়ে নানারকম কায়দা করছিলাম এমন সময় দেখি বাকিরা আমাকে ফেলে রেখে হাঁটতে
লেগেছে। জঘন্য।
কোনওমতে
প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে দলের ল্যাজ ধরলাম। কোথায় যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ব্রাজিলের
অ্যানা মুখে কিছু না বলে ওপরদিকে তর্জনী তুলে দেখাল। দেখি মোড়ের মাথায় এই সাইন।
আহ্হা। বনের বিখ্যাত সন্তানের বাড়ি। সিটি হলের
একেবারে কাছেই। আমি দেখলাম, আপনারাও দেখুন।
বিঠোভেনের
জন্মদিন আর আমার জন্মদিন এত কাছাকাছি দেখে মন খুশি হয়ে গেল। বিঠোভেনের বাড়ির পাশেই
একটা ছোট চার্চ। সেটাই ছিল আমাদের সিটি ওয়াকের শেষ স্টপ।
চার্চ
থেকে বেরিয়ে গাইডদাদু হাত নেড়ে সবাইকে টা টা বলে চলে গেলেন। আর যাওয়ার আগে ফিসফিস
করে বলে গেলেন,
-মনে
রেখ, জার্মানিতে এসে কফি উইথ ক্রিম কেক না খেলে কিন্তু জার্মানিতে আসলে আসাই
হয়নি তোমার। সে তোমার পাসপোর্টে যাই লেখা থাকুক না কেন।
এর
পরে আর তো কথা চলে না। কেকের সাইজ দেখেই অক্কা পাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, এর ওপর
ক্যাপুচিনো অর্ডার করলে আর দেখতে হচ্ছিল না। তাই আমি একটু চিটিং করে কেকের সঙ্গে
চা খেলাম। আশা করছি বেশি দোষ করিনি।
ki anando ! amadero robabar bikele ektu Bonne ghora hoye gelo :-) university ki sundar dekhte !!toke fatafati lagche :-) cha o cake ...ahah!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
DeleteApnar sai lamp-post er niche daria chobi tolar obhhesta r jabena dekchi..:P chobi duto besh 'bapi amar chobi tolo' type hoyeche. :D
ReplyDeletechobi soho বন brittanto jomia hoyeche..apni tale ekhun বনবাসী, taito?
একেবারে বনবাসী সৌমেশ।
DeleteTumi Bon-e ghurcho, edike Bonnya boiche! ki brishti ki brishti! but photo gulo darun. sobuj ghash wala math dekhe abar Central Park er jonno mon kemon korlo!cake ta o durdanto!
ReplyDeleteকেকটা সত্যি জব্বর ছিল সুমনা। বম্বের তুলকালাম বৃষ্টি এনজয় করো।
DeleteThank you ,thank you. Darun chhobi ar Bonn britanto, Beethoven er barir chhobi, tomar jonye sob dekha holo.
ReplyDeleteoho bola hoeni, cha ar cake darun lobhonio, ar tar thekeo beshi lobhonio cha er Cup ta, amar abar bhalo cup er upor darun lobh .
Deleteআমারও কাপপ্রীতি আছে ইচ্ছাডানা। কাপটা দেখে তাই আমিও খুশি হয়ে গিয়েছিলাম।
Deleteওঃ! ছবিগুলো কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি। ফলের বাজার, ফুলের দোকান -- আহা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি দেখে যুগপৎ মোহিত এবং বিস্মিত। কুন্তলা, ভেবে দেখো, আমাদের এখানে হলে ভেঙ্গে গেছে তো কি হয়েছে? বাকিটা গুঁড়িয়ে ফেলো আর নিজেদের অনড্বান মস্তিষ্কের ছাপ মারা একটা কিছু খাড়া করে দাও। প্রাচীন অবয়বের এই সংরক্ষণ ও তার আড়ালে আধুনিকতার চর্চা --এটাই বোধহয় ওদের জাতি হিসাবে উন্নত করেছে। তবে মনে হয় এই পোড়া ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া সর্বত্রই এই মানসিকতা কাজ করেছে।
ReplyDeleteতুমি বেচারা কত কষ্ট করে পায়ে হেঁটে এই ছবিগুলো তুলেছো, আর আমদের খালি প্রাণারাম, প্রাণারাম। ধন্যবাদ।
আরে কষ্টের কী আছে মালবিকা, আমার তো ভালোই লাগছিল। তাছাড়া বন এতই ছোট শহর যে সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে যে কোনও দিকে মোটামুটি জোরে আধঘণ্টা হাঁটলেই সব দেখার জিনিস দেখা হয়ে যায়।
DeleteChomotkar lekha... Beethoven-er birthday to bujhlam... tomar birthday ta kobe seta janie dao... ekta mil paoa jabe mone hochce!!
ReplyDeleteবিঠোভেনের সতেরোই ডিসেম্বর আর আমার চোদ্দই। তোমার কবে?
DeleteBah... Saggi.... amar 6th...
Deleteগুড গুড।
Deleteআচ্ছা এই সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারে সাক্ষাৎপ্রার্থীর চোখেও তো সম্রাট প্রথম মুহূর্তে লিলিপুটই! তাই না?
ReplyDeleteহাহা পিয়াস, আমি এক্স্যাক্টলি এইটা ভেবেছিলাম। তারপর ভাবলাম সম্রাটদের মাথায় অত বুদ্ধি থাকলে তো চাকরিবাকরি করেই খেতে পারত, পূর্বপুরুষের টাকায় মৌরসিপাট্টা করে জীবন কাটাত না।
DeleteAha, Guide-Dadu khamoka bhul bolben keno! Oi Goebbles ityadider baad dile, German-ra sochorachor mithye bole na. Tobe ki, rajdhani Bonn theke Berlin chole jaoay oder khub dukkho hoyechhilo. Tai shohorta somporke bhalo bhalo kotha ektu beshi kore bole! :)
ReplyDeleteআরে অবান্তরের পাঠকরা তথ্য নিয়ে খুব সেনসিটিভ শীর্ষ। আমি অতটা নই। হয়তো দাদু নিজের শহরের গুণগান করতে গিয়ে সত্যের বেড়া ডিঙিয়ে ফেলেছেন, আমিও সেগুলোই পোস্টে উগরে দিয়েছি, আর কোনও পাঠক এসে আমাকে চেপে ধরেছেন। তাই আগেভাগে সাফাই গেয়ে রেখেছিলাম আরকি।
Deletebah!...Bonn ghurlam mane holo. Tomar chabi duto besh bhalo...strawberry kinle naki?
ReplyDeleteCity Hall e arekbar biye ta jai balo...kharap prastab nay!! :)
না, স্ট্রবেরি আমার পোষায় না সায়ক। বিয়ের প্রস্তাবটা তাহলে একবার অর্চিষ্মানকে দিয়েই দেখি।
Deleteবাহ্ ছবিগুলো বেশ ভালো। তা দাদুর একটি ছবি হলে হত তো।
ReplyDeleteআরে ভাবছিলাম একটা ছবি তুলি, আবির। কিন্তু যদি কিছু মনে করেন সেই ভেবে আর তুললাম না।
Deleteদারুন লাগলো আপনার বনের আপডেট। কাপটা কি সুন্দর! ওই মূর্তিটা কি ব্যাপার? ভদ্রমহিলা হাতে ল্যাম্পপোস্ট বাগিয়ে ধরেছেন কেন? ঝাঁটা হলে নাহয় বুঝতাম উড়তে চলেছেন। আপনাকে দারুন সুন্দর লাগছে। চেক-জামা আমার ভীষণ প্রিয় ছোটবেলা থেকে।
ReplyDeleteহ্যাঁ আমিও ব্যাপারটা বুঝিনি, মশালটশাল পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট সিরিয়াসলি বাড়াবাড়ি।
Delete