উফ্‌ কী শীত


একটা গোটা শহর শীতের আক্রমণে কাবু হয়ে পড়লে কেমন দেখায়, সেটা বুঝতে গেলে এই মুহূর্তে দিল্লিতে আসতে হবে। সকালে কুয়াশা ছিঁড়ে আলো ফুটতে ফুটতে হেসেখেলে ন’টা, ওদিকে ছ’টা বাজতে না বাজতে নিকষ অন্ধকার। ঝলমলে রাজপথের পাশে একটু দূরে দুরেই কাঠকুটো জড়ো করে জ্বালানো টেম্পোরারি আগুনের শিখার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে গুটিসুটি মারা তিনচারটে মাথা। অফিস থেকে ফিরে বিছানায় গা ঠেকালে মনে হচ্ছে বেডকভারটা বরফজলে চুবিয়ে তুলেছে কেউ। লেপের ভাঁজ খুললে ভেতর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া ফোঁস করে ছোবল মারছে। কল খুলে হাত জলের তলায় ধরলে মনে হচ্ছে আঙুলগুলো খুলে পড়েই গেল বুঝি। পর্দা টেনে, ঘরের সমস্ত ফাঁকফোঁকর বন্ধ করে ব্লোয়ার চালিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার কথা কল্পনাই করা যাচ্ছে না।

আমার রান্নাঘরে হিটিং-এর ব্যবস্থা নেই, তাই সেটা সন্ধ্যে সাতটার পর থেকে আউট অফ বাউন্ডস। আপাতত আমাদের ডিনারের সমস্ত দায়িত্ব হাসিমুখে ঘাড়ে নিয়েছে গোল্ডেন চপস্টিকস। সস্তা, প্রচুর, চরম অপুষ্টিকর। চুলোয় যাক পুষ্টি। বরফজলে বাসন মেজে নিউমোনিয়ায় মারা পড়লে পুষ্টি কোন কম্মে লাগবে? সাতটা বাজতে না বাজতে ফোন লাগাই। “হ্যালো ভাইসাব, অমুক ব্লক কা তমুক নম্বরমে ডেলিভারি...” বাকিটা ওদিক থেকে শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যায়, “চিকেন চিলি গারলিক নুডলস ম্যাডাম? লেফট কা ডোর? নো প্রবলেম, হাফ অ্যান আওয়ার মে চলা যায়েগা।”

কথার দাম আছে বটে এদের। কুড়ি মিনিট যেতে না যেতে আমার পিলে-চমকানো কলিং বেলটা আর্তনাদ করে ওঠে। “এক মিনিট, এক মিনিট ভাইসাব” বলে ছুটে ছুটে দরজা খুলতে যাই। ছুটি যত না আনন্দে, তার থেকেও বেশি শীতের চোটে। শেষ কবে বাড়ির ভেতর স্বাভাবিক গতিবেগে হেঁটেছি, সত্যি মনে পড়ছে না। টাকা চুকিয়ে আবার ছুটে ছুটে ঝোলাব্যাগ আর একগাল হাসি নিয়ে ফেরত আসি। হাসি, কারণ জানি ঝোলাব্যাগের মধ্যে আছে বেড়াল ডিঙোতে না পারা পরিমাণের, ধোঁয়া ওঠা, গরমগরম, দুর্দান্ত খেতে চাউমিন, প্রচুর চিকেন আর ডিম আর গাজর আর বাঁধাকপি আর ক্যাপসিকাম দেওয়া। আর সঙ্গে আছে ঝাল চাটনি আর মিষ্টি সসের ছোট্ট ছোট্ট পলিথিনের প্যাকেট।

বাঁধাকপির শেষ পাতাটুকুও চেঁছেপুঁছে নিঃশেষ করার পর শরীরে যে প্রতিক্রিয়াটা হয়, সেটাকেই বোধহয় কার্ব কোমা বলে। সারা দেহের সমস্ত এনার্জি পাকস্থলির দিকে দৌড় মারে, হাতপাগুলো এলিয়ে এলিয়ে পড়ে, যেটুকু শক্তি বাকি থাকে সেগুলোকে ঠেলেঠুলে আঙুলের ডগায় পাঠিয়ে দিই, যাতে অন্তত রিমোটের বোতামগুলো টেপাটিপি করা যায়।

এই করে দিন কাটছে। অফিস থেকে বেরোনোর সময় মনে হয় ঘুমোতে এখনও কত দেরি, বাড়ি গিয়ে এখনও কত কিছু করার সময় আছে। কত পেপার লেখা যাবে, কত পোস্টের আইডিয়া নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে, কোথায় কী।

এত সব খারাপের মধ্যে একটা অবশ্য ভালো ব্যাপার হয়েছে। একজন কমন শত্রু পেলে যেটা হয়, শহরের মানুষজনের মধ্যে একটা অব্যক্ত বোঝাপড়া, সৌহার্দ্যের ভাব তৈরি হয়েছে। সকলেরই মুখ খুললে গলগলিয়ে সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সকলেরই সকালে উঠতে কান্না পাচ্ছে, সকলকেই টুপি পরে সমান বদখত দেখতে লাগছে। প্রকৃতির সাম্যবাদ। অটোওয়ালাদের মিটার অবশ্য এখনও চলছে না, কিন্তু মেজাজটা অনেক নরম হয়ে এসেছে। শুধু অটোওয়ালাদেরই না, সবারই। সেদিনডাঁশা দেখে একখানা পেয়ারা  দরাদরি করে পাঁচ টাকায় রফা করেছিলাম, এদিকে পার্স হাতড়ে দেখি খুচরো আছে মোটে চার টাকা। আমার বেচারা অবস্থা দেখে পেয়ারাওয়ালাটা উদাস মুখ করে বলল, “ঠিক হ্যায় ম্যাডাম, চার হি সহি...ইতনি সর্দি...”

এই ঘটনাটা মে জুন মাসে যদি একটিবারও ঘটে তাহলে আমি কাঁচা মুলো চিবিয়ে খেতে রাজি আছি।

দিনরাত বলছি বটে শীতটা এবার গেলে বাঁচি, কিন্তু জানি শীতের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির এই ফিলগুড ব্যাপারটাও চলে যাবে, আর তখন সত্যি বলছি আমার বেশ একটুখানি দুঃখও হবে।

Comments

  1. :))) darun.. বেড়াল ডিঙোতে না পারা r tulonata fatafati...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. 2007-e Delhi r thanday tindin chhilam. Uff kothay lage tar kachhe ekhankar -20F. Delhir thanda ta hochhe haar kanpano sheet-er perfect udahoron.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক কিনা বল রুচিরা? সাধে কি অমৃতা অরোরা নেচে নেচে দিল্লি কি সর্দি নিয়ে গান গেয়েছেন?

      Delete
  3. kolkata-teo jnakie siit, tobe ta delhi r oi 3,4 er kachhe kichhu noi, tobu ei kolkata nibasir kachhe seo je ki marattok,charidike ekhaneo monkey tupi-ra dapie berachhe. tomar moton ekebare eirakom na holeo amar haal-o khanik eki prai. hat gutie bose thakte ichha korchhe, ar kebol garom dhnoa otha soup ba coffee.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ মা বলছিল খুব শীত পড়েছে। সোয়েটারের ওপর শাল পরতে হচ্ছে। যা ইচ্ছে করছে তাই করুন ইচ্ছাডানা। হাত গুটিয়ে বসে লোকজনকে অর্ডার করুন। গরম তো এল বলে।

      Delete
  4. gorom e office hobe shimla'y aar sheetkale office move kore jabe pondicherry te (sahib der moto summer-winter capital) emon ekti chakri jodi paoya jeto aha!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক ঠিক। আমার পন্ডিচেরি যাওয়ার খুব শখ জান, দেখি যাব সময় করে।

      Delete
    2. arre daroon jayga pondicherry...jao ghure esho. renzezvous cafe ta try koro (in addition to aurobindo ashram)...anek bhalo bhalo veggie restaurant o achey!!

      Delete
    3. টু গো লিস্টে লিখে নিলাম শম্পা। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. Tarpaye tarsaye re, sari raat jagaye re. Pyar teraaaaa...Dilli ki sardi. :D

    Ami duto lep gaaye diye shuchchi, Kuntala di. DUTO. Amar apisher cab ashey sokal 7:15tar modhye. Mairi bolchhi, roj sokkale alarm ta bajlei praanponey pon kori seidin-i chakri chhere diye Kolkata chole jabo. :(

    Oto sokale snaan-o korte pari na. Tai bari phire eshe sondhyebela snaan kori. Sey arek dokkhojogyo. :(

    p.s. Mojao lagchhe kintu. Tobey sobai ghan ghan korchhe toh,tai amio korchhi. :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাঁ! সকাল সোয়া সাতটা! প্রতিভা তো তোমার বিম্ববতী, তখন তো আলোও ফোটে না। ইস খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়।

      Delete

Post a Comment