একটা অদ্ভুত বিকেলের গল্প



কাল শেষবেলায় অফিসে একটা মিটিং ছিল। ডিরেক্টরের ডাকা ঝটিতি মিটিং, তাই ইটিং-এর তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিল না। শুধু চা আর বিস্কুট। না একটা সামোসা না একটুকরো পেস্ট্রি। জঘন্য। মিটিং শেষ করে বেরোতে বেরোতে অফিস ছুটি হয়ে গেল, আর আমিও অটো চেপে বাড়ি চলে এলাম।

রাস্তায় দু’জায়গায় বীভৎস জ্যাম হয়েছিল। এক জায়গায় একটা বিশাল বাস ঠিক রাস্তার মাঝখানে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আরেক জায়গায় একটা উদাসীন ষাঁড়কে ঘিরে গোটা পাঁচেক গরু ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। চারদিক থেকে হর্ন, “আব্বে হট্‌” চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু গরুগুলো পাত্তাই দিচ্ছিল না। শেষে কোথা থেকে একজন ট্র্যাফিক পুলিশ হইহই করে লাঠি উঁচিয়ে এসে ঠেলেঠুলে তাদের ইঞ্চি দেড়েক সরিয়ে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা করে দিল। ঠেলা খেয়ে একটা গরু সামান্য ল্যাজ আন্দোলিত করায় সেটা অটোর জানালা গলে আমার গায়েই এসে লাগছিল প্রায়। আমি তাতে প্রাণভয়ে “ভাইয়া-আ-আ-আ-আ” বলে চেঁচিয়ে অটোওয়ালার কাঁধ খামচে ধরায় অটোওয়ালাটা দাঁত বার করে গা-জ্বালানি হাসি হেসে বলল, “আরে ম্যাডাম, কুছ নেহি করেগা, আপ আরামসে বৈঠিয়ে।”

আমি সাধারণত অফিসের ব্যাগে একটা গল্পের বই পুরে রাখি। যাতায়াতের পথে সুযোগ পেলে পড়ি। তাতে অনেক সুবিধে হয়। একই রাস্তা দেখতে দেখতে বোরড হতে হয় না, মাথাটা ফাঁকা থাকে, বই পড়া হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে দু-একটা অসুবিধেও যে হয় না তা নয়। সেগুলোর বেশিরভাগই হয় মুলচন্দ ব্রিজের নিচের সিগন্যালটায়। ওই মোড়ে পাঁচদিক থেকে পাঁচটা রাস্তার পাঁচরকম ট্র্যাফিক কনভার্জ করে, কাজেই একবার বাতি লাল হলে, মিনিট দশেকের আগে সবুজ হয় না। আর সেই সুযোগে চারদিক থেকে একগাদা হকার, ভিখিরি, পাগল, মাতাল এসে উপদ্রব করে। হাতে একখানা বই খোলা থাকলে তাদের ইগনোর করাও অনেক সোজা হয়।

কিন্তু বই-হকাররা ভয়ানক উৎসাহিত হয়ে পড়ে। দলে দলে এসে, “ম্যাডাম কসমো হ্যায়, ফেমিনা হ্যায়” বলে জ্বালিয়ে মারে। যত জোরেই মাথা নাড়ো না কেন, দমে না। কালকেও এই সবই হচ্ছিল। আমি যন্ত্রবৎ মাথা নেড়ে “নেহি, নেহি” বলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন অতি-চালাক দেখতে হকার একখানা ছোটমতো বই বার করে আমার নাকের সামনে নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগল, “সিরিয়াস বুক ভি হ্যায় ম্যাডাম, ইয়ে দেখিয়ে চেতন ভগত, বহোৎ আচ্ছা, পঢ়কে দেখিয়ে...”

আমি হাসব না কাঁদব ভাবতে ভাবতেই সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল আর আমিও পালিয়ে বাঁচলাম।

এই রকম নানা ঘটনায় মেজাজটা একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে সারাতেই আমি বাজারে নেমে সোজা ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে বললাম, “এইও, ফুচকা বানাও।” ফুচকাওয়ালা নোংরা হাতে চটকে চটকে আলুভাতে মাখতে লাগল, আমি ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তখনই একটা অত্যন্ত ভালোমানুষ দেখতে মেয়ে, এই একুশ বাইশ বছর বয়স হবে, গুটি গুটি পায়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। এমনিতে এইসব পরিস্থিতিতে, আমি মুখে একটা হালকা নন-কমিটাল হাসিহাসি ভাব ফুটিয়ে রাখি; “আপনি ওয়েদার নিয়ে কথা বলতে চাইলে আমার আপত্তি নেই” টাইপস। কিন্তু কালকে সে রাস্তায় গেলাম না। বরং ভুরুটা আরেকটু বেশি কোঁচকালাম, যাতে “কী ঠাণ্ডা পড়েছে দেখেছেন” গোছের মন্তব্য এড়ানো যায়।

“এক্সকিউজ মি, ইজ হি নাইস?”

হঠাৎ একটা মিহি গলায় প্রশ্ন এল। আমি চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় দেখি ভালোমানুষ মেয়েটি তার গোল চোখ আরও গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আগেও বহুবার ঘটেছে দেখেছি, ঘাবড়ে গিয়ে আমার গলা দিয়ে ইংরিজির বদলে বাংলা বেরিয়েছে। মানে আমি মাথার ভেতর ইংরিজিতেই কথা বলছি, কিন্তু মুখ থেকে যেটা বেরোচ্ছে সেটা বিশুদ্ধ বাংলা। এ ক্ষেত্রেও তাই হল, মেয়েটার সফিস্টিকেটেড “এক্সকিউজ মি” উত্তরে আমার মুখ থেকে “অ্যাঁ?” ছাড়া কিছু বেরোল না।

মেয়েটি আমার বাঙালপনা গায়ে না মেখে চোখ নাচিয়ে ফুচকাওয়ালাটার দিকে ইঙ্গিত করে আবার বলল, “আই মিন, ইজ হি নাইস?”

আমি কী করে জানব বলুন দেখি? ফুচকাওয়ালার সঙ্গে আমার পরিচয়ের দৌড় ওই দশ মিনিটের। সে গম্ভীর মুখে আমার হাতে ধরা কাগজের প্লেটে কলেরার বীজাণু তুলে দেয়, আমি সেটা মহানন্দে তুলে মুখে পুরি। মাঝেসাঝে, “আরেকটু ঝাল দিন বা নুন দিন” বা ওই গোছের কিছু বলি। খান আষ্টেক ফুচকা খাওয়া হলে সে ব্যাজার মুখে জানতে চায়, “আর দেব?” আমি মুখের ভেতর প্রকাণ্ড ফুচকা আর একগঙ্গা তেঁতুলজল সামলাতে সামলাতে কোনওমতে মাথা নেড়ে না বলি। তারপর প্লেট ডাস্টবিনে ফেলে ফুচকার বাক্সের মাথায় রাখা ন্যাপকিনের প্যাকেট থেকে একটা ন্যাপকিন টেনে বার করে মুখ মুছে, হাত মুছে, ব্যাগ থেকে কুড়ি টাকা বার করতে করতে বলি, “একটা শুকনো দেবেন, প্লিজ।” লোকটা একহাতে আমার হাতে একটা জল ছাড়া, আলুভাতে ভরা ফুচকা তুলে দিয়ে আরেকহাতে টাকাটা ছিনিয়ে নেয়।

ব্যস। হয়ে গেল আমার ফুচকাওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক।

এখন সে নাইস না রুড, সে আমি কী করে বলব বলুন দেখি। আমি আমতা আমতা করছি দেখে মেয়েটি দয়াপরবশ হয়ে আরেকটু খেলিয়ে প্রশ্নটা করল।

“আই মিন, ইজ হি দ্য বেস্ট ইন দ্য মার্কেট?”

অ। তাই বল। এতক্ষণে আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। লোকাল পাবলিক নয়। মোস্ট প্রব্যাবলি নর্থ ক্যাম্পাসের কোনও হোস্টেলে থাকে। লোকমুখে শুনে দিল্লির বেস্ট কলকাতা-স্টাইল ফুচকা খুঁজতে বেরিয়েছে। পাছে তীরে এসে তরী ডোবে, তাই ভেরিফাই করে নিচ্ছে, এ পাড়ায় এর থেকেও ভালো ফুচকা পাওয়া যায় কিনা।  

আমি বললাম, “আই অলওয়েজ হ্যাভ ফুচকা ফ্রম হিম...”

মেয়েটা বোধহয় আমাকে সমমনস্ক ফুচকা-পৃষ্ঠপোষক বলে চিনতে পেরেছিল, একগাল হেসে ফুচকাওয়ালাকে প্লেট দিতে বলল। আমি ক্রমেই মেয়েটার প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠছিলাম। ফুচকা নিয়ে মেয়েটার সিরিয়াসনেস দেখে মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছিল। আমার ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি ন্যাপকিন নিতে নিতে, টাকা দিতে দিতে আড়চোখে মেয়েটাকে দেখছিলাম। ফুচকাওয়ালার ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে আলুসেদ্ধর তালের ওপর ফুচকাওয়ালার হাতের মুভমেন্ট লক্ষ্য করছে, ফুচকাওয়ালা বিটনুন মেশাচ্ছে, লঙ্কাকুচি মেশাচ্ছে, আঁজলা করে তেঁতুলজল নিয়ে ছেটাচ্ছে, সব মেয়েটা চোখ দিয়ে বুভুক্ষুর মতো গিলছে।

ফুচকার প্রতি সত্যিকারের প্রেম না থাকলে, এ জিনিস হয় না।

আমি বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ব্যাগ থেকে ফোন বার করে মায়ের নম্বরটা ডায়াল করলাম। “হ্যালো, মা? হ্যাঁ আমি বাড়ি এসে গেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়িতে দুধ আছে। ওকে, রাখছি তবে? হ্যাঁ, বাই।”

মনের ভেতর কিছুক্ষণ আগের বিরক্তিটার আর ছিটেফোঁটাও টের পাচ্ছিলাম না।

Comments

  1. Replies
    1. তোমার এই লেখাটা খুব ভালো হয়েছিল।

      Delete
  2. ei lekhata porar por thekei phuchka khete ichhe korchhe!

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার তো দেশে আসার আগে ফুচকা খাওয়া হবে না রুচিরা। স্যাড।

      Delete
  3. এসব সাবজেক্টিভ প্রশ্ন ভীষণ গোলমেলে মশাই। আপনি বললেন সে বেস্ট ইন দ্য মার্কেট, আর ওদিকে সে মেয়েটির একটু বেশি টক কি কম ঝাল লেগে গেল, তখন সে ভাববে দূর, এর কোনো টেস্ট নেই। আপনি হয়ত আমায় সিনিক্যাল বলবেন, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তবে এখনো রাস্তার ফুচকা নিয়ে এত সিরিয়াসনেস অলা মানুষ আছে জেনে ভালো লাগলো। আমার ধারণা ছিল নতুন জেনারেশন টা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, শুধু "হাইজিনিক" জায়গায় খায়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও সেটা দেখেই খুশি সুগত।

      Delete
  4. Ei phuchkawalar chobi chai. Ar meye ta bodhoy food blogger, hamle pore dekche koto tea spoon "nail dirt" ar ko khana lonka lagbe to get the perfect taste

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা বং মম, যা বলেছেন।

      Delete
  5. fuchkawala alu te ki ki mesache seta khub monojog diye dekha ta obhyes amar...r 2-1 bar jekhane kheyechi sekhane abar beshi pirit kore demand kori bhalo kore haat ta dhuye din...prothombar er tate bhoyer chote kichu bolina...fuchkawala ke chotiye kaj nei..jiv r pet to sunbena..rege mege ki je bodla nebe amar opor ke jane...

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাঁ! ফুচকাওয়ালাকে হাত ধুতে বলা! এর থেকে ব্লাসফেমাস কিছু আমি আর জীবনে শুনিনি, সত্যি বলছি রাখী। তোমার সাহস দেখে আমি মুগ্ধ।

      Delete

Post a Comment