হঠাৎ একদিন অসময়ে
অনেকদিন আগে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটা লেখা পড়েছিলাম। কোন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়? গল্পটা শুনলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
গল্পটা এক দম্পতির। স্বামী রোজ সকাল ন’টা নাগাদ খেয়ে দেয়ে অফিসে বেরিয়ে যান। স্ত্রী বাড়িতে থাকেন, রান্নাবান্না করেন, ঘরদোরের খেয়াল রাখেন, ছেলেমেয়ে মানুষ করেন। একদিন স্বামী নির্দিষ্ট সময়ে রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখেন ভিড়ে ভিড়াক্কার। মুরগির মাংসের মূল্যবৃদ্ধি বা ওই গোছেরই কিছু কারণে রেল-অবরোধ হয়েছে, ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে ওঠার লক্ষণ নেই। ভদ্রলোক মহানন্দে শিস দিতে দিতে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ির লোককে কী রকম সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে ভাবতে ভাবতে কলিং বেল টিপলেন। ভেতর থেকে স্ত্রীর তিতিবিরক্ত বাজখাঁই গলা ভেসে এল, “আবার কে জ্বালাতে এল রে বাবা এখন, ভাল্লাগে না...”
খটাস্ করে ছিটকিনি খুলে গেল। স্ত্রী স্বামীর হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে দু’সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে রইলেন, তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, “তুমি? এখন?? কেন???”
গল্পের ভদ্রলোক ভয়ানক মুষড়ে পড়েছিলেন যদিও, কিন্তু আমি মনে করি ভদ্রমহিলার কোনও দোষ নেই। আমাদের সকলেরই প্রতিটি দিনের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট লোক বা কাজের জন্য ধার্য করা আছে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, কেউ সেই ভাগের বেশি দাবি করতে এলে রাগ ধরারই কথা। হয়ত তখন স্ত্রী সবে আরাম করে চায়ের চাপ নিয়ে সারাদিনে প্রথমবার খবরের কাগজটা মেলে বসেছেন, বা কাজের লোকের মুখে আয়েস করে পাশের বাড়ির নিন্দে শুনছেন, বা সাপ্তাহিক বর্তমান দেখে দেখে নিমপাতা আর দুধের সর মিশিয়ে ফেসপ্যাক বানিয়ে মুখে মাখবেন ভাবছেন। হয়ত সারাদিনে ওটাই ওনার একমাত্র অ্যালোন-টাইম, কে বলতে পারে?
সেদিন অফিস থেকে হঠাৎ ভরদুপুরে বাড়ি ফিরে এসে গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। আগে আসব ঠিকই করে রেখেছিলাম, তাই সকাল সকাল অফিস পৌঁছে কোনওদিকে না তাকিয়ে, টি-ব্রেক না নিয়ে, একটিবারের জন্যও এদিকওদিক না তাকিয়ে একটা পড়ে থাকা কাজ শেষ করেছি। শেষ করে, অ্যাটাচ করে, সেন্ড ক্লিক করেই ছুট। কী আনন্দ যে হচ্ছিল কী বলব। দুপুরের খাঁ খাঁ মেট্রো, যাত্রী বলতে শুধু কলেজ কেটে প্রেম করতে বেরোনো জোড়া-জোড়া ছেলেমেয়ের দল। সদ্য কৈশোর-পেরোনো ঝকঝকে খুশি খুশি মুখ, দেখলেও ভালো লাগে। দুপুরের ঝকঝকে রোদটাকেও অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। রোজরোজ এমন সুন্দর রোদ ওঠে, আর আমি ব্লাইন্ডঘেরা ঘরে বসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বেলা বওয়াই, জানতেও পারিনা---ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মেট্রো থেকে নেমেই থরে থরে অটো। সকালসন্ধ্যে সে সব অটোওয়ালার পা ধরে আমি সাধি, তারাই দুপুরবেলা ছুটে ছুটে এসে আমাকে “ম্যাডাম ম্যাডাম” করছে, অবিশ্বাস্য। অটো চেপে একটার পর একটা ফাঁকা সিগন্যাল হুশ হুশ করে বাড়ির দিকে আসতে আসতে নিজের সুখ নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
কিন্তু চমক আরও বাকি ছিল। আমার পাড়াটার বাইরে একটা লোহার গেট আছে। অন্যান্য দিন যখন আমি বেরোই আর ফিরি, তখন সেটা হাট করে খোলা থাকে। যাতে পাড়ার মোটা মোটা বড়োলোকেদের, মোটা মোটা গাড়ি নিয়ে যেতেআসতে কোনও অসুবিধে না হয়। সেদিন দেখি পাল্লাদুটো টেনে বন্ধ করা, মধ্যে খালি ফুটখানেক ফাঁক। গাড়ি কেন, গাড়ির বেশিরভাগ মালিকই ওই ফাঁক দিয়ে গলবেন না।
গেটের ফাঁক গলে এদিকে এসেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। বাড়িঘর, গাছপালা সব যে যার জায়গাতেই আছে, না থাকলে ভীষণই চিন্তার কথা, কিন্তু যেটা বিলকুল বদলে গেছে সেটা হচ্ছে গোটা পাড়ার মেজাজ। শালিখ, চড়াই এত ছিল নাকি এ পাড়ায়, আগে কোনওদিন দেখিনি তো? দোতলার বারান্দা থেকে শাড়ি, লেপ, বেডকভার ঝুলছে, একতলার চিলতে দালানে ফালি রোদে চেয়ার পেতে দু-একজন প্রৌঢ়া ঢুলছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুপুরের মাছের ঝোলটা এত ভালো হয়েছিল যে বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। গেটের সামনে সামনে কাজের লোকদের জটলা, পরচর্চার অমলিন আনন্দ মাখা মুখ, পিঠময় খোলা ভেজা চুল। জটলার ভেতর থেকে দু-একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি আমার দিকে উড়ে এল। আর একটু এগিয়ে, বাড়ির একদম কাছে এসে দেখি, উল্টোদিকের যে পার্কটার ছবি মাঝে মাঝেই ছাপাই অবান্তরে, সেটায় কিছু লোক ইতিউতি ঘাসের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আর গুলমোহর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া রোদ্দুর দুলে দুলে তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে কী যে ভালো লেগেছিল আমার সেদিন দুপুরটা। হঠাৎ একদিন দেখেছি বলেই হয়ত ঘোর লেগে গেছে, রোজ দেখলে আর ভালো লাগত না। কিন্তু ভালোলাগার জিনিস আজকাল ভয়ানক বিরল হয়ে গেছে কিনা, তাই আমি সেদিনের দুপুরটার গল্প আপনাদের বিস্তারে শুনিয়ে রাখলাম। ভুলে যাওয়ার আগেই।
ekdin bikeler alo makha flat take ki chamatkar lagchhilo osomoye office theke phire.Are eta eto sundor dekhte! Apnar hathat bhalo laga ta besh bujhlum.
ReplyDeleteসেটাই তো। চেনা জিনিসকে অচেনা সময়ে, অচেনা আলোয় দেখলে, বা চেনা সময়ে অচেনা আলোয়, বা আরও যতরকম পারমুটেশন কম্বিনেশন হতে পারে, সবেতেই---মাঝে মাঝে চমকে যেতে হয়। ভাগ্যিস। না হলে সব কী ভয়ানক বোরিং হয়ে যেত ভাবুন তো।
Deleteসুন্দর লেখা ..যেন ছবি পোরলাম ..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সৌমেশ।
Deletedarun laglo. sotti jeno ekta chhobi. :-).
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।
DeleteAmar o oshomoy(mane never later but earlier) bari firte bhishon bhalo lage. Choto theke tai bodhoy summer e du mash morning school byapar tao khub bhalo lagto.
ReplyDeleteJah aaj bhabchi half-day niye kete pori
হাহা বং মম, অসময়ে মানে কখনওই লেট করা নয়, ঠিক বলেছেন। আমাদের অবশ্য মর্নিং স্কুল দু মাস হত না, গরমের ছুটি পরার দিন হত। কেন কে জানে, অদ্ভুত। আর তেইশে জানুয়ারি, পনেরোই অগস্টও সক্কাল সক্কাল স্কুলে যেতে খুব মজা লাগত।
DeleteAmar eka eka bari thakte moter opor ok types lagey. Tobe ajkal ar "eka" thaka hochhe kothay? Kal amar chhuti chilo, Arnab er chhilo na. Tai amio kal chhele-meye manush kore, tader khaiye-daiye, redhe-bere, dupure cinema dekhe, ekta golper boi porte porte ektu shulam.
ReplyDeleteBikel e abar tader khaoano, hatano, jhogra thamano, etc korte korte Arnab eshe gelo. Tokhon "darao, baba ashuk" boley jegulo tule rakha chilo segulo Arnab je bollam. Chhoto meyer hachi hoyeche, or jonye doctor appt niyechi, chhele ta saradin meye ke bhoy dekhiyeche, boro meye ta porashuno na kore sara dupur bhosh bhosh kore ghumiyeche, eisob ar ki :)
বাঃ রিয়া, তোমার তো ট্রেনিং হয়ে যাচ্ছে, মানুষ বাচ্চা যখন হবে তখন তাদের সামলানো একেবারে বাঁয়ে হাত কা খেল হয়ে যাবে।
DeleteTa mondo boloni, tobe jano to manush der i ekmatro "manush" korte hoy. Baki ra oti bhodro hoyei ashe :)
DeleteSanjib chattopadhyay er nam niye lekho shuru korecho.....kothai jeno tomar Lekhar modheye shei " mapa hashi chapa kannar" resh pelam. Khub bhalo laglo...
ReplyDeleteমন ভালো করে দিলে রণিতা। থ্যাংক ইউ।
Deleteখুব ভাল লাগলো...
ReplyDeleteআরে সুনন্দ যে, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
Deletebah kuntaladi zio zio....r koto mugdho korbe amader.amio tomar sathe share korte chai je proti maser besh kichudin amar o erom 'ekla ghor amar desh' baparta ghote.oi kodin ami jano puropuri amar.nijer moto khawa, ghor gochano, tv dekha, baranday dariye samner park er bachhader dekha esob chole..r seta ami besh upovog o kori.sobkichu sundor lage sotti, jeta bakidin gulo samne thakleo dekhte paina......
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ রাখী। হঠাৎ করে একা থাকতে পারার সুখই আলাদা, বল? যে না জেনেছে, ঠকেছে।
Delete