আজ ভোরে
এই মুহূর্তে এখানে পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। চতুর্দিকে ভয়ানক ব্যস্ত কিচিরমিচির। পাখির বাচ্চাদের
আবার সারাবছরই মর্নিং স্কুল। এখন খুব হুড়োহুড়ি চলছে নিশ্চয় বাসায়। মা পাখির মেজাজ
টং হয়ে আছে। ট্যাঁফো করলেই কানমলা।
কান খাড়া করলে ভীষণ আস্তে তবলার টুং টাং শোনা যাচ্ছে। ঘরের দরজাটা ভালো করে টেনে বন্ধ
করা হয়নি বোধহয়। আমার ফ্লোরে আপাতত টেরেসা ছাড়া আর কেউ নেই। আশা করি এই আওয়াজে ওর
ঘুম ভাঙবে না।
এক্ষুনি আরেকটা শব্দ শুরু হল। ইলেকট্রিক কেটলের জল ফুটতে শুরু করেছে। প্রথমে
ধীরে, তারপর প্রবল তেজে। জলের গবগবানিতে তবলার মিহি টুংটাং ডুবে মরেছে। আমি কেটল
তুলে সাবধানে লাল কাপের ওপর কাত করি। কাপের লাল গায়ে লিপ্টনের টি ব্যাগের হলুদ রঙের
টিকি এলিয়ে পড়ে আছে। বেশ ইস্টবেংগল ইস্টবেংগল একটা ব্যাপার হয়েছে কিন্তু।
রান্নাঘরে
দাঁড়িয়ে একটু অপেক্ষা করি। যাতে ব্যবহৃত টি ব্যাগটা রান্নাঘরের বিনেই ফেলে রেখে যাওয়া
যায়। নিজের ঘরটা যত আবর্জনামুক্ত রাখা যায় ততই ভালো। ঘরের ময়লা ঝাঁট দিয়ে রাস্তায়
ফেলার আজীবনের শিক্ষা এত সহজে কি যায়?
মিনিমাম
তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। না হলে সকালের চা মাটি। বোর হয়ে গিয়ে আমি আস্তে করে
টেরাসের দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসি। ঠাণ্ডা আছে কিন্তু বেশ। তার মধ্যে পরশু
রাতে জানালা খুলে শুয়ে একটু একটু কাশি হয়েছে। কাশির সঙ্গে বুকের ভেতর ঘংঘং আওয়াজ ফ্রি।
ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সবুজ তুলোটে চাদরটা গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। ভালো করে সেটা গলার
কাছে জড়িয়ে নিই।
এত
কিচিরমিচির, অথচ দেখা যায় না একটাকেও। আগেও দেখেছি, যে পাখির সাইজ যত ছোট, তার
গলার আওয়াজ তত বেশি। পাখি দেখার আশায় ক্ষান্ত দিয়ে আমি অন্যদিকে চোখ ফেরালাম।
শহরের
ওপর খুব ধীরে ভোর নামছে। পা টিপে টিপে। যাতে কারও ঘুম না ভেঙে যায়। পোস্টটাওয়ারের
মাথাটা আবিরের মত লাল হয়ে গেছে শুধু। সব জায়গাতেই সকাল হওয়ার কায়দাটা এক, শুধু
আধারটা আলাদা। বড়মাসি যেমন বলেন। বাড়িতে সকাল প্রথমে নামে নারকেলগাছের মাথায়,
দিল্লিতে সারি সারি ডিশ অ্যাণ্টেনার চক্রব্যূহে, আর এখানে পোস্টটাওয়ারের টপ
ফ্লোরে।
টাওয়ারের
গা বেয়ে একসারি আলো সারারাত জ্বলে। বাতাসের স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপারে সেগুলো থরথর করে
কাঁপছে। সে কাঁপুনি দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল হয় তিনমিনিট হয়ে গেছে কখন। রান্নাঘরে
এসে ন্যাতানো টি ব্যাগ ফেলে দিয়ে কাপে ঠোঁট ডুবিয়েই মুখ ছ্যাতরাই। ইস্, বেশি কড়া
হয়ে গেছে। এককাপ চা-ও কেন ঠিক করে করতে পারি না ভগবান।
এনিওয়ে,
মাইন্ড ওভার ম্যাটার করা ছাড়া গতি নেই। চা উনিশবিশ কড়া হয়ে গেলে যদি সকালসকাল
মেজাজ চটকে যায় তাহলে অমন মেজাজের মুখে আগুন। চা থেকে মন তুলে নিয়ে আকাশের প্রতি
নিবদ্ধ করি। এই ক’সেকেন্ডের মধ্যেই আলো কত বেড়ে গেছে। পৃথিবীটা আসলে কত জোরে ঘুরছে
সেটা এই সময় বোঝা যায়। সন্ধ্যে নামার সময়েও। ভরদুপুরে, বিশেষ করে সেটা যদি দিল্লির
মে মাসের দুপুর হয়, সূর্য ঠিক চাঁদির ওপর অনন্তকাল থেমে থাকার অনুভূতিটা যে আসলে ইলিউশন সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
আমি
ঘরে ফিরে এসে জানালার সামনে টেবিলে ল্যাপটপ খুলে বসি। জানালার বাইরে অর্ধেকটা ঘন
সবুজ আর বাকি অর্ধেকটা ঝকঝকে নীল। এই ঘরটার আর যদি সবকিছু ভুলেও যাই, জানালাটা
আজীবন মনে থাকবে। আর একটু পরেই একটা জেট প্লেন যাবে আকাশ চিরে। রোজই যায়। নীলের
ওপর সার্জেনের দক্ষতায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা ক্ষত এঁকে দিয়ে।
আর
ঠিক তার পরেই ভোরটা ফুরিয়ে গিয়ে হইহই করে সকাল হয়ে যাবে। নরম আলোর বদলে দিকবিদিক ভাসানো
চোখ ঝলসানো রোদ্দুর। টাওয়ারের সারি দেওয়া কাঁপাকাঁপা আলোগুলো নিভে যাবে, পাখিরা
চুপ করে যাবে। সবথেকে খারাপ যেটা হবে সেটা হচ্ছে আমার ঘড়িটা হঠাৎ পিক-আপ নিয়ে
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করবে। আকাশ জুড়ে কাটাকুটি খেলে আরও শতশত জেট প্লেন যাবে
হয়তো, কিন্তু আমার তাদের দিকে তাকিয়ে দেখারও সময় থাকবে না।
এটা জাস্ট অসাধারণ হয়েছে। এই মাঝরাত্রে শুয়ে শুয়ে জার্মানি তে ভোর হওয়া দেখলাম, কড়া চায়ের স্বাদ পেলাম, এমনকি এই গরমের মধ্যে হালকা শীতের আমেজ পর্যন্ত পেলাম। সুপ্রভাত।
ReplyDeleteসুপ্রভাত সুপ্রভাত। আপনার জন্য কয়েকঘণ্টা আগেই হল, কিন্তু গ্লোবালাইজ্ড্ ওয়ার্ল্ডের এটাই হচ্ছে বিপদ। কী আর করা যাবে।
DeleteOsadharon !!!
ReplyDeleteAbantor ke ei jonyei eto bhalobasi. :-) . ektio sabdo aj ar kharoch korbona.
অবান্তরও আপনাকে ভয়ানক ভালোবাসে সেটা জানেন নিশ্চয়? থ্যাংক ইউ।
Deletebah ,khub bhalo laglo pore
ReplyDeleteধন্যবাদ ধন্যবাদ তিন্নি।
Delete:)
ReplyDeleteহাসি ফুটেছে যখন ভালো লেগেছে নিশ্চয়। থ্যাংক ইউ।
Deleteamio kal theke bhor bhor utthbo. amar sokal atto sundor hobe ki na bolte parchi na jodio.
ReplyDeleteসকাল মানেই সুন্দর মনস্বিতা। আমার তোমার যারই হোক না কেন। সকালে উঠে কেমন লাগল জানিয়ো কিন্তু।
DeleteBah, Kuntala di,ki snigdho sokal tomar. Ei je tumi bhor byala otho, ei jonoi tomar unnoti hobe dekho! Amar mone hoy e jibone aar ota holo na. Boshho je manush bhor byala ghumote jay, tar theke bhor byala otha expect kora o onyay. Tomake borong ami moddho raat er golpo sonabo konodin. Tar o onno moja!
ReplyDelete- Sumana
সুমনা, হ্যাঁ রাতের অনুরাগীরা আবার রাতকে সুন্দর বলে। আমি হোস্টেলে প্রথম প্রথম গিয়ে কিছুদিন নাইট আউলে রূপান্তরিত হয়েছিলাম, কিন্তু বেশিদিন সে অবস্থা স্থায়ী হয়নি।
Deletebesh kobitar moto hoyeche lekhata...choto choto bakkogulo line by line sajale jeno ekta kobita..besh kodin bade abar nijer jat chenalen..sabash!
ReplyDeleteশহরের ওপর খুব ধীরে ভোর নামছে। পা টিপে টিপে। যাতে কারও ঘুম না ভেঙে যায় -- ai line ta amar ai lekhar sera line legeche..
r পাখির বাচ্চাদের আবার সারাবছরই মর্নিং স্কুল -- eta besh mojar..
ধন্যবাদ সৌমেশ।
DeleteAbantor's coming of age.
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংকস।
Deleteabantor satyi coming of age....khub shundor hoyechey lekha ta. koyek maash ager frankfurt airport lounge e boshe je sunrise ta deklam setar katha mone pore gelo :)
ReplyDeleteইস, তোমার আমার খালি কয়েক মাসের জন্য দেখা হতে হতেও হয় না শম্পা। বোস হাউসে গেলে, ফ্র্যাংকফুর্টে এলে---অথচ আমার সঙ্গে দেখা হল না, কোনও মানে হয়?
Deletebhari bhalo hoyeche.
ReplyDeletemithu
ধন্যবাদ ধন্যবাদ মিঠু।
Deletesuprobhat kuntaladi, akdom literally.
ReplyDeleteসুপ্রভাত স্বাগতা, আশা করি তোমার দিন খুব ভালো কাটুক।
Deletedaruun daruuun ek kothay daruuun. ki jano, vor hote dekhar anondo tai alada. thik ekibhabe vor hote dekhi ami majhe majhei. ki je shanti ete se bojhano daay. r haan amio rate jagte parina ekdom. khuub mon bhalo kora post.
ReplyDeleteহাই ফাইভ রাখী। আমারও রাত দশটার পর মাথার সুইচ নিভে যায়। ভোর সত্যি অপূর্ব।
Delete