রেনি ডে অ্যাডভেঞ্চার
পৃথিবীতে যে ক’টা জিনিসের প্রতি আমার অসীম দুরছাই-এর ভাব রয়েছে তার মধ্যে আবহাওয়া অফিস একটা। রবীন্দ্রনাথেরও ছিল শুনেছি। একবার
শান্তিনিকেতনের রাস্তায় এক চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। চেনা লোক
রবীন্দ্রনাথকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “সে কী গুরুদেব, ছাতা নিয়ে বেরোননি! কাগজে যে
আবহাওয়া অফিস থেকে ফোরকাস্ট দিয়েছে আজ বিকেলে ঝড়বৃষ্টিবজ্রাঘাত...”
গুরুদেব মিটিমিটি হেসে বললেন, “সেই ভরসাতেই তো বেরোইনি।”
অনেক ছোটবেলায় পড়া গল্প কাজেই খুঁটিনাটিতে গোলমাল থাকতে
পারে। হয়তো চেনা লোক ছাতা ছাড়া বেরিয়েছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ ছাতা নিয়ে ইত্যাদি
ইত্যাদি। কিন্তু মূল বক্তব্যটা একই থাকে যে রবীন্দ্রনাথ আবহাওয়া অফিসকে মোটে
পাত্তা দিতেন না।
আমারও এই জায়গাটাতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভয়ানক মেলে। দেশে
যেদিন বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকে সেদিন আমি বুক ফুলিয়ে ছাতা ফেলে রেখে অটো ধরতে বেরোই।
সাহেবরাও যে একই ভুল করতে পারে এটা কেন যেন মন থেকে মানতে পারিনি। তাই প্রথম দু’দিন
বন ওয়েদার ফোরকাস্টের বাণী মাথায় করে ছাতা ব্যাগে পুরে ক্লাসে গিয়েছিলাম। ব্যাগটাই
পাথরের মত ভারি হয়ে গেল শুধু, বৃষ্টির চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। তিতিবিরক্ত হয়ে গতকাল
ছাতা খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে হালকা ব্যাগ দুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে অফিসে গেলাম।
আমাদের অফিসের আগের স্টপ পর্যন্ত ট্রেনটা থাকে উ-বান অর্থাৎ
কি না মাটির তলার ট্রেন, আর অফিসের স্টপেই সে হয়ে যায় এস-বান, অর্থাৎ কি না মাটির
ওপরের ট্রেন। অফিসের স্টপে নেমে দেখি আকাশে থরে থরে মেঘ, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে
এদিকওদিক থেকে। একবার মনে মনে “যাত্তারা” বলেছিলাম বটে কিন্তু সত্যি বলছি তার বেশি
ঘাবড়াইনি।
ক্লাসে বসে ইশ, ডু, zই নামতার মত আওড়াতে আওড়াতেই কড়কড়কড়াৎ করে বাজ পড়তে
শুরু করল। আওয়াজের চোটে পিলে চমকে যায়। দিদিমণি মিষ্টি হেসে হাত নেড়ে বললেন, “কাইন
পোহ্বলেম, কাইন পোহ্বলেম।” কিন্তু ঘণ্টাদুয়েক যেতে না যেতেই বোঝা গেল পোহ্বলেম আসলে
বিস্তর। ঘরের আলো কাঁপতে শুরু করল, প্রোজেক্টর নিবুনিবু হয়ে শেষটা নিভেই গেল। ভয়
পেয়ে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে এদিকওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ দরজা ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে
টিমো ঢুকে বলল, “লিভ দ্য বিল্ডিং, উই আর আন্ডার ওয়াটার।”
বলে কী ছোকরা?
আমরা সবে একে অপরকে পায়ে পিষে ফেলে
দরজা দিয়ে বেরোনোর জন্য রেডি হচ্ছি এমন সময় দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন ফ্রাউ
লুটেনবার্গ। আমরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই জমে গেলাম।
আমি বাজি রেখে বলতে পারি জন্মান্তর
বলে যদি কিছু থেকে থাকে আর পদিপিসি যদি সেই জন্মান্তরের খেলায় নেমে থাকেন তাহলে
এজন্মে তিনি ফ্রাউ লুটেনবার্গ হয়ে ধরায় এসেছেন। দেখলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে
যায়। গটগট করে হাঁটেন, কটমট করে তাকান। মাঝে মাঝে ক্বচিৎকদাচিৎ হাসেন বটে কিন্তু
সেটা এতই মৃদু আর দ্রুত যে ঠিক দেখলাম কি না বুঝতে বুঝতেই আবার যে কে সেই।
ফ্রাউ লুটেনবার্গ একবার সবার ওপর রক্তচক্ষু
বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “ভেবেছ কী তোমরা? জান না আমরা জার্মান? জান না যে কোনও বিপদের
জন্য আমাদের প্ল্যান বি রেডি থাকে? ক্লাস হবে না তো কী হয়েছে, ক্লাসের বদলে আমরা
আজ জার্মান মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি দেখতে যাব। আমি খবর নিয়েছি ওদের আলোপাখা সব
ঠিকঠাক চলছে।”
অগত্যা আমরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে
ফ্রাউ লুটেনবার্গের পিছনপিছন হাঁটতে শুরু করলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি প্যাঁপ্যাঁ করে
ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি চারদিকে ছুটছে। ম্যানহোলের তলা দিয়ে প্রবল গর্জনে জল ছুটে
চলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তার ওপরে এমনিতে দুর্যোগের আর কোনও চিহ্ন নেই। আমরা
টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে দল বেঁধে মিউজিয়ামের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
বন শহরের এই বিউটিটার কথা আগেও
বলেছি নিশ্চয়। যেখানে যেখানে আপনার যাওয়া দরকার, সব জায়গায় আপনি হেঁটেই পৌঁছে যেতে
পারেন। আমরাও হাঁটাই স্থির করলাম। শহরের একটা জায়গায় লাইন দিয়ে বেশিরভাগ মিউজিয়াম
বানানো হয়েছে যার ফলে জায়গাটার নামই হয়ে গেছে মিউজিয়ামশ্মাইলি, অর্থাৎ কি না মিউজিয়াম-মাইল
বা মাইল জুড়ে মিউজিয়াম। হিস্ট্রি মিউজিয়ামে দুরকমের এক্সিবিশন চলছিল, একটা দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির ইতিহাস, অন্যটা জার্মানি-অ্যামেরিকা দ্বৈত সম্পর্কের
চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আমি প্রথম প্রদর্শনীটা দেখতে
গেলাম। দেখার মত অনেককিছু ছিল, দেখলামও। কিন্তু সে গল্প এখন করছি না। পরে সুযোগ
হলে ছবিসহ আপনাদের শোনাব।
বিপদ হল বাড়ি ফেরার সময়। হপ্টবানহফে (বন সেন্ট্রাল স্টেশনে) ফিরে দেখি আমার ট্রাম যে রাস্তা দিয়ে যায় সেখানে বড় বড়
গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। চতুর্দিকে ফায়ারব্রিগেড আর পুলিশের গাড়িতে ছয়লাপ। ট্রাম
লাইন বন্ধ। তখন ভয় লাগতে শুরু করল। ট্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলে মিনিট
চল্লিশের মধ্যে বাড়ি পৌঁছব কিন্তু হাঁটতেও অ্যালাউ করছে না। অন্য কোনও রাস্তা
জানাও নেই আমার।
সহপাঠীকে ফোন করলাম। সে বলল, “ঘাবড়াও মত্, তুমি আবার মিউজিয়ামে ফেরত চলে এস।”
তাই গেলাম। তারপর মিউজিয়ামের
দ্বাররক্ষীকে জিজ্ঞাসা করে একটা অপূর্বদর্শন পাড়ার মধ্য দিয়ে কাঁটায় কাঁটায় দশ
মিনিট হেঁটেই দেখি বাড়ির কাছের সুপারমার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
বেশ একটা মিনি অ্যাডভেঞ্চার হল না? ফাউ হিসেবে নতুন রাস্তা জানা হয়ে গেল। একটা নতুন পাড়া চেনা হয়ে গেল। খুশি মনে রাস্তার পাশের বেকারি থেকে বিকেলের ‘টা’ কিনে ফিরে বেশ করে স্নান করে জানালার পর্দা সরিয়ে বন শহরের দিকে মুখ করে বসলাম। এই দেখুন আমার চা আর টা-এর ছবি।
বেশ একটা মিনি অ্যাডভেঞ্চার হল না? ফাউ হিসেবে নতুন রাস্তা জানা হয়ে গেল। একটা নতুন পাড়া চেনা হয়ে গেল। খুশি মনে রাস্তার পাশের বেকারি থেকে বিকেলের ‘টা’ কিনে ফিরে বেশ করে স্নান করে জানালার পর্দা সরিয়ে বন শহরের দিকে মুখ করে বসলাম। এই দেখুন আমার চা আর টা-এর ছবি।
Ki sundor ta-er chhobi. Narom narom paurutir mato. Dekhei khide pelo. Mein Bestes Stuck - mane holo, stuck hoye porechhile bote, kintu ato nipat jhonjhatheen escape bole akta bhalo memory hoye roilo, tai, 'my bestest stuck/mein bestes stuck' :)
ReplyDeleteহাহাহা দারুণ ব্যাখ্যা করেছ কিন্তু মনস্বিতা। আসল মানে যাই হোক না কেন, এবার থেকে দোকানটা দেখলেই আমি তোমার মানেটা মনে করব, কারণ এটাই ঠিক।
Deletedie Frau wie tee :)
ReplyDeleteআপনার ব্লগ পড়তে রুপকথার মত লাগে :))
ওরে বাবা কী ভালো কমপ্লিমেন্ট। ডাংকে কৌস্তুভ, ডাংকে।
Delete"সত্যি বলছি তার বেশি ঘাবড়াইনি।" তোমার এই কথাটা ভারি মনে ধরেছে। ঠিক ন্যাড়ার মতো ।না ভাই আমাকে আজ গান গাইতে বোলো না,সত্যি বলছি আজ গলাটা তেমন খুলবে না। যেন আমাদের দায় পড়েছে ওর গান শুনতে।তেমনি তোমার, ভয় পাবার কথা এমনিতে, কিন্তু সত্যি বলছি...।।
ReplyDeleteতবে সত্যি বলছি,ছবিটা ভাল এঁকেছ । সবটা দেখলাম বলে মনে হোল। বাই দ্য ওয়ে, দিল্লিতে এমনিতে আমি ঝটিকা সফর করি,কিন্তু এবার পুরো তিন দিনের স্টে। ভাবছিলাম তুমি থাকলে দেখা করতামই।
মিঠু
হাহা, যা বলেছ মিঠু, অনেকটা ন্যাড়ার মতই শোনাচ্ছে বটে। ইস, আমিও দেখা করতাম নির্ঘাত। এবার হল না, পরের বার নিশ্চয় হবে।
Delete'আমারও এই জায়গাটাতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভয়ানক মেলে' -- Nehat apnar dari gojay na..nale hoyto apnake e....... :P
ReplyDeleteJokes apart...ektu onno alochona hoye jabe tao dichhi...ai cinemata dekhar khub ichhe roilo...bisesh kore ai gantar jonno...parle dekhe neben...
Deletehttp://www.youtube.com/watch?v=WIyxv7TcbvY
গানটার খুব সুন্দর ব্যবহার সত্যি সৌমেশ। লিংক দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
DeletePodi pisi r german version ar tar barnona darun. Ta , ta ki Pretzel / Brezel ? Rainy day r adventure sesh porjonto besh bhaloi holo tahole. Bonn sahortake tomar lekha r jor e besh chine phelchhi.
ReplyDeleteহ্যাঁ ইচ্ছাডানা, ব্রেজেল। সত্যি আগে খাওয়া প্রেটজেলের থেকে অনেক বেশি ভালো খেতে।
Deleteজেনে সুখী হলাম যে তুই দুধ-চিনি পছন্দ করিস্ না।
ReplyDeleteচিনি তো একেবারেই পছন্দ করি না। সকালের চা-টা দুধ দিয়ে খাই অবশ্য। বাকি সারাদিন ব্ল্যাক।
Deleteআরে এ তো আমাদের নিউ ইয়র্কের প্রেট্জেল দেখছি! নিউ ইয়র্কেও একটা মিউজিয়াম মাইল আছে জানেন তো? লেখাটা বলাই বাহুল্য অনবদ্য হয়েছে। আপনার বৃষ্টি না পাওয়ার দিন তাহলে শেষ হলো। অবশ্য দিল্লিতেও এখন বন্যা হচ্ছে।
ReplyDeleteআমি লোকালয়ের থেকে দুরে সত্যিকারের বনে গেছিলাম কদিন, তাই আপনার শেষ কটা লেখা মিস করে গেছি। কাল ফিরেছি, এবার সব পড়ব এক এক করে।
খুব ঘুরছেন কাকুকাকিমার সঙ্গে? ভালো করেছেন। ছবি দেখার আশায় রইলাম।
DeletePretzel byapar ta amar abar...jagge, Abhishek tomay tui bolle amio tomay tui bolbo.
ReplyDeleteনিশ্চয়, যা প্রাণে চায় তাই বলবে। তবে আমি তোমাকে এখন নতুন করে আর দিদি-টিদি বলছি না, যেমন চলছে তেমন চলুক, ওকে?
Delete