সস্তায় সর্দি সারাতে হলে


মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। আমি ভেবে রেখেছিলাম যে নতুন বছরে খুবসে বাঙালি রান্নাবান্না করব, আর যদি দু-একটা রান্না পাতে দেওয়ার মতো হয় তাহলে সে সব অবান্তরেও ছাপাব, কিন্তু হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, দিল্লিতে চুয়াল্লিশ বছরের মধ্যে সেরা শীত পড়ে গেল। রেকর্ড ব্রেকিং শীত বলে কথা, একটুআধটু সর্দি কাশি না হলে ভালো দেখায় না। কাজেই আমার বাড়িতে এখন কান পাতলে শুধু নাকটানা আর গলাখাঁকারি আর মাঝে মাঝে “মাগো, বাবাগো” আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মা বলছেন, দোষ নাকি আমারই, আমিই নির্ঘাত সকালে অটোতে যাওয়ার সময় ভালো করে নাককান ঢেকে মাফলার প্যাঁচাইনি। আমি আর ঝগড়াঝাঁটিতে না গিয়ে বললাম, “আচ্ছা আচ্ছা, সে না হয় মানছি আমার নাম নন্দ ঘোষ, কিন্তু এখন উপায়টা কী করা যায় বল।”

মা হড়হড়িয়ে একগাদা বলে গেলেন---গার্গল, সেটজিন, আদা দিয়ে চা, উলের মোজা, বউটুপি, গরম জল, মায়ের কথা শোনা, হ্যানাত্যানা। আমার, সত্যি বলছি, একটা উপদেশও পছন্দ হল না।

ঠিক করলাম নিজের চিকিৎসা নিজেই করব। নো সেটজিন, নো বউটুপি, নো গার্গল। নেচারোপ্যাথি। লোকাল বাংলা বইয়ের দোকানে একটা বই দেখেছিলাম, ‘কোন অসুখে কী খাবেন’। কেন সময় থাকতে কিনিনি ভেবে আফসোস হতে লাগল।

তখনই রসমের কথাটা মাথায় এল। সাউথ ইন্ডিয়ান দোকানে গেলে আমি নিজে সবসময় দোসা নিই ঠিকই, কিন্তু আমার সঙ্গের লোককে কায়দা করে থালি নেওয়াই, যাতে তার রসমে ভাগ বসানো যায়। গরম গরম, ঝাল ঝাল, টক টক, খেলেই ভেতরটা কী রকম পরিষ্কার হয়ে গেল মনে হয়।  

তবে রসম রান্নার অনেক ঝামেলা আছে। রসমের প্রধান উপকরণ হল গিয়ে সেদ্ধ করা তুর ডালের জল, আর তুর ডাল আমি জীবনে চোখে দেখিনি। আর এখন দৌড়ে গিয়ে রসম রান্নার জন্য কেজিখানেক তুর ডাল কিনে আনব, তারপর প্যাকেটটা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে, ছ’মাস পরে যখন বেরোবে তখন ডালের ভেতর ভীষণ ছোট ছোট কালো কালো পোকা ঘোরাঘুরি করবে...ভয়াবহ।

কাজেই আমি তুর ডাল ছাড়াই রসম রাঁধব ঠিক করলাম। আর কারিপাতা ছাড়াও। তবে রিষড়ার বাড়িতে কারিপাতার গাছ আছে, পরের বার গেলে একটা ডাল ভেঙে নিয়ে আসব। শুনেছি কারিপাতা ফ্রিজারে রেখে দিলে বহুদিন থাকে, নষ্ট হয় না।

রান্না হল, খাওয়া হল। আরাম যা হল, সে স্বর্গসুখের থেকে খুব কম নয়। রেসিপি রইল, আপনারা ট্রাই করে দেখতে পারেন।  

চার কফি-মাগ পরিমাণ ফাঁকিবাজি রসম রান্নার জন্য লাগবেঃ

একটুখানি তেঁতুল, এই ধরুন একটা ছোট পাতিলেবুর মাপের। সেটা খুব অল্প একটু গরম জলে চটকে নিন। সরিয়ে রাখুন।

দশ-বারোটা গোলমরিচ, এক চামচ জিরে, আর মাঝারি সাইজের তিন কোয়া রসুন একসঙ্গে থেঁতলে নিন। যাঁদের বাড়িতে শিলনোড়া নেই আর রাখতেও চান না, তাঁরা একটা ছোট দেখে হামানদিস্তায় ইনভেস্ট করতে পারেন। আজীবনের ইনভেস্টমেন্ট হবে।  

এর পর একটা সসপ্যানে চার কফি মাগ জল নিয়ে সেটা উনুনে বসান। তেঁতুলগোলা আর রসুন-জিরে-গোলমরিচ বাটাটা দিয়ে দিন। ভালো করে ফোটান। সাত থেকে দশ মিনিট মতো। স্বাদমতো নুন দিন। আমি তিন বড় চামচ দিয়েছিলাম।

এবার শেষ স্টেপ, যাকে বলে তড়কা। একটা ছোট পাত্রে এক চামচ তেল দিন। অন্যান্য রান্নায় যেমন যত বেশি তেল খেতে তত ভালো, এখানে কিন্তু সে রকমটা নয়। বেশি তেল হলে জলের ওপর বিশ্রী ভাবে ভেসে থাকবে আর সেটা চুমুক দিয়ে খেতেও ভালো লাগবে না। কাজেই এক চামচই দিন। তেল গরম হলে এক চামচ সর্ষে আর একটা শুকনো লঙ্কা ভেঙে দিয়ে দিন। এবার সর্ষেগুলো ফুটতে দিন। ভয় লাগলে, বা চারদিকে তেলের ছিটে না লাগাতে চাইলে ঢাকনা দিয়ে রাখতে পারেন। ফটাফট আওয়াজ থেমে এলে এবার তড়কাটা ফোটানো রসমে মেশান। মেশানোর একটা সোজা রাস্তা বলছি, নিয়ে দেখতে পারেন। প্রথমে অল্প একটুখানি রসম, এক-দু চামচ হলেই হবে, এ পাত্র থেকে নিয়ে তড়কার পাত্রে ঢালুন। ভীষণ জোরে ছ্যাঁক করবে আর ধোঁয়া উঠবে, ঘাবড়াবেন না। তারপর সেই তড়কা মেশানো অল্প রসমটা বেশি রসমের পাত্রে ফিরতি ঢেলে দিন। ব্যস মিশে গেল তড়কা।

এইবার বাকি রইল ছাঁকনি দিয়ে একটা বড় দেখে কাপ বা মাগে ছাঁকা আর প্রাণের সুখে খাওয়া। খাওয়ার সময় একটা বড় রুমাল, কিংবা আপনি যদি সাহেবি মনোভাবাপন্ন হন, তাহলে একবাক্স টিস্যু পেপার পাশে নিয়ে বসবেন। কাজে লাগবে।

শেষে আরেকটা উপদেশও না দিয়ে পারছি না, যদি আপনার বাড়িতে কাজের লোক বা ডিশওয়াশার না থাকে, তাহলে বাসনগুলো তক্ষুনি ধুয়ে রাখুন। পরে ধুতে বেশি বই কম কষ্ট হবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। 





Comments

  1. তেঁতুলটা যোগাড় করা গেলেই বানিয়ে ফেলবো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইন্ডিয়ান স্টোরে পরের বার গেলে নিয়ে আসবেন।

      Delete
  2. এই তো বেশ একটা ডিসগাইজড রান্নার রেসিপি পাওয়া গেল। সর্দি কমেছে? মা যাই বলুন না কেন, ঠান্ডা লাগার একটা প্রধান কারণ হল লোকে বাড়ির ভেতরে বীরপুরুষ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাইরে বেরোলে দেখবেন টুপি, মোজা, স্কার্ফ সব আছে, আর বাড়ির ভেতরে একটা পাতলা সোয়েটার পরে বসে থাকে।
    ইয়ে, বউটুপি টা কি জিনিস আজ্ঞে? মাঙ্কিটুপি তো জানি। প্লিজ বলবেন না যে বউটুপি আর মাঙ্কিটুপি এক পদার্থ, রাত্তিরে খাওয়া জুটবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বউটুপি...আচ্ছা ছবি দেখিয়ে দেব'খন। দেবাশিস আমার বাবা আপনার সঙ্গে একেবারে একমত হবেন বাড়িতে ঠাণ্ডা লাগার ব্যাপারে। বাবারও এ ধরণের বীরপুরুষগিরি একেবারে নাপসন্দ।

      Delete
  3. Rasam boro bhalo jinish, toor dal o oti bhalo. Arhar dal boli banglay, ektu roshun, asto jeere ar ghee er tadka diye ki bhalo lage abar sambhar eo bhalo lage. Kine felo ekta packet.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ও, তুরকেই অড়হর বলে? বোঝ। ভাগ্যিস বললেন।

      Delete
  4. aami abar tentul er dike nei....anek bochar doi aar tentul er oporei chilam...with intermittent kundru and tinda! tai oi shob theke ek haat dure thaki :)

    ReplyDelete
  5. "shosta" byaparta ektu objectively evaluate kora jaak. ki ki laglo? tnetul, golmorich, jeerey, roshun, tel, shorshey, shukno lonka, aar shob fotanor jonyo rannar gas. laabh? shordir congestion-ta komano. compare this to, ekta 10mg cetrizine tablet - generic-er daam Rs. 3.50. not convinced at all :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সোমনাথ, কনভিন্স করানো আমার উদ্দেশ্যও ছিল না। কাজেই নো ইস্যুস।

      Delete
  6. mone hocche ekkhuni banie khai,besh aram paoa jabe

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি খেয়ে সত্যিই আরাম পেয়েছি।

      Delete
  7. ei to new year resolution bhaloi egoche :)
    rasam ta mushur daal diyeo bhalo hoe shunechi, amar o rasam khete bhishon bhalo lage, amar kortaa-r south indian advisor er bari gelei nirlojjer moto haanri ulte rasam shesh kori ami!
    nije banale khoob thick hoye jae aar otota bhalo taste o hoena kichutei :| dekhi tomar ta with daal diye try korbo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওকে পরমা, বোলো তো কেমন হল, তাহলে আমিও ডাল দিয়ে ট্রাই করতে পারি।

      Delete
  8. Janme ami South Indian khabar bhalo basina kintu Tomar lekha ta pore rasam khabar ichhe Emon holo je aj rasam nije banie khachhi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী যে খুশি হলাম তুমি রসম বানিয়ে খাচ্ছ জেনে। থ্যাংক ইউ রুচিরা।

      Delete
  9. বানিয়ে খেলাম। পাস করে গেছেন, উইথ ডিস্টিন্কশন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে !!! থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। খুব ভালো লাগছে শুনে।

      Delete

Post a Comment