মণির ই-মেল



আমার ফোন আবার হারিয়ে গেছে।

আমি প্রথমটা টের পাইনি। ঘণ্টা ছয়েক পরে মনে হল, অনেকক্ষণ ফোনটা বাজেনি তো। আমার মা তো এতক্ষণ তাঁর একমাত্র সন্তানের সঙ্গে কথা না বলে থাকার লোক নন। তখন ব্যাগ ঝাড়লাম, ড্রয়ার হাঁটকালাম, বিছানা উল্টোলাম। কোত্থাও নেই।

তখন স্কাইপ খুলে কাঁদতে বসলাম।

অর্চিষ্মান বলল, আবার গেছে? বাঃ। দাঁড়াও আমি ফোন করে দেখি।

এই না বলে স্পিড ডায়াল টিপে ফোন কানে ধরে গম্ভীরমুখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

আমি চোখ মুছে নাক টেনে বললাম, তুমিও যেমন।। আমার ফোন কি আর এতক্ষণে বাজার অবস্থায় আছে? এতক্ষণে তার দোমড়ানো মোচড়ানো সিমকার্ড কোন জার্মান ট্র্যাশবিনে মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে দেখ গে যাও।

আর তক্ষুনি অর্চিষ্মান শাম্মি কাপুরের মত একখানা লাফ দিয়ে বলে উঠল, ইট্‌স্‌ রিংগিং! (সিনেমার নাম বলতে পারলে ফ্যান্টাস্টিশ্‌, না পারলেও ক্ষতি নেই।)

অ্যাঁ! সিরিয়াসলি? আমি বললাম, শিগগিরি স্পিকারে দাও, একটু শুনি!

তারপর স্কাইপের এপারে বসে বসে আমি ওপারে স্পিকার ফোনে আমার হারানো ফোনের রিংটোন শুনতে লাগলাম। ইস্‌, বেচারা ফোনটা না জানি কোথায় অবহেলায় অনাদরে একা একা পড়ে আছে। খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেক দিনই এমন হত, মা অফিস থেকে ফিরে দেখতেন সকালে স্নানের পর তিনি যে শাড়িব্লাউজ কেচে ছাদে শুকোতে দিয়ে গিয়েছিলেন সেগুলো ছাদেই পড়ে আছে। নামিয়ে আনার কথা কারও মনে নেই। তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গোল গোল করে গালে হাত দিয়ে বলতেন, ইস্‌ আমার কাপড়গুলো অন্ধকার ছাদে একা একা না জানি কত ভয়ই পাচ্ছে। চল্‌ তো সোনা, শিগগিরি ওদের নামিয়ে আনি। অমনি আমি বুক ফুলিয়ে মা’র পেছন পেছন ছাদ থেকে ভয়ার্ত শাড়ি উদ্ধার করতে যেতাম।

ঠিক তেমন করে যদি আমার ফোনটাকেও উদ্ধার করে আনতে পারতাম। সে বেচারাও নির্ঘাত বিদেশবিভুঁয়ে একা পড়ে ভয়ে কেঁপে সারা হচ্ছে।  

রিংটোন বেজে বেজে একসময় থেমে গেল। অর্চিষ্মানের ফোনের ভেতরের সেই অসহ্য মহিলা খ্যানখ্যানে গলায় জানালেন যে যার ফোন ডায়াল করা হয়েছে সে ফোন তুলছে না কাজেই যেন কিছুক্ষণ বাদে আবার ট্রাই করা হয় ইত্যাদি প্রভৃতি।

যেন এই সোজা কথাটা আমাদের না বলে দিলে আমরা বুঝতে পারতাম না। জঘন্য।

অর্চিষ্মান আমার বাড়িতে ফোন করে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে দিল আর মা’কে বলে দিল জরুরি কথা থাকলে যেন উনি আমাকে ই-মেল করে দেন। মা’র একটা ই-মেল অ্যাকাউন্ট আছে, মাঝেসাঝে আমার পাঠানো ফোটো দেখতে আর প্রতিবছর আমার জন্মদিনে একটা করে ই-কার্ড পাঠাতে সেটা কাজে লাগে। আমিও মা’কে একটা লম্বা ই-মেল করে দিলাম। মা আমি ভালো আছি, ঠাণ্ডা লাগলে সোয়েটার পরছি, বৃষ্টি হলে ছাতা নিচ্ছি, রোজ সকালে দুধ ডিমসেদ্ধ খাচ্ছি, রোজ বিকেলে ফল খাচ্ছি, রোজ রাতে ভালো করে ঘুমোচ্ছি। তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোর না। ইতি, তোমার সোনা।

দু'ঘণ্টা পরই মা'র উত্তর এসে গেল। স্নেহের সোনা, ফোন হারানোর সংবাদ পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তুমি সময়সুযোগ মত একটা নতুন ফোন নিয়ে নিয়ো। আর অফিসে জিজ্ঞাসা কোর আমাদের দেশের মতো পুলিশে ডায়েরি করতে হবে কি না। মঙ্গলময় ঈশ্বর তোমাকে রক্ষা করুন। ইতি, আশীর্বাদিকা মা।

দেখেছ, ডায়েরি-মায়েরি করার ব্যাপারটা খেয়ালই ছিল না। মা’র এত কথা খেয়াল থাকে কী করে মঙ্গলময় ঈশ্বরই জানেন। পরদিন অফিসে গিয়ে অ্যালফন্‌স্‌কে সব ঘটনা খুলে বলতে অ্যালফন্‌স্‌ বলল এ দেশে ও সব পুলিশি ঝামেলায় যাওয়ার ব্যাপার নেই। ফোন হারিয়েছে তো কী হয়েছে। দোকানে রাশি রাশি ফোন সাজানো রয়েছে। দেখেশুনে বেছে নিলেই হল।

দেখেশুনে বেছে নিলে-এ-এ-ই হল।
(এই সিনেমাটা না বলতে পারলে কিন্তু ক্ষমা নেই।)

লাঞ্চব্রেকে বসে বসে নেটে ফোনের মডেল পছন্দ করছি, এমন সময় অ্যালফন্‌স্‌ এসে দুই হাতে তালি দিয়ে বলল, কুন্তলা, আই হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল নিউজ ফর ইউ।

আমার ফোন কোলোনের বাসে পড়ে ছিল। বাস কোম্পানির লোক সেটা খুঁজে পেয়ে মাথাটাথা চুলকে শেষে অ্যালফন্‌স্‌কে ফোন করেছে। পরের ঘটনা খুবই সরল। আমার ফোন কোম্পানির জিম্মায় রাখা আছে, রবিবার আমাকে কোলোন গিয়ে সেটা উদ্ধার করে আনতে হবে।

অর্চিষ্মান সব শুনে বলল, কপাল বটে তোমার। তা বটে। আগের দিন রাইখার্ড ক্যাফের মেনুতে একটা আইসক্রিম দেখে মন আনচান করছিল, কিন্তু ততক্ষণে কেক অর্ডার করে দিয়েছি। রবিবার গিয়ে ফোন নিয়ে একেবারে আইসক্রিম খেয়ে ফিরব।

কিন্তু একটা জিনিসের জন্য একটু মনখারাপ লাগছে। মা’র ই-মেল। এই দুদিনেই ই-মেল লেখায় মা অসম্ভব উন্নতি করেছেন। স্নেহাস্পদ, আশীর্বাদক ইত্যাদি উধাও হয়েছে, ঈশ্বরও তাঁর মঙ্গলময় খেতাব ঘুচিয়েছেন। আমি মানসচক্ষে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কম্পিউটারের সামনে বসে মা’র টানটান কাঁধ ক্রমশ নরম হচ্ছে, কোঁচকান ভুরু ধীরে ধীরে মসৃণ হচ্ছে, ঠোঁটে মৃদু মৃদু হাসি ফুটছে। গতকাল আমার একটা পচা রসিকতা পড়ে হাসি পাওয়া বোঝাতে মা "হাহাহাহা" টাইপ করেছেন পর্যন্ত।

আমার ফোন ফেরৎ এলে মা আবার পুনর্মূষিক ভব হবেন, ই-মেলমুখো হবেন না। তাই ভাবছি আর ক’দিন ফোন ফেরৎ পাওয়ার খবরটা চেপে থাকি। অন্তত যদ্দিন না মা স্মাইলি দিতে শিখে যাচ্ছেন। আপনাদের কী মত?

Comments

  1. Apni mosai moha choru public achen...etobar kao phone haray!amar mote duto smily pawar asay maa k mithha kotha bolben?jania e din peye gechen...
    r ইট্‌স্‌ রিংগিং! == bheja fry

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক ঠিক সৌমেশ। ভেজা ফ্রাই-ই বটে।

      Delete
  2. chepe jao chepe jao...jotokkhon na Kakima LOL likhchen, chepe jao!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহাহা সুমনা, LOL-এর কথাটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, ওটা যেদিন মা লিখবেন সেদিন আর কিছু বলার থাকবে না।

      Delete
  3. Quiz e to sobsomoi pass korboina, ekhon galpeo quiz, na na cholbena. Eire , na na email er jonye mithya bolar dorkar ki? Mane oi osthoma hato iti gajer o dorkar ki? Amar tai mone holo ar ki.
    Lekhata je bhalo legechhe ta ki ar bolte baki rakhe, noito ei raat e dhulte dhulteo ekbar abantor e unki mari?

    ReplyDelete
    Replies
    1. Ice cream er chhobitao dio kintu. Please. :-)

      Delete
    2. মিথ্যে বলিনি ইচ্ছাডানা। মা জানেন যে আমি ফোন ফেরৎ পেয়ে যাব রবিবার। আমি এমনিই বলছিলাম আরকি, মা'র ই-মেলগুলো পড়তে এত ভালোলাগে আসলে।

      লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি। আইসক্রিমের ছবি তো নিশ্চয় দেব। ও জিনিস খাওয়ার থেকেও বেশি দেখার।

      Delete
    3. :-) ami janii , tumi parbei na ma ke onyo kichhu bolte. Ei tar prize hosabei er porer e-mail e LOL ta peye jabe. :-)

      Delete
    4. হাহা, দেখা যাক ইচ্ছাডানা।

      Delete
  4. hyan hyan ice cream er chobi chaiyy chaiyy!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওকে শম্পা, নিশ্চয় ছবি দেখাব।

      Delete
  5. ki mojar :-) kakimar to prachanda unnoti hoyehe mone hocche mail lekhay,...amar ma computerke jomer moto bhoy pay,amaro erokam kichu korte hobe mone hocche!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, চল তো আমরা কিছু একটা প্ল্যান করি।

      Delete
  6. দেখেশুনে বেছে নিলে-এ-এ-ই হল।
    গুপিগাইন বাঘাবাইন না?তাই কি?
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. Gupi-Baghar rajkumari bia korar prosongo..k kon rajkumari nebe..

      Delete
    2. একশোয় একশো। মিঠু, সৌমেশ দুজনেই।

      Delete

Post a Comment